জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৩ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ৩
বিজন সাহা 


পথে এবার নাম সখা  

দেমিদ আমাকে নামিয়ে দিল বাসার সামনে। আমাদের মিটিঙের সময় গুলিয়া চেষ্টা করছিল নিজের গাড়িতে যাচ্ছে এমন কারও সাথে ক্রিমিয়ায় চলে যেতে। আমিই চেষ্টা করছিলাম তেমন একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। বাসায় ফিরে শুনলাম শেষ মুহূর্তে প্লেনের টিকেট পেয়ে ও কিছুক্ষণ আগে এয়ারপোর্টে চলে গেছে। সেদিক থেকে আমার দায়িত্ব একটু কমে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হচ্ছি। দেমিদ জানাল ওদের একটু দেরি হবে। তাই আমিও একটু সময় নিয়ে রেঁধে বাচ্চাদের খাইয়ে, নিজে খেয়ে ওদের অপেক্ষায় বসে রইলাম। ওরা যখন এলো ততক্ষণে বারোটা বেজে গেছে। পরে বুঝলাম শুধু ঘড়িতেই নয় আমাদের প্রথম দিনের প্ল্যানেরও বারোটা বেজে গেছে। রাস্তাঘাটে গাড়ির ভিড়। তাই যাত্রার শুরুটা যে খুব মসৃণ হবে না সেটা বোঝা যাচ্ছিল। 

ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা। ক্রিস্টিনা এখনও বাসা ভাড়া পায়নি। মনিকা আর সেভাকে বললাম  ওকে সাহায্য করতে। ভাগ্যিস এখন ইন্টারনেটের যুগ, না হলে হুট করে চলে যাওয়া সম্ভব হলেও এতটা সহজ হত না। দেখতে দেখতে নভদেভিচি মনাস্তেরি চোখের আড়ালে চলে গেল, চোখের আড়ালে চলে গেল মস্কো সিটির আধুনিক স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো। এগুলো নিয়ে মস্কভিচ বা মস্কোবাসীদের এক ধরণের এলার্জি আছে। যদিও এই সব আধুনিক স্থাপনা মস্কোকে আধুনিক সাজে সজ্জিত করে তবে স্থানীয়দের মতে এটা মস্কোর ঐতিহাসিক চেহারার সাথে মানানসই নয়। এই বিতর্ক প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু এখন হয় অভ্যাসের কারণে অথবা আর কিছুই করা যাবে না এ কারণে লোকজন আর তেমন কিছু বলে না। তাছাড়া সব মিলিয়ে জায়গাটা সব দিক থেকেই দেখার মত, ফটোগ্রাফারদের প্রিয় জায়গা। আমার ধারণা মস্কো সিটি ইতিমধ্যেই রেড স্কয়ার, ভাসিলি ক্যাথেড্রাল, লেনিনের সমাধির মত মস্কোর অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে। 

বছরের ঠিক এই সময়ে লোকজন মস্কো থেকে বেরুতে শুরু করে। সেটা টের পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। হাজার হাজার গাড়ির কাফেলা চলছে উপশহরের দিকে। মস্কোর অন্যতম ব্যস্ত রাস্তার একটা এই মস্কো পিটার্সবার্গ রোড। কখনও দ্রুত, কখনও শম্বুক গতিতে এগিয়ে চললাম আমরা। দেমিদ গাড়ি চালাচ্ছে, ওর পাশে বসে আছে দিলীপ। আমি পেছনের সীটে। যদিও দেমিদ ইংরেজি বলতে পারে তারপরেও আমাদের কথা হচ্ছিল কখনও রুশে, কখনও বাংলায় আর মাঝেমধ্যে ইংরেজিতে। আর সেটা নির্ভর করছিল আমাদের কথার বিষয়বস্তুর উপরে। কথায় কথায় জাহীদের কথা উঠল।
জাহীদের সাথে তোমার যোগাযোগ আছে? – দিলীপ জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। কথা বলবে নাকি?
বলা যায়।
আমি জাহীদকে ফোন করলাম। ব্যস্ত ছিল হয়তো। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ভোলগার উৎসের দিকে। এমন সময় জাহীদের ফোন এলো।
কেমন আছে বিজন দা?
জানই তো আমার একটাই অপশন - ভালো থাকা। খারাপ থাকার সামর্থ্য কোথায়? 

দু’ জনেই হাসলাম কিছুক্ষণ।        

শোন, একজন লোকের সাথে কথা বল। তোমার পরিচিত। 
দিন।
জাহীদ সাথে সাথেই দিলীপকে চিনতে পারল। শুরু হল স্মৃতিচারণ। দিলীপ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভ্রমণের প্ল্যানও জানালো জাহীদকে। আমার ধারণা অনেক দিন পরে জাহীদের সাথে কথা বলতে পেরে দিলীপ নিজেও খুব খুশি হয়েছিল। 

রাস্তার দু’ ধারের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম লক্ষ্যের দিকে। বিশাল দেশ এই রাশিয়া। আমাদের সব দেশে যদি বিভিন্ন গ্রাম বা শহর বা জনপদের মাঝে এক চিলতে মাঠ বা বন দেখা যায় তবে এদেশে শুধু মাঠের পর মাঠ, বনের পর বন আর তার ফাঁকে ফাঁকে কখনও কখনও ছোট্ট কোন জনপদ, কখনও বা শহর। আমাদের ইচ্ছে ছিল আজই ভোলগার উৎস দেখে তভের ফিরব। কিন্তু এ যেন অন্তহীন পথ। যদিও এখন সূর্যডুবি হয় সাড়ে দশটায় তারপরেও মনে হল রাতে আমাদের আর তভের ফেরা হবে না।  

আমি দেমিদকে ইশারায় বললাম এ নিয়ে কথা না বাড়াতে। কেননা ভোলগার উৎস নিয়ে দিলীপের খুব বেশি  আগ্রহ ছিল না। যদি ও জানে যে সেখানে গেলে মূল জার্নি একদিন পরে শুরু করতে হবে তবে বেঁকে বসতে পারে। কিন্তু আমার ইচ্ছে এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে দেমিদকে সাথে নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র করতে হল। আমরা ইতিমধ্যেই মস্কো রিজিওন থেকে তভের রিজিওনে চলে এসেছি। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম তভেরের রাস্তা ডান দিকে চলে গেছে। আরও সামনে তরঝক। আমাদের যেতে হবে তরঝকের দিকে। তবে ইতিমধ্যে আমরা ঘণ্টা তিনেক ড্রাইভ করেছি। হাল্কা খিদেও পেয়েছে। তাই রাস্তার পাশে কোন রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে ঢুকে খেয়ে নিলাম যাতে    দেমিদ ঘণ্টা খানেক রেস্ট নিতে পারে। আমরা প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম দিনে ছয় ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ করব না। 

এখনও পর্যন্ত আমাদের জার্নি ছিল সোজা উত্তর দিকে। তভের আসলে মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাবার পথে। এ নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। আমরা যাচ্ছি আরও উপরে। সেখানে বিখ্যাত সেলিগার লেক আর তারও উপরে ভালদাই মালভূমি। এই ভালদাই মালভূমি থেকেই ভলগার শুরু। আছে ভালদাই নামে এক লেক আর জনপদ। ইদানিং কালে এই ভালদাই শহরে বিভিন্ন ফোরামের আয়োজন করা হয় বিধায় রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক মহলে এটা একটা পরিচিত নাম। তবে সেখানে যেতে হলে আমাদের আরও অনেকটা পথ পেরুতে হবে। পথে পড়বে তরঝক নামে এক প্রাচীন শহর। সেখান থেকে আমরা যাব অস্তাশকভ বলে আরও একটা জায়গায়। সেই অস্তাশকভ থেকে শুরু হবে মেঠো পথ বন বাদারের ভেতর দিয়ে যা আমাদের নিয়ে যাবে ভোলগার উৎসে। আমার ধারণা ইচ্ছে করেই এই রাস্তাটুকু অনেকটা অবহেলা ভরে রাখা হয়েছে যাতে ট্যুরিস্টরা দল বেঁধে ভোলগার উৎসে না যায়, পরিবেশের ক্ষতি না করে। 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
অস্তাশকভ, সেলিগার এসব নামগুলো আমার পরিচিত। মনিকা আর ক্রিস্টিনা যখন ছোট ছিল ওরা একটা ফ্যামিলি গ্রুপের সাথে এখানে আসত দুই তিন সপ্তাহের জন্য। তখন অনেক বার মনে হয়েছে এসব জায়গায় আসতে। তবে তাবুতে থাকা, ভলেন্টিয়ারের কাজ করা, নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া – এসব করতে পারব কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। তাই এখন এসব জায়গা দেখার সুযোগ পেয়ে মন উত্তেজনায় ভরে উঠছিল। যদিও অপরিচিত তবুও মনে হচ্ছিল কত পরিচিত জায়গায় যেন যাচ্ছি। এটা অনেকটা ১৯৮০ সালে বাসে করে কোলকাতা থেকে বহরমপুর যাবার মত। পথে পলাশীর নাম যখন দেখলাম নিজের অজান্তেই সেই ১৭৫৭ সালে চলে গেলাম। যেন ইতিহাসের পাতা থেকে সিরাজ আর ইংরেজ সেনারা বেরিয়ে এলো। আসলে যে নামগুলো কোন না কোন ভাবে মনে গাথা হয়ে যায় – সেসব দেখলে মনে এক ভিন্ন রকমের অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তখন মানুষ আর অবজেক্টিভ থাকতে পারে না, সে সাব্জেক্টিভ হয় – তার দেখাও হয় অনেক বেশি আবেগপূর্ণ।  

উল্লেখ করা দরকার যে এসব এলাকায় গ্রীষ্ম সরকারি ভাবে জুন, জুলাই আর আগস্ট হলেও ১৫ জুনের আগে ও ১৫ আগস্টের পরে তাপমাত্রা রাতে এমনকি মাইনাস হতে পারে। তাই রাস্তার দু' ধারে বনবাদাড় প্রচুর থাকলেও শস্য খুব একটা দেখা যায় না। তাই আমাদের দেশের যেমন এরকম ভ্রমণের সময় রাস্তার দুই ধারে বিভিন্ন ফসলের হাসি দেখা যায় রাশিয়ার উত্তরে সেটা নেই বললেই চলে। সোভিয়েত আমলে অবশ্য তভের এলাকায় অনেক নামকরা কালখোজ ও সাবখোজ মানে যৌথ খামার ছিল। বর্তমানে সে সব শুধুই ইতিহাস। রাস্তায় কখনও কখনও সেসব খামারের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মাঝে মধ্যে নতুন গজিয়ে ওঠা খামার যে একেবারে চোখে পড়ে না তা নয়। তবে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটের জাঁকজমকের কাছে ওরা এখন হার মানে। 

Post a Comment

0 Comments