জ্বলদর্চি

কালিম্পং ডায়েরি/পর্ব - ৫/সুমিত্রা মাহাত

কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব - ৫
সুমিত্রা মাহাত
 
সমতল ছেড়ে বাস উর্ধ্বমুখী । ওঠার সময় বাস পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকে- বেঁকে চলেছে । কিছুটা ওঠার পর একজায়গাতে রাস্তা কিছুটা চওড়া , জানিনা কেন গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়। ঝালমুড়ি নিয়ে একজন গাড়িতে ওঠেন। অপ্রত্যাশিত পাহাড়ি ঝাল মুড়ির স্বাদ নিতে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে । ছোট ছোট গোল গোল মুড়ির সাথে মেশানো সমস্ত টাটকা উপকরণ এক অনবদ্য  স্বাদ এনে দেয় । গাড়ি এগিয়ে চলে। এবার শুধুই মুগ্ধতার পালা । রাস্তার দুদিকে ঘন বন । এটা বেঙ্গল সাফারি , এখানে পার্ক ও অভয়ারণ্য রয়েছে। বন্য পশুর একেবারে উপযুক্ত জায়গা। ঝলমলে আলোয় ধোওয়া মায়াবী পাইন বন সমস্ত দৃষ্টিশক্তি হরণ করে নেয় । উৎসাহী জনতা ফটো তোলার তাড়নায় পারলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। একজন মন্তব্য করে, "এবার মন খারাপ হলে পাহাড়ে চলে আসতে হবে ।"
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
পাহাড়- প্রকৃতির অদ্ভূত রূপ বৈচিত্র্য, নৈসর্গিক নিস্তব্ধতা , কুয়াশা ভরা নরম মেঘ শীতলতায় প্রাণ ভরে দেয় । আমি রাঢ় অঞ্চলের মানুষ , তবু যে গাছ গুলো আমি চিনতে পারছি তার মধ্যে রয়েছে পাইন , শাল , করম , কলা , কেয়া ইত্যাদি । কুয়াশা ভেজা শীতল আবহাওয়াতে সমস্ত গাছের পাতা , তরতাজা, সতেজ ও গাঢ় সবুজ। তার উপর নরম সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে । খাদের দিকে বাঁকে বাঁকে গুচ্ছাকারে কেয়া গাছ  । পাতা ঘন সবুজ , কিনারা কাঁটাযুক্ত । গাছে যখন ফুল ফোটে তার সুগন্ধ সুবিস্তৃত অঞ্চলের নাগরাজকে মোহিত করে কিনা কে জানে ! সর্বংসহা সুদীর্ঘ পাইন গাছগুলো দেখার মতো । গাছের উপর ঘন পুরু শ্যাওলার স্তর , তার  উপর  দিব্যি রাজত্ব করছে ফার্ণ ও অর্কিডের দল । যে ফার্ণ ও অর্কিড পাওয়ার জন্য আমরা নার্সারি দাদার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলি তা এখানে জন্মগত ভাবে বেড়ে উঠেছে। কোনও টাতে দোদুল্যমান ফুলের স্টিক । শালগাছগুলোর পাতা যেন রাঢ় অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট , অবশ্য আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি কিনা বলতে পারব না। প্রবল উত্তেজনায় দীর্ঘ বনাঞ্চল অতিক্রম করি । কোথাও কোথাও খাদের দিকে অথবা পাহাড়ের গায়ে ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে। পিচ রাস্তা। খুব ভালো না হলেও মোটামুটি। খাদের দিকে ঘর- বাড়ি গুলো রাস্তার  সঙ্গে বালি,সিমেন্ট দিয়ে সাঁটানো থাকলেও ,খাদের দিকে নড়বড়ে পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে, কাঠ অথবা সিমেন্ট - এর বাড়ি। সামান্য ভূমিকম্প হলেও   হুড়মুড়িয়ে সব ভেঙে পড়বে। এভাবে তো রাত্রিতে শান্তিতে ঘুমানোও মুশকিল। সর্বদা অনিশ্চিত, পরিবর্তনশীল, সুন্দর ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির সঙ্গে সহবাস করতে করতে এখানকার মানুষজনও হয়ে উঠেছে ধারালো ,সাহসী ও দুর্দমনীয়। তারা কিছুতেই হার মানবে না। আবার তারা পরস্পর সরল মন ও একতার বন্ধনে আবদ্ধ। তা না হলে রহস্যময় প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে পারবে না। প্রকৃতি ভয়াল রূপে দুয়ারে দাঁড়ালে মিলিত ভাবে তার মোকাবিলা করতে পারবে না । বিভিন্ন পয়েন্টে নানা আকারের জেসিবি দাঁড়িয়ে আছে, একজায়গাতে মাটি ধ্বসে পড়ে আছে একপাশে। একটু আগেই ধ্বস নেমেছিল, জেসিবি দিয়ে সরানো হয়েছে। দেখে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। গাড়ির গতি যথেষ্ট, বাঁকগুলোতে যেভাবে টার্ন নিচ্ছে, ভয়ে জড়োসড়ো সকলে। এরকম জার্নি তে আমরা অভ্যস্ত নই। 
রাস্তার সাথে হাতে হাত রেখে, ঝমঝম মল বাজিয়ে ঝরঝরিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দরী তিস্তা । কোথাও গভীর জল , আবার কোথাও ছবির মতো সুন্দর নুড়ি, পাথর দিয়ে সাজানো বালির চর। কোথাও সবুজ বনানী ডালপালা মেলে স্পর্শ করেছে তাকে। তিস্তার ডান দিকেও থরে থরে সাজানো পাহাড় , তাতে ঘরবাড়ি ও গাছপালার বৈচিত্র্য পরিষ্কার চোখে পড়ছে। বামদিকে পাহাড়ের কোলঘেঁষে বাড়িগুলো ছবির মতো সাজানো।
ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর বাড়িগুলো, সেখান থেকে সিঁড়ির ধাপ রাস্তা পর্যন্ত নেমে এসেছে। সিঁড়িগুলোতে কোন কৃত্রিমতা নেই, ঘষে মেজে মার্বেলের মসৃণ রূপ ফুটিয়ে তোলার কোন বাহুল্য নেই। খসখসে কালো পাথর ধাপে ধাপে কেটে তৈরি। নিরিবিলি নৈসর্গিক পরিবেশে রঙ বে রঙ এর ছোট ছোট ঘরবাড়ি গুলো যেন রঙ্গীন প্রজাপতি ডানা মেলে রোদ পোহাচ্ছে। প্রকৃতির কোলে এমন সরল জীবনযাত্রার হাতছানি বড়ই প্রবল। প্রতিটি বাড়ি থেকে মরসুমী ফুলের ঢল নেমে এসেছে রাস্তা পর্যন্ত। হয়ত এখন ফুলের সিজ্ন তাই বাড়ির চারপাশ আলো করে ফুটে আছে। শীতকালীন ফুলের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য পাওয়ার জন্য আমরা শখের বাগানী রা কতরকমের প্রস্তুতি নিই সারাবছর ধরে তার পরেও ব্যর্থ হই। আর এখানে পাথুরে পাহাড়ের ঝুরঝুরে পলিমাটির ওপর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে বাহারী শীতের ফুল। বসন্তের আমেজে, নরম আদ্র আবহাওয়াতে কি তাদের রং,রূপের ছটা! আমাকে আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট! কোথাও মিঠে হলুদ রং এর ন্যাস্টারসিয়ামের ঢল নেমেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যান্টেনিয়াম, টকটকে লাল রং এর লিলি। ইমপ্রেশন  তো চারিদিকে আগাছার মতো ছড়িয়ে রয়েছে , গোলাপী,লাল, সাদা নানান রং এর। জায়গায় জায়গায় মেক্সিকান সানফ্লাওয়ার ,এতে অবশ্য ফুল নেই, মনে হয় ফুটে শেষ হয়ে গেছে। পাহাড়ী ধুতুরা এক অনবদ্য সংযোজন। ঝোপালো গাছ গুলিতে প্রায় পঞ্চাশ একশোটা ফুল মাটির দিকে মুখ করে ঝুলে রয়েছে। একহাত এর কাছাকাছি ফুল গুলো। কি তাদের রং ! কোথাও ধবধবে সাদা তো কোথাও মিষ্টি হলুদ বা গোলাপী। কম-বেশি প্রায় সমস্ত ঘরবাড়ি গুলিই শীতের ফুলের রঙীন ফ্রেমে সাজানো। গৃহস্থ শৌখিন নাকি প্রকৃতি অকৃপণ বুঝতে পারি না। প্রকৃতির প্রশ্রয় যে কিছুটা আছে তা গাছ গাছালির অফুরান বাড় বাড়ন্ত দেখলেই বোঝা যায়।
সমতলের মানুষ পাহাড়ে আসলে তাদের সমস্যার শেষ থাকে না। আমরা ভয়ার্ত মাতৃকুল বাচ্চাদের আগেই বমির ওষুধ গিলিয়েছি,তবুও শেষ রক্ষা হয় না। স্যারের ছেলে হাত - পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়,সে শুধু বাস থেকে নেমে যেতে চায়। তাকে আটকানো মুশকিল। ড্রাইভার কে অনুরোধ করে চওড়া রাস্তার বাঁকে বাস থামানো হল। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে তবে সে শান্ত হয়। এখানেও একফালি উপত্যকা। গাছ পালার ফাঁকে উঁকি-ঝুঁকি মারছে রুম ঝুম তিস্তা নদী। পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে সাঝানো রঙীন ঘড়বাড়ি। আমি গুনগুন করতে থাকি....
"পাহাড়ের গায়ে 
কেউ ঘর বাঁধি
কারো , সমতলে বাসা 
একই তো মানুষ আমরা 
বুকে একই ভালোবাসা।

একই পোশাক হয়ত আমরা পরি না 
একই ভাষায় হয়ত আলাপ করি না 
একই তবু যে তোমার আমার 
হৃদয়েতে ভরে থাকা কত ভাষা।"
বহুদিন আগে দেখা 'বাহাদুর ' সিনেমার বিখ্যাত সেই গান মনের মধ্যে দোল খেতে থাকে। 
ইতিমধ্যেই কৌতূহলী যাত্রার প্রায় পঞ্চাশ ভাগ কভার করে ফেলেছি। আরও প্রায় দেড় ঘন্টা মতো বাকি।

Post a Comment

1 Comments

  1. বেশ উপভোগ্য,
    এক অন্য রকম অনুভূতি।

    ReplyDelete