জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি -৩ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি -৩
সুমিত্রা ঘোষ

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহর একটি সুপ্রসিদ্ধ জায়গা। পূর্বে হালিশহরের নাম ছিল কুমারহট্ট। হালিশহরের কাছেই গঙ্গার তীরে একটি ছোট্ট গ্রাম, নাম কোনা। হালিশহর বহুগুণে গুণান্বিত ছিল। এই হালিশহরে আমরা শ্যামামায়ের সন্তান সাধক রামপ্রসাদকে পেয়েছি। সেযুগে হালিশহর বলতে বোঝাত বৈষ্ণবস্থানগুলির মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ স্থান। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুরুদের ঈশ্বরপুরীর জন্মভিটা এই বিখ্যাত হালিশহর। যেহেতু গুরুর জন্মভিটা সে কারণে এই হালিশহর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছেও পুণ্যতীর্থ। মহাপ্রভু নীলাচলে চলে গেলে প্রভুর-পার্ষদ শ্রীবাস হালিশহরে থেকেছেন। প্রসিদ্ধ চৈতন্য ভক্ত বৃন্দাবন দাস তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা দিয়েছেন শ্রীবাস অঙ্গন যেখানে মহাপ্রভু সেখানে। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন শ্রীবাসের সাংসারিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকা সত্ত্বেও কোনদিন অন্নচিন্তা করতে হয়নি। শ্রীশচীনন্দনের কৃপায় শ্রীবাস মাসোহারা পেয়েছেন। হালিশহরের কালী মায়ের সন্তান রামপ্রসাদ সেনকেও অন্নচিন্তা করতে হয়নি, মাসোহারা পেয়েছেন। রামপ্রসাদ শাক্ত ধর্মের বীজ বপন করেছেন। এই প্রসিদ্ধ হালিশহরের কোনা গ্রামের মেয়ে রানি রাসমণি অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। গৌরবর্ণ দেহের রং, লাবণ্যময়ী মুখশ্রী, টানা আয়ত চোখ, মাথাভর্তি একরাশ কালো চুলে রাণীর সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ত রানী রাসমণি অতি সুলক্ষণা ছিলেন। খুব শৈশবকালে রাসমণি ডুমুরের ফুল দেখে খুশী মনে সে কথা মা রামপ্রিয়াকে বলায় মা বলেছিলেন তুই রাণী হবি। কথায় বলে ডুমুরে ফল সচরাচর দেখা যায় না এবং যদি কেউ ডুমুরের ফুল দেখতে পায় তবে সে সৌভাগ্যের অধিকারী হবেই। রাসমণি রাজরাণী হয়েছিলেন।রনির মা রামপ্রিয়া বেশীদিন বাঁচেননি। রাসমণি সাত বছরে পা দিয়ে মাতৃহারা হয়েছেন। মাত্র আটদিনের জ্বরে পরলোকে চলে গেলে রামপ্রিয়া।মেয়ে রাসমণির জীবনে কত অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটার সাক্ষী হতে পারেননি রামপ্রিয়া।রাসমণির পরিবার ছিল বৈষ্ণব পরিবার। মালা-তিলকাদি ধারণ পারিবারিক প্রথা। শৈশব কাল থেকেই রাণী  রাসমণির মালা তিলকাদি ধারণ করতেন।

স্ত্রী রামপ্রিয়া মারা যাওয়ার পর হরেকৃষ্ণ দাস দুই পুত্র, এক কন্যা ও এক ভগিনীকে নিয়ে সংসার চালিয়ে যান। হরেকৃষ্ণ দাস  কিছু লেখাপড়া জানতেন। উৎসাহী হয়ে কন্যা রাণী রাসমণিকেও লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। রাণী কোনদিন স্কুলে যাননি। তখনকার দিনে মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। মেয়েদের বাইরে পড়তে যাওয়া ঘোর অপরাধ বলে গণ্য করা হত। কোনা গ্রামের যে জায়গায় হরেকৃষ্ণ দাস বসবাস করতেন সেখানে একমাত্র তারই বাড়িতে রাতের বেলা রামায়ণ - -মহাভারত আর পুরাণাদি পাঠ করা হত। গ্রামবাসীরা লণ্ঠন হাতে  হরেকৃষ্ণ দাসের বাড়িতে এসে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণাদি পাঠ  শুনতেন। সকলের সঙ্গে হরেকৃষ্ণ দাসের ছোট্ট কন্যাটি (রাণী রাসমণি) আত্মগত চিত্তে ঐ সমস্ত অমৃতকথা শ্রবণ করতেন। বাবা রাজচন্দ্র দাসের ঈশ্বরপ্রীতি মেয়েকে কেবল আকৃষ্টই করেনি, পরবর্তী জীবনে পুণ্যবতী হয়ে ওঠার পেছনে বাবা যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। রাণী  রাসমণির মাতা-রামপ্রিয়া ছিলেন অশেষ ধর্মপ্রাণা, পুণ্যবর্তী এবং ভাগ্যবতী ভাগ্যবতী মানে অনেকে মনে করতে পারেন অর্থসম্পদে যে মহিলা বিভূষিতা হয়েছেন তিনিই ভাগ্যবতী কিন্তু আসলে তা না।  প্রকৃত অর্থে যিনি সুসন্তানের জন্ম দিয়ে আমাদের দেশকে গৌরবান্বিত করেছেন তিনিই ভাগ্যবতী।
ক্রমশ

🍂


Post a Comment

0 Comments