সোমদত্তা
"এ আমার দেশ নয় তো কার দেশ বলো " ---আমার দেশ, আমার বাংলা, চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য আর সাবেকীয়ানা। আছে প্রাচীন থেকে প্রাচীন তর সব স্থাপত্য, মন্দির , মসজিদ , বৌদ্ধ স্তুপ, রাজারাজড়াদের তৈরি নানা কীর্তি। কিছু আজ ধ্বংসস্তুপ , কিছু আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজো সজীব।
আর আমি ---আমার গল্প তো এক পাতার, কে জানে , কে মনে রেখেছে আমায়, কে আসে আমায় দেখতে? মেদিনীপুরের পশ্চিম দিকে র এক কোণায় কেশিয়ারী আর বেলডা গ্রামের মাঝখানে গগনেশ্বর গ্রামে দাঁড়িয়ে আছি আমি ---কুরুমাবেদাগড়। ASI ( আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ) আমার নামটাই বদলে দিল, অস্বিত্ত্বের সঙ্কট, বেঁধে ফেললো আমায় গ্রিল আর আধুনিক ইঁট সিমেন্টে, কোনক্রমে টিকে থাকার লড়াই আমার। চলো, আজ তোমাদের আমার গল্প বলি বরং। আজ আমি কুরুম্বেরা ফোর্ট।
তখন কলিঙ্গ রাজ গঙ্গাসাম্রাজ্যের শেষ রাজা ভানুদেব চার এ স্থানে বর্তমান। ১৩০০ শতাব্দীর শেষ, তৈরি করলেন আমায়, হলাম রাম-সীতার মন্দির। আমাকে ঘিরে থাকলো চার নদী , কংসাবতী, কালাঝিরা, কেলিয়াঘাই, আর ডুলুং।চারিদিকে জঙ্গল, গোদাপাইশাল,আহারমুদ,চন্দনা,আংঘেরি,সুকনিবাসা,কেশেভোলা,লোধাসুলি,ঝিটকা,যার কিছু টা আজো রয়ে গেছে।
আসি এর পরের অধ্যায়ে,---ত্রিকালিঙ্গ রাজত্বের গজাপতিরাজ কপিলেন্দ্রদেব রৌত্রে এলেন তাঁর জয়ধ্বজা উড়িয়ে। পরাজিত করলেন ভানুদেব কেভ।স্থাপন করলেন সূর্যবংশ গজাপত সাম্রাজ্য, সেটা ১৪৩৪ খ্রী:।১৪৩৫ এ তিনি ভুবনেশ্বরের রাজা হলেন, হাতে নিলেন কপিলেশ্বর পুর ও দামোদর পুর। রওনা দিলেন গৌদার দিকে। সঙ্গে নিয়ে এলেন কুকাইদের, যারা রাজস্থানি বংশভুত। আজো তাদের বাস আমার কেল্লার পেছনের গ্রামে । তারা আজো পরিধান করে রাজস্থানি পোশাক , লৌহ নির্মিত নানা জিনিস ,আর রূপদস্তার গয়না তৈরি যাদের পেশা।রাজ্য নেই, রাজা নেই, রয়ে যায় সাধারণ মানুষ।
কপিলেন্দ্রদেব নতুন করে সাজালেন আমায়, তৈরী করলেন সপ্তরথ শিবমন্দির, উচ্চতা ৬০ ফিট।উড়িয়া রেখাদিউল স্থাপত্যকলার অনুকরণে। এর অদ্ভুত এক স্থাপত্য তলোয়ার ধারী শিবলিঙ্গ। মাটির নীচে আজো বর্তমান। ASI যার ছবি প্রকাশ করে। ১৪৩৮ থেকে ১৪৬৯ অব্দি আফগানদের হাত থেকে আমায় বাঁচাতে চারিধারে তৈরি করলেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। চার নদী থেকে জল এনে বানালেন পরিখা।আমাতে তৈরি হল এক কুঁয়ো, যোগেশ্বর কুন্ড,সেখান থেকে গুপ্ত পথ চলে যায় রাইবেনিয়া দুর্গে।আমাকে ঘিরে বসতো চতুষ্পাঠী।বেদান্ত পাঠের গম্ভীর মন্ত্রোচারন আমার দেওয়ালে দেওয়ালে ধ্বনিত হত। ১৪৬৭ তে মানসিক বিকারগ্রস্থ অবস্থায় কৃষ্ণা নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করলেন কপিলেন্দ্রদেব। রাজা হলেন তাঁর পুত্র পুরুষোত্তম দেব। শেষ হলো একটা অধ্যায়।
এরপর এলো প্রলয় , আছড়ে পরলো আমার উপর, বাঁচলাম না আমরা কেউ ই। পঞ্চাদশ শতাব্দীর শেষ, ১৫৭৫---আকবর প্রেরিত মহিম খান আর দাউদ খান মোঘলমারী হয়ে এসে পৌঁছালো। যে পথ দিয়ে তারা এলো সে পথ আজো পরিচিত মোঘলমারী নামে। ৩ রা মার্চ আমার সপ্তরথ ভেঙে গুড়িয়ে দিল, ভেঙে দিল চতুষ্পাঠী, বন্ধ হলো বেদ গান। তারা চলে গেল সদর্পে।
বেশ কিছু কাল কেটে গেল নিরূপোদ্রবে।এবার দিল্লীর সিংহাসনে ঔরঙ্গজেব, ১৭০০ খ্রী:।তাঁর প্রতিনিধি হয়ে এলো আলাউদ্দিন হুসেন ২য়।সব তছনছ করে দিতে। ভেঙে দিলেন শিবমন্দির, সেখানে তৈরি হল মসজিদ। আমি নির্বাক শ্রোতার মত শুধু তাকিয়ে দেখলাম আমার খখর্বাকৃতি দেহ। আমার হারিয়ে যাওয়া চেহারা । আমার নিজস্বতা হারানোকে।ভেঙে দিলেন কপিলেন্দ্রদেবের তৈরি সব হিন্দু লিপিগুলি। আজ পরে আছে তার এক টুকরো অংশ মাত্র।
তৈরি করলেন মসজিদের উত্তরের দরজার ভেতর দিকে তিন গম্বুজওয়ালা ঘড়ি।প্রতিটি গম্বুজের উপর চারটি করে ফুটো।আর নীচে বারোটা,কাটার মাথায় বারোটা জন্তর মূর্তি। ততদিনে মোঘল সংস্কৃতিতে ছোঁয়া লেগেছে তিব্বতি চিত্রকর্মের।তিব্বতি জ্যোডিয়্যাক চিহ্ন মেনে
১, ইঁদুর
২,শুয়োর
৩,কুকুর
৪,মোরগ
৫,হনুমান
৬,ভেড়া
৭,অশ্ব
৮,সাপ
৯,ড্রাগন
১০,খরগোশ
১১,বাঘ
১২,ষাঁড়।
এই ষাঁড়ের মুখ ভূগর্ভস্থ শিবলিঙ্গের দিকে ঘোরানো।
এভাবেই আমি আজো দাঁড়িয়ে আছি । এটুকুই আমার গল্প। এভাবেই আমি আছি, ছিলাম, হয়তো থাকবো আরো কিছুকাল। আমি কি মন্দির, নাকি মসজিদ ---এর উত্তর কে দেবে। আজো গুটিকয়েক মানুষের পায়ের শব্দে মনে পরায় আমার ইতিহাস,আমার মন্দির বা মসজিদের অস্তিত্বকে। পূর্নিমার চাঁদের আলোয় বা অমাবস্যার নিশুতি রাতে আমি দাঁড়িয়ে থাকি এক প্রেতলোকের মত।
2 Comments
বাহ। খুব সুন্দর লাগলো পড়তে। অনেক কিছু জানতে পারলাম। অজানা ইতিহাস অন্য ধারায় লেখা হয়েছে। লেখার মুন্সিয়ানা বেশ চমকপ্রদ। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete