জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—উগাণ্ডা (দক্ষিণ আফ্রিকা)সোনালি ঝুঁটির সারস /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—উগাণ্ডা (দক্ষিণ আফ্রিকা)
সোনালি ঝুঁটির সারস

চিন্ময়  দাশ 


[ হরেক রকমের সারস পাখি আছে আফ্রিকায়। ভিন্ন ভিন্ন গড়ন, ভিন্ন ভিন্ন রঙ তাদের গায়ে। এক জাতের সারস আছে, যাদের মাথায় আছে সোনালি রঙের ঝুঁটি। সারা দুনিয়ায় আর কারও নাই এমনটি। এমন ঝুঁটি কী করে হোল, তাই নিয়ে এবারের গল্প। ]

দেশের রাজামশাই ভারি ভালোমানুষ। প্রজাদের ভালোবাসেন নিজের সন্তানের মতো। তাদের সুখ-সুবিধার দিকে কড়া নজর তার। 
রাজামশাইর নিজের সন্তান বলতে একটিই মেয়ে। ভারি মিষ্টি দেখতে। সব্বাই ভালোবাসে ফুটফুটে আর সুন্দরী মেয়েটিকে। রাজামশাইর তো চোখের মণি মেয়েটি। 
ছোট হলে কী হবে, মেয়েটিও খুব দয়ালু। রাজ্যের প্রজাদের খুব ভালোবাসে সে। এমনকি, রাজ্যের যত জীব-জন্তু, পশু-পাখি, ফুল-ফল-- সব কিছু ভালোবাসে মেয়েটি। সব কিছুই।
রাজামশাইর নিজের এক ভাই আছে। সে থাকে সেসে দ্বীপে। দেশের রাজধানি হোল কাম্পালা। তার গা ঘেঁষে বিশাল এক হ্রদ। বিদেশিরা এসে নাম করেছে ভিক্টোরিয়া লেক।
নামেই লেক। আসলে তার চেহারা ছোটখাট একটা সমুদ্রের মতো। হ্রদটার ভেতরেই আছে ছোট বড় অনেকগুলো দ্বীপ। কোনটাতে মানুষজনের বসবাস নাই। কোনওটাতে আছে। রাজার ভাই থাকে তেমনই একটা দ্বীপে। 
 ভাইকে দেখতে ফি-বছর অন্তত একবার যাওয়া চাই রাজামশাইর। কোন কোনও বছর মেয়েকেও সাথে নিয়ে যায়। এবছরও সাজগোজ শুরু হয়ে গিয়েছে যাওয়ার। 
রাজার সেনাপতির ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। দু’-দুটো যুদ্ধজাহাজ সাজানো হতে লাগল। তার সাথে ছোটমতন  একটা নৌকো। শয়ে-শয়ে মাঝি-মাল্লা। লোক-লস্কর। খাবার-দাবার। অস্ত্র-শস্ত্র। কত কিছুরই প্রয়োজন হয় জলযাত্রায় বেরুতে গেলে। সবই যেন মুখস্ত আছে সেনাপতির। হাঁকাহাঁকি হম্বি-তম্বি করে কাজ করাচ্ছে মানুষটা।
রাজার মেয়ের পছন্দ বড় জাহাজখানা। কী সুন্দর করে সাজানো সে জাহাজের গলুইটা! কৃষ্ণসার হরিণের শিঙ আর টিয়াপাখির পালক দিয়ে সাজানো। শুধু কি তাই? হরেক গড়নের ছোট-বড় ঝিনুক আছে। নানা রঙের নুড়ি-পাথর আছে। ডোরা কাটা চামড়াও বসিয়েছে। বাঘ বা জেব্রাদের গায়ে থাকে যেমনটা। যখনই যায়, বড় জাহাজেই চড়ে রাজার মেয়ে।
সেই জাহাজের ডেকের উপর একটা মঞ্চ গড়া হয়। মাথায় সবুজ ঘাসের ছাউনি দেওয়া। শান্তি তার সেবিকা মেয়েটিকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসে। বিশেষত রোদের তাত বাড়লে, মঞ্চে গিয়ে বসে তারা দুটিতে।
কত যে গান জানে দাঁড়ি-মাঝিরা! আর, কী মিষ্টি সুর তাদের সেইসব গানের! একজন গান ধরে জোর গলায়। বাকিরা সবাই মিলে ধুয়া ধরে সে গানের। দাঁড় বাইতে বাইতে, এভাবেই লম্বা লম্বা গান গেয়ে, সময় কাটায় তারা। দাঁড় বায় আর গান গায়। গান গায় আর দাঁড় বায়। 
দূরের দিগন্ত পর্যন্ত দরিয়ার নীল জলের চাদর বিছানো। দাঁড়িদের মিষ্টি গান ভেসে যায় সেই জলের উপর দিয়ে। আকাশ শোনে সে গান। বাতাস শোনে। ছোট বড় কতো না পাখপাখালি দরিয়ার বুকে। তারাও গান শোনে। হাঙর কুমির মাছেরাও শোনে জলের তলায় থেকে।
শান্তি এসে ঘাসের ছাউনি দেওয়া মঞ্চে বসে মাঝে মাঝে। দাঁড়িরা তখন গান ধরে রাজকুমারির জন্য। মেয়েটিকে ভারি পছন্দ দাঁড়ি-মাঝিদেরও। সে বাইরে এসে বসলে, তারা গান ধরে—
দূর দরিয়ার দেশে যাই। এসো সবাই গান গাই। প্রথম জনের পর, সকলে গেয়ে ওঠে—হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ ভাই, এসো সবাই। রাজকুমারির জন্য গান গাই। 
এবার তাদের গান চলতে থাকে, চলতেই থাকে ঃ রাজকুমারিকে বলো, সেসি দ্বীপের রঙবাহারি সাজা। সেসি হোল সবুজ দ্বীপের রাজা।।
বাকিরা ধুয়ো ধরে—বলো বলো তাকে বলো।
--সেসি দ্বীপে নানা জাতের পাখি। সকাল সন্ধ্যা তাদের ডাকাডাকি।।
-- বলো বলো তাকে বলো।
--সেসি দ্বীপে কতো জাতের গাছ। সেসির জলে রঙ-বেরঙের মাছ।।
-- বলো বলো তাকে বলো।
--সেসি দ্বীপে নিত্য রাতে গান। বইতে থাকে আনন্দেরই বাণ।।
-- বলো বলো তাকে বলো।
--সেসির বুকে পাহাড় গুহা নদী। সেসির মাটি শান্ত নিরবধি।।
-- বলো বলো তাকে বলো।
এভাবে গান চলতে থাকে। চলতেই থাকে। যতক্ষণ রাজার মেয়ে, ততক্ষণ গান মাঝিমাল্লাদের।
এখনও জাহাজ সাজানোর কাজ চলছে। কাজ সারা হলেই, রওণা দেওয়া হবে। শান্তি রাজামশাইকে গিয়ে বলল—আচ্ছা বাবা, এই লেকে কত না দ্বীপ। আমরা একই দ্বীপে বার বার যাই কেন?
রাজ বলল—এটা সত্যি, সাগরের মতো এই লেকটাতে আরও অনেক দ্বীপ আছে। কিন্তু সব দ্বীপই তো আর আমাদের রাজ্যের মধ্যে নয়। সেসব দ্বীপ অন্যদের। অন্য রাজা, অন্য নিয়ম। 
মেয়ে বলল—তাতে কী হয়েছে?
--তাদের দ্বীপে ঢুকে পড়লে, বিপদ হবে রে, মা। রাজা বলল—তারা ভিন্ন জাতির লোক। মুখের ভাষা ভিন্ন তাদের। সেসব দ্বীপে নামলে, আর রেহাই নাই। তারা মেরেই ফেলবে আমাদের। 
ভয় তো পেলোই না। উলটে মেয়ে বলল—আমার ভারি ইচ্ছে সেই দ্বীপগুলো দেখবার। সেসব দ্বীপের মানুষদের দেখবার। তাদের পরণের বেশভূষা দেখতে চাই আমি। শুনতে চাই তাদের মুখের অচেনা ভাষা।
রাজার মুখে মিষ্টি হাসি—কেনরে মা? দূরের দেশে, অন্যের দেশে যাবার দরকারটা কী? এটা আমাদের নিজেদের দেশ। এই দেশ কতো সুন্দর! কতো কিছুই দেখবার আছে এই দেশে। শুনবার আছে। জানবার আছে। শেখবার আছে। নিজের দেশ, সে তো স্বর্গের চেয়েও সুন্দর মা! 
বাবার কথার জবাব দিল না মেয়েটি। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সে দেখেছে, জাহাজ ভেসে যায় সাগরের উপর দিয়ে। যেদিকেই যতদূর দেখা যায়, নীল জল আর নীল আকাশ। সেগুলোর মাঝে মাঝেই কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দ্বীপগুলো। যেগুলো সে কোন দিন দেখেনি। হয়তো দেখবেও না কোনদিন। 
আর দিন দুই বাকি যাত্রার। আবার জাহাজ ভাসানো হবে। আবার সেই একই পথে যাওয়া। সেই একই দেশে যাওয়া। ভালো লাগে না শান্তির।
সকালে উঠে, বাবার বাগানে এসেছে মেয়েটি। কুল কুড়াচ্ছে গাছের তলায় ঘুরে ঘুরে। তখনই একটা সারসপাখি এসে নেমে পড়ল ঝুপ করে। বেশ বড়সড় চেহারা। কী বিশাল দু’খানা ডানা। সরু লম্বা লম্বা পা। আর, ভারি অদ্ভূত ভঙ্গী সারসদের পা ফেলবার।
রাজার মেয়ের সামনে এসে দাঁড়াল সারস। লম্বা গলা ঝুঁকিয়ে, কুর্ণিশ জানালো মেয়েকে। বলল—আমার ভাই থাকে ক্যাভিরোণ্ডো নগরে। ভারি অসুখ করেছে তার। আমি যাচ্ছি তাকে দেখতে। তুমি যাবে আমার সাথে?
শুনেই পা দুটো নাচতে লাগল রাজার মেয়ের। সে চটপট জানতে চাইল—তোমার এই ক্যাভিরোণ্ডো নগরটি কোথায়?
--এই যে লেক, এর একেবারে অন্য পারে। অনেকখানি দূরের পথ। একেবারে বুনো মানুষদের দেশ। তাদের আদব-কায়দা আলাদা। মুখের কথা তো একেবারেই দুর্বোধ্য। কিচ্ছুটি বোঝা যায় না।
--আহা, আমার কত দিনের সাধ, এমন একটা দেশে যাওয়ার। 
সারস বলল—তাহলে, চলো আমার সাথে। যদি তুমি ভয় না পাও, আমি তোমাকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে চলে যাব। 
--তোমার পিঠে চেপে যাব? 
--তাই তো যাবে। নইলে যাবে কী করে? সারস বলল—অনেক বড় ডানা আমার। শিরদাঁড়াও অনেক শক্তপোক্ত। কোন অসুবিধা নাই। তোমাকে কেবল শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। আর, ভয় পেলে চলবে না। ভয় পেলে, চোখ বুজিয়ে ফেলো। অনেক দূরের পথ। হাত আলগা হলেই ঝুপ করে পড়বে, আর তলিয়ে যাবে সাগরে। চিন্তার কিছু নাই। চেপে পড়ো। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসব। 
আর, দেরী নয়। রাজাকে বলা হোল না। সখীকে কওয়া হোল না। সারসের পিঠে চেপে বসল শান্তি। সারসও ডানা মেলে দিল আকাশে।
তারা উড়ে চলেছে নীল সাগরের উপর দিয়ে। ছোট ছোট দ্বীপ জলের বুকে। কোন কোনওটা এতো ছোট, কোন মানুষের বাস নেই সেগুলোতে। পাহাড়ের ফাঁক-ফোকরে মাছরাঙা,বা পানকৌড়ির মত পাখিদের বাসা কেবল।
এক সময় দেখা হোল বাদামি রঙের এক ঝাঁক টিয়াপাখির সাথে। তাদের লেজ লালরঙের। সারস তাদের জিজ্ঞেস করল—কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
--কিয়াগবে যাচ্ছি গো আমরা। উড়তে উড়তে তারা জবাব দিয়ে গেল— বুনো কুল পেকেছে সেই দ্বীপে।
উড়ে চলেছে দু’জনে। পিছনে সরে যাচ্ছে দ্বীপের পর দ্বীপ। এখন তাদের চার পাশে আর কিছু নাই। মাথার উপরে আকাশ। নীচে নীল সাগরের গালিচা বিছানো। বাকি চরাচর জুড়ে সোনালী রোদ্দূর।
আকাশ ফুঁড়ে বাতাসে ভেসে ভেসে যাওয়া। আগে কখনও হয়নি। পরেও কখনো আর হবে না হয়তো। অদ্ভূত রোমাঞ্চ হচ্ছে মেয়েটির। আনন্দে, ভালো লাগায় বুক ভরে গিয়েছে রাজার মেয়ের। তবে, পাখির হুঁশিয়ারি ভুলে যায়নি। স্থির হয়ে বসে আছে পিঠের উপর। ডানা ধরে আছে শক্ত মুঠোয়। 
আরও অনেকক্ষণ উড়বার পর, দূরে একটা কালো রেখার মত কিছু চোখে পড়ল নীল চাদরের ওপর। শান্তি বলল—দূরে, জলের বুকে ওটা কীসের দাগ?
সারস হেসে বলল—দাগ নয় গো, মেয়ে। একটা দেশ ওটা। ক্যাভিরোণ্ডো দ্বীপ। ওখানেই যাচ্ছি আমরা। ওখানেই থাকে আমার ভাই। পৌঁছে গেছি আমরা। আর সামান্য বাকি। 
আনন্দে ভরপুর সারসের গলা। কথা বলতে বলতে, সমুদ্রের তীর দেখা গেল এক সময়। এবার নীচে নামতে লাগল সারস। 
বড় একটা পাহাড়ে এসে নামল তারা। সারসের পিঠ থেকে নেমে, চার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল শান্তি। যেটাতে চোখ পড়ে, সেটাই ভালো লাগে মেয়ের। যেটা ভালো লাগে, চেয়েই থাকে সেটার দিকে। 
কালচে রঙের বিশাল পাহাড়। লম্বা লম্বা শিরাগুলো নেমে গিয়েছে সাগরের জলে। উলটো দিকে চারদিক জুড়ে মাইলের পর মাইল সমতল ভূমি। তার পিছনে, দূরে উঁচু নান্ডী পাহাড়। তার ধোঁয়া ধোঁয়া ছবি। সবুজ গালিচায় মোড়া দেশ উগাণ্ডা। তার চেয়ে একেবারে উলটো ছবি এই দ্বীপদেশের।
পাশেই পাহাড়ের একটা খাঁজ। রাজার মেয়েকে সেখানে নিয়ে গেল সারস। বলল—এইখানটিতে থাকো তুমি। ছায়া আছে বেশ। তেমনি ঠাণ্ডাও আছে জায়গাটা। আরামেই থাকতে পারবে এখানে। তাছাড়া, ঠিক নীচেই রাস্তা আছে একটা। লোকজনের চলাচল আছে। বসে বসে দেখো। কান পাতলে কথাবার্তাও শুনতে পাবে তাদের। তবে, খুব সাবধান কিন্তু। কেউ যেন দেখতে না পায় তোমাকে। একবার চোখে পড়ে গেলে কিন্তু, আর রেহাই পাবে না কোনমতে। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে একেবারে।
সারস বেরিয়ে পড়ল তার ভাইকে দেখতে। বলে গেল—বেশি সময় লাগবে না আমার। যাবো আর আসবো। এসেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। 
নীচের রাস্তাটার দিকে চেয়ে বসে আছে শান্তি। ওপরে কাছাকাছি বোধহয় কোন সেনা ছাউনি আছে। এক দল সৈন্য কুচকাওয়াজ করতে করতে নেমে গেল নীচের দিকে। সেনাদের মাথায় শামুকের মোটা খোল দিয়ে তৈরি হেলমেট। তাতে গোছা গোছা উটপাখির পালক গোঁজা। পরণে কোনও কাপড় নাই কারও। কয়েকটা করে মালা ঝুলছে কোমর থেকে। লোকগুলোর পেট বুক গলা মুখ জুড়ে মোটা মোটা ডোরা কাটা। সাদা, হলুদ আর লাল রঙের ডোরা।
খানিক বাদেই এল এক দল মেয়ে। শান্তি অবাক হয়ে দেখল, তাদের পরণেও কোন কাপড় নাই। কয়েকটা করে মালা ছাড়া। আর, চামড়ার ঝালর। 
অন্য দিকে ঘুরে, সমতলের ওপারে গ্রামগুলোর দিকে দেখল। অধিকাংশ বাড়িই বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে অনেকখানি করে জায়গা। বাইরে ফসলের মাঠ। কিন্তু তাদের মত কলার বাগান নাই এখানে। কোন ফলের গাছ নাই। নাই কোন ঘাসে ঢাকা মাঠও। 
এবার সারস ফিরে এলো ভাইকে দেখে। বলল—চলো, এবার ফিরতে হবে। সময় হয়ে গিয়েছে। নইলে, অন্ধকার নামার আগে পৌঁছতে পারা যাবে না।
আবার ডানা মেলে দিয়েছে সারস। সূর্য ডোবার দিকে মুখ করে উড়ে চলেছে এখন। রাজার মেয়ে বসেছে তার চওড়া পিঠে।
এক সময় তীরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল তারা। সবজে রঙ দ্বীপের। ওপর থেকে এমন করে কখনও দেখেনি নিজের দেশকে। ভারি ভালো লাগছে শান্তির। কী এক মায়াময় দেশ! বিড়বিড় করে বলতে লাগল—আহা, উগাণ্ডা! আমার সোনার দেশ! আমার প্রিয় জন্মভূমি। কখনও আর অন্য কোন দেশ দেখতে চাইব না আমি। কখনও না।  
🍂

কাছাকাছি হচ্ছে, আর রঙ বদলে যাচ্ছে বিশাল দেশটার। সবজে আভা মুছে গিয়ে, মাঠগুলো বাদামি হয়ে উঠছে একটু একটু করে। সারস বুঝিয়ে বলল—আসলে, এখন হোল বাজরা পাকবার সময়। মাঠের পর মাঠ জুড়ে পাকা ফসল। তার উপর সূর্যাস্তের আলো পড়েছে মাঠগুলোতে। সেকারণেই এই রঙ বদল।
একটু বাদে রাজার বাড়ি দেখা গেল ওপর থেকে। এবার আর বাগানে নয়, প্রাসাদের সামনে এসে নামল সারস। সারসকে যেতে দিল না শান্তি। তাকে সাথে নিয়ে, একেবারে দরবারে এসে হাজির হোল বাবার সামনে।
রাজামশাই বলে উঠল—কোথায় ছিলি মা, সারাদিন? আমরা ভেবে ভেবে সারা।
শান্তি কলকলিয়ে বলে গেল তার অভিযানের কথা। এক এক করে বিবরণ দিয়ে চলল। কী দেখেছে, কাদের দেখেছে, কোথায় গিয়েছিল আজ। বলেই চলল, বলেই চলল। 
থামল যখন, রাজামশাইর মুখে হাসি। সারসকে বলল—ভারি সুন্দর একটা কাজ করেছ তুমি। সে দেশে আমি নিজেই কখনও যতে পারিনি। যেতে পারবও না কোন দিন। আমার মেয়েকে সেই দেশ দেখিয়ে এনেছ তুমি। ফিরিয়েও এনেছ নিরাপদে। তোমাকে একটা পুরষ্কার দিতে চাই আমি। শুধু তুমি নয়। তোমার বংশধররাও গর্ব করবে সেটা থেকে। গোটা দুনিয়ায় দয়ালু আর নির্ভরশীল হিসাবে সম্মান করেবে সকলে তোমাদের।
বুড়ো মন্ত্রী ছিল রাজার পাশটিতে। সে বলল—এমন কী দেওয়া হবে এই পাখিকে, গোটা দুনিয়া জানবে সে কথা? 
রাজামশাইর মুখে মিটিমিটি হাসি। মুখে কিছু বলল না। মঞ্চ থেকে নেমে এসে, হাত বুলিয়ে দিল সারসের মাথায়। অমনি আশ্চর্য আর সুন্দর এক কাণ্ড! 
দরবার শুদ্ধ লোকের চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা। একেবারে ছোট্ট একটা ভোজবাজীর মতো। এতগুলো জ্ঞানী-গুণী মানুষ দরবারে। কথা সরল না কারুর মুখেই।
রাজামশাই হাত সরিয়ে নিল পাখির মাথা থেকে। অমনি একটা ঝুঁটি গজিয়ে গেল সারসের মাথায়। সোনালী রঙের ঝকঝকে এক গোছা পালক। ঝুঁটিটার নীচে কালো রঙের বেড় দেওয়া।
রাজার ভাই জাদুগর। দূরের দ্বীপে থাকে সে মানুষটা। আজ জানা গেল, জাদু জানে এ দেশের রাজাও। যে কথা এতোদিন কেউ টেরটিও পায়নি। 
পুরষ্কার পেলে, কার না ভালো লাগে? তাও আবার একেবারে দেশের রাজার হাত থেকে পাওয়া। সারস আহ্লাদে গদগদ হয়ে, একটা লম্বা কুর্ণিশ করে দিল রাজাকে। ল্যাকপেকে দুটো ঠ্যাঙ সারসের। ডানদিকেরটা ভাঁজ করে প্রায় মাথায় ঠেকিয়ে ফেলে, আর কী!
সেদিন থেকে এক জাতের সারসের মাথায় সোনালী ঝুঁটি দেখা যায়। দুনিয়া জুড়ে এমন ঝুঁটি আর কারও নাই। এই ঝুঁটি হোল-- ভালো কাজের পুরষ্কার।
এ গল্প যারা পড়বে, তাদের মধ্যে যদি কেউ আফ্রিকায় গিয়েছে, হরেক জাতের সারস দেখেছে নিশ্চয়ই। তার ভিতর, মাথায় সোনালী রঙের ঝুঁটি দেওয়া সারসও চোখে পড়ে থাকবে। 
কেউ যদি ক্যাভিরোণ্ডো যাও কোনদিন, সেই পথটা দেখে এসো অবশ্যই, কিসুমু শহর থেকে মুমিয়াস গিয়েছে পথটা। রাজার মেয়ে শান্তি যে পথে সেনাবাহিনী আর মেয়েদের যেতে দেখেছিল। চেষ্টা করলে, পাহাড়ের ছায়া ঢাকা সেই খাঁজটাও খুঁজে বের করতে, তেমন মেহনত করতে হবে না। সারস পাখি যেখানে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল রাজার দুলালী  মেয়েকে।

Post a Comment

0 Comments