মিনিয়াপোলিশে বিমানবন্দরে অবতরণ, প্লেন বদলের প্রস্তুতি
আমার প্লেন ক্রমশঃই নীচুতে নামছে। গতিবেগ ও সেই অনুযায়ী অদলবদল হচ্ছে। প্লেনের ডানার উত্থান- পতন জানলা দিয়েই দেখছি। বাইরের তাপমাত্রা ৬৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট। আকাশ কখনো মেঘাচ্ছন্ন, কখনও পরিস্কার। নীচের ঘরবাড়ি ক্রমশঃই পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। শরীরটা হঠাৎ কেমন যেন হাল্কা লাগছে। প্লেন ক্রমশ:ই নিচে নামছে, আবার উঠছে; বেশ কাঁপছে। কানগুলো কটকট শুরু করলো। এখন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। নীচের রাস্তার উপর চলমান গাড়ীগুলোকে খেলনা গাড়ীর মতই লাগছে। এখন দেখছি, ধোঁয়ার মত মেঘগুলো উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির ছাদগুলোর আকৃ্তিগত বৈশিষ্ঠ্য চোখে পড়ছে এখন। প্লেনের ডানার অংশবিশেষ ওঠানামা করছে। ঘড়িতে ঠিক ১১-২৭ এ মিনিয়াপোলিশ এয়ারপোর্ট রানওয়ে স্পর্শ করলো। স্থানীয় সময় সকাল ১০-২৭ মিঃ। ফিলাডেলফিয়া এবং মিনিয়াপোলিশ এর মধ্যে সময় পার্থক্য ঠিক এক ঘণ্টা। মিনিয়াপোলিশে প্লেন খালি হয়ে গেল। গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছি। আমার সংগী হ্যান্ডব্যাগ দুটো। খুব একটা ভারী নয়। প্লেন থেকে বেরিয়ে লাউঞ্জের দিকে এগুচ্ছি। রেস্টরুমে গিয়ে জলত্যাগ করে হাতমুখ ধুয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ণ এয়ারলাইনসের কাউন্টারে আমার টিকিট “এন্ডোর্স” করিয়ে নিলাম এবং আমার ঘড়ির কাঁটা একঘণ্টা পিছিয়ে দিলাম। এখন সময় সকাল ১০-৪০ মিনিয়াপোলিশে।
আমার টিকিট endorse করার পর গেট নম্বর ১১ এ তে চলে এলাম। লাউঞ্জে বসে আছি। বেশ গরম লাগছে। বাংলায় কথা কেউ বলছে না। কাজেই এবার একটু দুঃখ হবে বাংলা কথা বলার সুযোগ না পাবার জন্য। মিনিয়াপোলিশে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে এখন এই ডাইরী লিখছি। স্থানীয় সময় ঠিক এগারোটা । এবার আমার ফ্লাইট নং NW 309, ছাড়বে বেলা ১১-৫৫ মিনিটে অর্থাৎ হাতে প্রায় একঘন্টার ও কিছু বেশি সময় আছে। লাউঞ্জে বসা জনৈকা ভদ্রমহিলার কাছে জেনে নিলাম আমার ফ্লাইট সম্পর্কে। সুনিশ্চিত হয়ে নিলাম। হাতে কোন কাজ নেই। আপনমনে ডাইরী লিখছি লাউঞ্জে বসে। পাশের যাত্রীরা মনে হয় একই পরিবারের। কারণ তারা বেশ গল্পগুজবে মত্ত এবং ওদের গন্তব্যস্থলও ফার্গো। হাতে ভারী ব্যাগ থাকায় কোথাও ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে না। লাউঞ্জে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছি। বাইরের দৃশ্য দেখছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে শহর দেখতে যাওয়ার মত সময় অবশ্য একঘন্টায় হয় না। আমার কানের পর্দাগুলো এখন অবশ্য শোঁ শোঁ করছে ফিয়াডেলফিয়া থেকে আসার পর থেকেই। প্লেন যাত্রার জন্যই নিশ্চয়ই। চোখদুটো বিশ্রাম চাইছে। মাঝে মাঝে চোখ বুঝছি। সময় এগিয়ে চলেছে। এখানকার এয়ারপোর্টের বৈশিষ্ট্য খুব একটা চোখে পড়ছে না বা নতুনত্বে বিশেষ কিছুই নয়।
ফার্গো অভিমুখে আমার যাত্রা
মিনিয়াপোলিশ রানওয়ের উপর অনেকগুলো প্লেনের আগমন ও বিদায় দেখালাম। মালবাহী গাড়ীগুলো রানওয়ের কাছাকাছি ইতঃস্তত ঘোরাফেরা করছে। আমেরিকা আসার পর ফিলাডেলফিয়ায় থাকার সময় বাংলাতেই কথা বলে কেটেছে। এবার চলেছি 'পান্ডববর্জিত' জায়গায়। ইংরাজীতেই সব কিছু করতে হবে।
লাউঞ্জের সামনেই নর্থ-ওয়েস্টার্ণ এয়ারলাইন্সের কাউন্টার। আমার টিকিটে ফ্লাইট নম্বর ও তারিখ বসিয়ে দিল ওখান থেকে। প্লেনে ঢোকার জন্য গেট খুলল ঠিক ১১-৪৫। প্লেনে ঢুকে পড়লাম গুটি গুটি। এবারকার প্লেনখানা খুব ছোট, তবে যাত্রীসংখ্যা অনেক। কোনোও সীট খালি নেই। স্থানীয় সময় ১১-৫৫ মিনিটে প্লেনের নড়াচড়া শুরু হল। কারণ ১১-৫৫ মিনিটেই ডিপারচার। মিনিয়াপোলিশ বিমানবন্দরের রানওয়ের মাটিকে স্নেহচুম্বন জানাচ্ছে আমার প্লেন, গতিবেগ নিচ্ছে উঁচুতে উঠবার আগে। এখন ১২-০৪, প্লেন উপরে উঠে গেল।
এবার আমার যাত্রা ফার্গো, নর্থ ডাকোটা অভিমুখে। জানলার পাশে সীট নিয়েছি। সীট নম্বর না থাকায় যে যেখানে খুশী বসেছে। আমার সিট A11 Right Window. বাইরের দৃশ্য দেখবার জন্য জানলার পাশে সীট নেওয়া। কিন্তু বাইরে এত ঘন সাদা মেঘ যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সূর্যের আলো যেন গুমরে কেঁদে মরছে- নিজেকে প্রকাশ করতে না পেরে।
ফার্গো বিমানবন্দরে অবতরণ
ফার্গো অভিমুখে উড়ে চলেছি। এবারের যাত্রীরা অধিকাংশই নতুন। আমার পাশের যাত্রী WALL STREET JOURNAL নামে একখানা খবরের কাগজের উপর চোখ বোলাচ্ছেন। আমার প্লেন এখন বেশ উঁচুতে উঠে পড়েছে। বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না একমাত্র মেঘ ছাড়া। এবারের যাত্রা একটু বেশি সময় নিয়ে। বেলা ১২-৪৬ এ ফার্গো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা। প্লেন এখন একটু একটু কাঁপছে, আরও উঁচুতে ওঠার জন্য।
আগেই বলেছি, মিনিয়াপোলিশে এসে আমার ঘড়ি adjust করে নিয়েছি। কাজেই এখন সময় ১২-১৫ অর্থাৎ ফিলাডেলফিয়ায় দুপুর ১-১৫। এখন একটু একটু ক্ষিদে পাচ্ছে। এয়ার হোস্টেসও দৌ্ড়াদৌড়ি শুরু করেছে লাঞ্চ সার্ভ করবার জন্য। প্লেনে উঠলাম-পরে বেশ গরম লাগছিল মিনিট দশেক আগে। এখন অবশ্য গরম লাগছে না। লাঞ্চ এসে গেল, হ্যাম সান্ডুইচ , কফি, কোক, স্যালাড। লাঞ্চ খাওয়া শেষ হল ১২-৩৮ মিনিটে। ল্যান্ড করার সময় হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে আসছিলাম। এখন প্লেন Land করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। Runway স্পর্শ করল ১২-৪০। খুব জোর কাঁপছে। এখনও রানওয়ের উপর উড়ে যাচ্ছে। ফার্গো বিমানবন্দরে পৌঁছালাম স্থানীয় সময় ১২-৪৫। বিমানবন্দরের নাম “হেক্টর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট”।
সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে আত্মীয়স্বজনবিহীন যায়গায় এসে পড়েছি। এখন নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। মন খারাপ লাগছে। যাই হোক, ফার্গো বিমান বন্দরে আমাকে 'রিসিভ' করতে এসেছেন। ডঃ কে নাগেশ্বর রাও নামে জনৈক ভারতীয়, যিনি নর্থ ডাকোটা স্টেট য়্যুনিভার্সিটিতে অংকশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেন। ডঃ রাওকে আগে থাকতেই একটা চিঠি দিয়েছিলাম ফিলাডেলফিয়া থেকে আমার অবতরণ সময়সূচী জানিয়ে। পূর্বপরিচিতি ডঃ রাওয়ের সংগে আমার পরিচয় নেই। ফার্গো বিমানবন্দর থেকে আমার ব্যাগগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডঃ রাও আমার জন্য গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন পার্কিংলটে। আমরা দুজনে মিলে জিনিষপত্র নিয়ে গাড়ীতে বসে পড়লাম। স্থানীয় সময় তখন দুপুর ১-১৫।
ডঃ রাওয়ের সংগে গল্প করতে করতে চলেছি গাড়ীর মধ্যে। দুপুর ১-৪০ নাগাদ ওঁনার বাড়ী পৌঁছালাম। ডঃ রাওয়ের বাড়ীর ঠিকানা ১১১, ২৮ এভিনিউ নর্থ; ফার্গো , নর্থ ডাকোটা ৫৮১০২। আমার জিনিষপত্র রেখে দিলাম ওঁর বাড়ীতেই। ডঃ রাও অবিবাহিত, নিরামিশাষী, অমায়িক, বন্ধুবৎসল ভদ্রলোক; সম্প্রতি তিনি মার্কিণ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। কফি খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নর্থ ডাকোটা স্টেট য়্যুনির্ভাসিটির দিকে। মনটা এবার বেশ খারাপ লাগছে নিজেকে একা একা থাকতে হবে ভেবে। সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আমার এ্যাডভাইসর ডঃ স্ট্যানলী এল ক্লিমেটশনের সাথে দেখা করলাম। ওখান থেকে বেরিয়ে ৪টে নাগাদ ডঃ রাওয়ের বাড়ীতে ফিরে এলাম । আমার নতুন কর্মজীবন শুরু হল নর্থ ডাকোটায়।
ক্রমশঃ
0 Comments