সবুজ দ্বীপ আন্দামান
দশম পর্ব
দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যে কি পরিমান অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন উপরের পরিচ্ছেদ গুলিতে পরিস্ফুট। সেলুলার জেলের সেন্ট্রাল টাওয়ারের তিনতলায় মার্বেল পাথরের ফলকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামের তালিকায় পরিস্ফুট যে অবিভক্ত বাংলা থেকে সর্বাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামে কারাবরণ করেছিলেন। এদের সংখ্যা সর্বমোট ৩৭০ জন। অবিভক্ত বাংলাকে বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে থেকে মোট ১২৯ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী এখানে বিভিন্ন সময়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। নিচে সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করলাম।
প্রদেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংখ্যা সময়সীমা। অবিভক্ত বাংলা ৩৭০ ১৯১০-৩৮ অবিভক্ত পাঞ্জাব ৮৪ ঐ উত্তর প্রদেশ ২০ ঐ বিহার ১৮ ঐ মাদ্রাজ ৩ ঐ মহারাষ্ট্র ৩ ঐ দিল্লী ১ ঐ মোট ৪৯৯
উপরে উল্লেখিত তালিকাটি ব্যতীত দাক্ষিণাত্যের মোপলা বিদ্রোহী এবং রুম্পা কৃষক বিদ্রোহীরা সর্বমোট কুড়িজন ওই সময়ে সেলুলার জেলে অন্তরীণ ছিলেন। মোপলা বিদ্রোহের ১৪ জন বন্দী ছিলেন এবং রম্পা কৃষক বিদ্রোহের ছয়জন বন্দি ছিলেন ১৯৪২ সালের তেইশে মার্চ জাপানিরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ দখল করার পরে সেলুলার জেলের সমস্ত বন্দীদের মুক্ত করে দেয় আন্দামান ভেবেছিলেন দুদিন হয়ে গেল কিন্তু অচিরেই তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছিল হাজার ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা গঠিত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ যারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিপ্লবীদের অর্থ সাহায্য করতেন সেই রকম লীগের সদস্যদের প্রথম গুপ্তচর মামলায় জাপানিরা ৫০ জন ভারতীয়কে ব্রিটিশ গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করে সেলুলার জেলে বন্দি করে রাখে। ওই বৎসরে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ৬০০ জন ভারতীয়কে জাপানিরা কারারুদ্ধ করে রাখে। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে পোর্টব্লেয়ার এসে পৌঁছান এবং তিন দিনের সফর শেষ করে ১লা জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে ফিরে যান। যাবার পূর্বে তিনি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নাম পরিবর্তন করে শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ রাখেন। নেতাজির হস্তক্ষেপে অন্যায় ভাবে বন্দী করে রাখা ভারতীয়দের জাপানি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই সেলুলার জেল থেকে জাপানি সৈন্যরা মুক্ত করে দেয়। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি থেকে মিত্রশক্তির আক্রমণে জাপানিরা সমুদ্রের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং আন্দামানের পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। ফলে আন্দামানে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এই সময়ে জাপানিরা সিদ্ধান্ত নেয় দ্বীপভূমিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের বাঁচিয়ে রাখতে অহেতুক খাদ্যদ্রব্যের অপচয় হচ্ছে। সেই সমস্ত মানুষদের তারা বিনা কারণে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করে রাখে। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে স্টিমারে করে হ্যাভলক দ্বীপে নিয়ে যেয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদেরকে মেরে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। সংক্ষেপে সেলুলার জেল সম্বন্ধে আন্দামানে যেয়ে যেভাবে এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করতে পেরেছি সেগুলি পাঠকের কাছে উপস্থাপনা করলাম।
🍂সন্ধ্যের সময় আলো ও ধ্বনির সাহায্যে সেলুলার জেলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি যে কি পরিমান অত্যাচার করা হয়েছিল সেগুলি দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। দেশমাতৃকার চরণতলে অসংখ্য শহীদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতা লাভ করে আজ আমরা সেখানে যেয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করার সুযোগ পেলাম।
তৃতীয় দিন সকালে রাজীব গান্ধী নগরে পাহাড়তলীতে আমাদের সাময়িক আবাস গৃহ থেকে নেমে বাঁদিকে মেরিনা পার্ককে রেখে ডান দিকের সমুদ্রতীরবর্তী রাস্তা দিয়ে প্রাতঃকালীন ভ্রমণে এক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সমুদ্রের বিপরীতে ডানদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের পোর্টব্লেয়ার শাখাতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ১৯৬১ সালে কতিপয় রামকৃষ্ণ অনুরাগী ভক্ত এখানে একটি সমিতি গঠন করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাবধারাকে দ্বীপপুঞ্জ ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে একত্রিত হন এবং একটি মন্দির স্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী রঙ্গনাথানন্দ এই মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করে রামকৃষ্ণদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে স্বামী তপস্যানন্দ মহারাজ এখানে অসহায় গরীব বালকদের শিক্ষা ও থাকার জন্য বিবেকানন্দ বালক ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশশো বিরানব্বই সালের ডিসেম্বর মাসে শ্রী শ্রী সারদা মায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে এই আশ্রম বেলুড় মঠের সাথে যুক্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের বর্তমান সম্পাদক স্বামী অমর্ত্যানন্দ মহারাজ দীর্ঘ পনেরো বৎসর পোর্ট ব্লেয়ারে থাকাকালীন দুস্থ শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান করতেন এবং একটি পাঠাগার তৈরি করেন। মিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এখানে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। আশ্রমের নৈসর্গিক দৃশ্য খুবই সুন্দর। আশ্রমের বিপরীতে সমুদ্রের বুকে রস আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। মন্দিরে রামকৃষ্ণদেবের মর্মরমূর্তি সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সকালের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সমৃদ্ধ রামকৃষ্ণ মিশনে এখানে থাকাকালীন তিন-চারদিন যাবার সুযোগ হয়েছিল। ফিরে আসার দিনে এক অব্যক্ত বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল। এই দিন বিকেলে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের দপ্তরে যেয়ে পরবর্তী দিনগুলিতে বিভিন্ন দ্বীপে যাওয়ার লঞ্চের টিকিট এবং থাকার হোটেলের ব্যবস্থা করে ফিরে এলাম। চতুর্থ দিনে সকাল সাড়ে নটায় সরকারি ফেরি লঞ্চ আমাদের নিয়ে যাবে হ্যাভলক দ্বীপে। ওখানে 'ডলফিন রিসর্টে' একদিন থেকে পরের দিন সকালে নীল দ্বীপে যাওয়া। সেই মতো পোর্ট ব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটি থেকে নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে আমাদের লঞ্চ বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশির উপরে রাজহংসীর মত সাঁতার দিয়ে ডলফিনকে সাথী করে ৪১ সামুদ্রিক নটিক্যাল মাইল পেরিয়ে দুপুর দেড়টায় হ্যাভলক জেটিতে যেয়ে পৌঁছালো। এই প্রসঙ্গে হ্যাভলক দ্বীপ সম্বন্ধে পাঠকের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য পরিবেশন করছি। স্যার হেনরি হ্যাভলকের নামানুসারে দ্বীপের নাম হয়েছিল হ্যাভলক দ্বীপ। পরবর্তীকালে বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী হ্যাভলক দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে স্বরাজ দ্বীপ নামকরণ করেছেন। ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট দ্বীপটি নারকেল বীথি, গভীর অরণ্য ও কৃষি জমিতে ব্যাপ্ত। দ্বীপটি লম্বায় ১৮ কিলোমিটার এবং চওড়াতে ৮ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুসারে দ্বীপের জনসংখ্যা ৬৩৫১ জন, শিক্ষিতের হার শতকরা ৮৫ জন। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি এবং শীতকালে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৪ সালের সামুদ্রিক ঝড় সুনামিতে অবশ্য দ্বীপের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছটি গ্রাম নিয়ে হ্যাভলক দ্বীপ গঠিত। এগুলি হল - গোবিন্দ নগর, বিজয়নগর, শ্যামনগর, কৃষ্ণনগর এবং রাধানগর। হ্যাভলক দ্বীপ তার সমুদ্র সৈকতের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। এখানের তিনটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্র সৈকত হল রাধানগর, এলিফ্যান্ট এবং কালাপাথর। কৃষিজ উৎপাদিত ফসল হলো ধান এবং তৈলবীজ। এছাড়াও এখানে প্রচুর পরিমাণে ডাব, নারকেল, আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, সবেদা, কাজুবাদাম ও কলার চাষ করা হয়। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে সমতল ভূমিতে ফুল ও সবজির চাষ করা হয়। জঙ্গলে বিভিন্ন ঔষধি গাছ দেখা যায় এবং মৌমাছি পালন করা হয়। এক কথায় বলা যায় হ্যাভলক দ্বীপ বসবাসের পক্ষে খুবই সুন্দর। অবশ্য তাঁর পুরো কৃতিত্ব প্রাপ্য এই দ্বীপে পুনর্বাসন প্রাপ্ত বাঙালী শরণার্থীদের। জেটি থেকে একটি অটো করে আমরা ডলফিন রিসর্টে যেয়ে পৌছালাম। আমাদের জন্য যে কটেজটি দেওয়া হয়েছিল সেটি দ্বিতল বিশিষ্ট। নিচের তলায় কোন ঘর নেই। কয়েকটি স্তম্ভের উপরে দ্বিতল কটেজটি অবস্থিত। চারিদিকে বিভিন্ন গাছে আবৃত। কটেজের থেকে সমুদ্রের মোহময়ী রূপ দেখা যাচ্ছিল। জলের রং প্রথমে হালকা নীল তার পরে গাঢ়, এর পরের ধাপে কালো এবং সবশেষে তূঁতে নীল বা পান্না নীল দিকচক্রবালে যেয়ে নীল আকাশের সাথে মিশে গেছে। কটেজ থেকে সামান্য দূরে খাবারের জায়গা বা ডাইনিং হল। দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা অটো করে ১২ কিলোমিটার দূরের রাধানগর সমুদ্র সৈকতে যেয়ে শ্বেতশুভ্র অর্ধবৃত্তাকার বালুকাবেলায় পৌঁছে দেখতে পাচ্ছি অগণিত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভীড়।
পরবর্তী অংশ একাদশ পর্বে
0 Comments