জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৯ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৯ 
সালেহা খাতুন 

মোসলেমার অতো কম বয়সে বিয়ে হওয়া যে বাল্যবিবাহ আর তা নিয়ে যে আন্দোলন আক্রমণ চলছে সমাজে তা আমার মাথায় ঢোকার মতন বয়স তখন হয়নি। এগারোয় পা দিলেও দেহমন বিকশিত হয় নি তখন পর্যন্ত। স্কুল থেকে ফেরার পথে নতুন বউ দেখতে চলে গেলাম মোসলেমার শ্বশুরবাড়ি। আসলে মোসলেমার বড়ো জা বাবার ছোটো মামিমার বড়ো মেয়ে, আমরা ডাকি আসিয়া ঝিমা নামে। পিসিকে আমরা ঝিমা বলি। তাঁর সূত্রেই ওদের বাড়ি গেলাম। আমার নিমন্ত্রণ ছিল না ঐ বিয়েতে। পাশাপাশি দুজন নতুন বউ দেখলাম। আবদুল্লা চাচা আর আলকাশ চাচা দুজনের একই সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। বিয়েটার প্ল্যান প্রোগ্রাম শুধু আবদুল্লা চাচারই ছিল। হঠাৎ যোগ হয়েছে দ্বিতীয়টি।
পাড়ার সবাই এই বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে বলাবলি করছিল যে অমন সুন্দরী মেয়ে হাতছাড়া করতে চায় নি বলেই এই বাল্য বিবাহ। আবদুল্লা চাচার বউ বয়সে অনেকটা বড়ো এবং গা ভর্তি গহনা আর আমার বন্ধু মোসলেমার পরণে একটি লাল বেনারসি আর একটি সোনার নথ মাত্র। হাতে লালচুড়ি। রাগী রাগী মুখ করে বসে আছে। শুনেছি সন্ধ্যায় বেনারসি খুলে দিয়ে ফ্রক পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে গেছে।
 সে সময় মনে হয়েছিল যাক বাবা আমি সুন্দরী হইনি একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পেলাম। বুঝতাম না এর পিছনে ধর্ম-অর্থনীতি-মন-মানসিকতা অনেক কিছু কাজ করে। সর্বোপরি মা যদি শিক্ষিত হন পরিবারের অনেক নিপীড়ন সহ্য করেও তিনি মেয়ের হয়ে দাঁড়াতে পারেন। মেয়ের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেন।
🍂

ক্লাস সিক্স থেকেই আমাদের স্কুলে একমাত্র দিদিমণি মাননীয়া লীলা সামন্ত মহাশয়া আমাদের সেলাই-ফোঁড়াই বিভিন্ন হাতের কাজে পারদর্শী করে তোলেন। সেলাইয়ের নাম নিয়ে মতদ্বৈধতা হলেই আমাকে বলতেন “ তোর মা নিশ্চয়ই এই নাম বলেছেন না”? মায়ের বিয়েতে বলা ভালো বাবা-মার বিয়েতে দিদিমণি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আর পরে আমার বিয়েতে এসে বলেছিলেন “ তোর বাপের বিয়েতে এসেছিলাম আর তোর বিয়েতেও এলাম”। দিদিমণি পালি ভাষায় মাস্টার্স করেছিলেন। ভালো গান গাইতেন। স্কুলের যে কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের রিহার্সাল দেওয়া, সংগীত পরিবেশন করা তিনি নইলে চলতো না। স্কুলে দিদিমণিকে একদিনও একই শাড়ি পরে আসতে দেখিনি। আমরা বন্ধুরা বলতাম “ দিদিমণি নিশ্চয়ই শাড়ি ভাড়া করে পরেন”। এখন মনে পড়লে হেসে ফেলি। তখন আমাদের স্কুলে চোদ্দো জন মাস্টারমশাই এবং একজন মাত্র দিদিমণি। কিন্তু দিদিমণির শাসনে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই থাকতেন।
ক্লাস সিক্সে ছোট্ট নকশি কাঁথা, রুমাল এবং উলের জ্যাকেট বুনিয়েছিলেন। পরীক্ষায় রীতিমতো নম্বর পেতে হতো। সেই ছোট্ট কাঁথাখানা বাবার ধুতি কেটে বানিয়েছিলাম রান সেলাই দিয়ে। ইংরেজির মাস্টারমশাই রামবাবু রাগ করে বলেছিলেন “এতো সুন্দর সেলাইটা তুই পচা ধুতিতে করলি”? কিন্তু আশ্চর্য সেই কাঁথাটি মা এখনও যত্ন করে রেখেছেন। উলের জ্যাকেটটিও আছে।
ক্লাস সেভেনের ক্লাস টিচার ছিলেন দিদিমণি। একদিন কোনো কারণে তিনি আসেন নি। আমার বাবা মাননীয় আব্দুল ওয়াদুদ মহাশয় সেই ক্লাসটি নিতে এলেন। রোল কলের সময় প্রথমেই আমার নাম আসতো। রোল নম্বর ওয়ান বলতেই আমি ইয়েস ম্যাডাম বললাম। ক্লাসে হাসির রোল উঠলো। বাবা খুব রাগী টিচার, সবাই ভয় পায়;আমিও। কিন্তু সেদিন বাবা বলে উঠলেন “ কি রে বাবাকে মা বলছিস?” বন্ধুরা সাহস পেয়ে আমাকে ক্ষ্যাপাতে লাগলো। স্কুলে বাবাকে স্যার-ই বলতাম। আমার দুষ্টু বন্ধুরা একবার বললো “তোর বাবাকে যদি স্কুলে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে পারিস তাহলে তোকে আমরা তোকে একটা পেন উপহার দেবো”। উপহারের লোভেই শুধু নয় বাল্য বয়সের চপলতায় স্কুলের বারান্দায় বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আব্বা বলে হাঁক দিলাম। বাবা বললেন “এক থাবড়া দেবো”।
আমার বেঁধে বেঁধে থাকার অভ্যাস ছোটো থেকেই ছিল। দাদিমা চলে যাওয়ার পর ছোটো কাকিমা বাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসা থেকে শুরুর দিকে আমি তাঁর সঙ্গেই রাতে থাকতাম। সপ্তাহান্তে ছোটো কাকা কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরতেন। ছোটো কাকিমা আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি, ডাক্তারখানা যেখানেই যেতেন আমি তাঁর সঙ্গে যেতাম। ফলে ছোটো কাকিমার বাপের বাড়িতে, বোনেদের মধ্যে ‘মণি’র একটা পরিচিতি ছিল। তো সেই মণির ভাগ্যে প্রথম একটা শিকে ছিঁড়লো। ক্লাস সেভেনে প্রথম রাজ্যের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ এলো ছোটো কাকার হাত ধরে। ছোটোকাকা কাকিমা ও সোহাগের সঙ্গে গেলাম রাঁচি-নেতারহাট-হুড্রু ফলস।
( ক্রমশ )

Post a Comment

0 Comments