জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (ষোড়শ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (ষোড়শ পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা


ঢোলের মা ফলহারিনী কালীর কথা উঠলেই লোখার চোখ মুখের ভাব আলাদা হয়ে যায়। তর্জনীটা আঁকশির মতো বাঁকিয়ে কপালে আর বুকে তিনবার ঠুকে নেয়। মা তাদের রক্ষাকর্ত্রী। বাপ ঠাকুর্দার কাছে কত গল্প শুনেছে সে। লোখাদের কাছে সেইসব কাহিনী নিছক গল্প নয়,মায়ের লীলা। আজ থেকে আড়াইশ তিনশ বছর আগে এই মন্দির স্থাপিত হয়। সেইসময় হঠাৎ গাঁয়ে নাকি কলেরা দেখা দেয়। তখন কলেরা হলে গাঁ উজাড় হয়ে যেত। ঢোলেও সেইরকম বিভীষিকা শুরু হয়। ওলাউঠার প্রকোপে শুরু হয় মৃত্যু মিছিল। দিশেহারা হয়ে পড়ে গ্রামবাসী। ডাক্তার বদ্যি তখন  পাওয়া দুষ্কর ছিল। অসহায় গ্রামবাসী দেবতার কাছে আশ্রয় নেয়। গাঁয়ের মুখ্যা মুরুব্বিরা মিলে মা কালীর পূজা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শশী দোলই জায়গা দিতে রাজি হয়ে যায়। সেই জায়গায় তালপাতার ছাউনি গড়ে গ্রামের পাঁজজন মিলে দেবী ফলহারিনীর পূজা শুরু করে। অমন  বিপত্তি থেকে মা যাতে রক্ষা করে গ্রামবাসীদের। সেই শুরু। কিন্তু তালপাতার তৈরি মায়ের থান বন্যায় প্রতি বৎসর নষ্ট হয়ে যেত। অনেক পরে চুনসুরকির দেয়াল তুলে মায়ের মন্দির নির্মিত হয়। প্রতি বৎসব জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় মায়ের পূজা হয়। গোটা ঢোলে তখন উৎসবের আমেজ। লোখাদের কাছে এ যেন প্রাণের পূজা। মা যেন তাদের কত আপনার। বাড়িতে কুটুমবাটুম গমগম করে। সাতদিন ধরে চলে অনুষ্ঠান। মেলা বসে মন্দির চত্বরে। ঢোলের কালীপূজাকে নিয়ে ছোটবেলার কত স্মৃতি লোখার মনে ভাসে।
বছরের ওই দিনটার জন্য তারা সব ভাই মিলে অপেক্ষা করে থাকত। শুধু তারা নয় গ্রামের সব বাড়ির ছোটরাই করত। পূজার কদিন থেকেই বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে যেত। লোখার মা ফুদন তাদের গোটা বাক্স বারন্দা ঘরে গোবর দিয়ে লাতা দিত। বাবা তার ছুটত কুটুমবাটুমদের নেমতন্ন দিতে। দুগ্গাপূজায় লোখাদের নতুন জামা জুটত না। কিন্তু এই পুজায় তারা নতুন জামাপ্যান্ট পেত নিশ্চিত। মায়ের জন্য তার বাবা পছন্দ করে আনত লাল পেড়ে ছাপা শাড়ি। পূজার কটা দিন বাড়িতে কতরকম খাবারদাবার। লম্বা দুয়ারে বসত পঙ্গত। পূজার দিন বাদে বাকি দিনগুলোতে মাছ মাংস লেগেই থাকত। বিশেষ করে পূজার পরের দিন গোটা গ্রামে সবার রান্নাঘরের কড়াইয়ে থাকত মায়ের প্রসাদ। এটাই রীতি তাদের। গ্রামের সব ঝি ঝিউড়িরা চলে আসত এই সময় বাপের ঘরে।
ঢোলের মা কালীকে নিয়ে কত গল্প কাহিনী আছে।  ভগী খুড়া সব জানে। লোখা তার কাছ থেকেই সব কথা শুনেছে। মায়ের কথা বলতে শুরু করলেই ভগী খুড়ার চোখ ছলছল করে। বলে,
—- জানুরে, উ ত ঠাকুর নয়,মোদের আরেক মা। অর কথা বলতে গেলে মোর গায়ে কাঁটা দেয়। অমবস্যায় উ পূজা লেয়। তিথি কাটলে হয় ছেদ। অর সামনে সাজি দিতে হবে ষোল কুড়ি মানে এক কুন্টাল বিরানব্বই কেজি  আতব চালের নৈবিদ্যি।  ষোল ঢাকে কাঠি পড়তে হবে একসঙে। হাঁড়ি কাটে উচ্ছুগ্গু কত্তে হবে ছটা পাঁঠা।কুনু অটুটি করা যাবে নি। মা মোদের যেমন ঠান্ডা,তেম্নি রাগী। তুটি হলে ভিটামাটি চাটি কদ্দিবে।
🍂

লোখা ছোট থেকেই দেখছে এসব। কত দূরদূরান্ত থেকে মানত শোধ করতে আসে লোকজন। শতাধিক পাঁঠা বলি হয় মায়ের সামনে। দাদপুরের মধু কামারের পূর্বপুরুষরা আগে বলি দিত। এখনো তাদের বংধরেরা বলি করে। ছোটবেলায় লোখা বলির কাছে যেতে পারত না। লাল রক্তে জবজব করত হাঁড়িকাটের চারদিক। মা মা চিৎকারে মন্দির তলা কেঁপে উঠত। তার সঙ্গে ঢাকের বোল,নহবত বাজনার শব্দ,মাইকে চন্ডীপাঠ সব মিলে অদ্ভুত এক পরিবেশ। দূরে বটতলায় চলত ছেলে বুড়োদের নাচ। কৃষ্ণবর্ণা আয়ত নয়না মায়ের মুখ থেকে তখন যেন এক আশ্চর্য জ্যোতি ঠিকরে বেরোত। মায়ের অমন রূপ আর কোথাও দেখা যাবে না। ভগী খুড়া বলে,
— আগে মায়ের মুত্তি গড়ত পুবের শীতল পন্ডিতের পুব্বাপুরুষ। মায়ের মুখের কুনু ছাঁচ নাই। ওই আদল হাতেই গড়তে হয়। পরে ত মোদের ঢোলের ছ্যানাই গড়ে। অকে শিখিছে অই পন্ডিতরাই। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বেদীতলা থিকে মাটি তুলতে হয়। তাও যে সে তুললে পারবে নি মাটি । পুবের মিশ্ররাই তুলতে পারবে। সেই মাটি দিয়েই মায়ের অমন রূপ গড়া হবে। পাশে রাখতে হবে ডাকিনী যোগিনী আর জয়া বিজয়াকে। সেই পথম থিকেই মায়ের পুজক কিন্তু কিশোরপুরের সতীশ চক্কবতীর বংশধররা। তাদেরি ত যজমান মোদের গটা ঢোল।
—-মোদের ঢোলের মাকে লিয়ে মাস্টারকে একবার অনেক কথা জিগ্যাস করেছিলম,জান ত। মানে একদিন আঘড়ায় ইসব লিয়ে আলচনা হইছিল ত সেইজন্ন।
—-তোর ত সবেই উসকিয়ে জানার স্বভাব। তা কি জিগ্যাস করেছিলু শুনি।
—--  মোদের মাকে ফলহারিনী শ্মশানকালী কেনে বলে? তবে ই পশ্নটা মোকে কত্তে বলেছিল কিস্ট দাস।
—--ত মাস্টার কী উত্তর দিল?
—--- তখনি সে বলতে পারে নি। বল্লে,তুই ভাল কথা জিগ্যাস করেচু। তোকে পরে বলব। বলে মাস্টারের  মাস্টার উমানাথ বাবুর কাছে জেনে পরে  বলেছিল।
—--কী বলেচে সেটা ত বল।
—--- বল্লে, আগে ত কলেরা বাজ্জবমি হয়ে গেরাম উজাড় হই যেত। শশানে সই জ্বলা বন্ধ হত নি। সেইজন্ন গেরাম যাতে শশানপুরী না হই যায়, মা যাতে গেরাম ঘেরে আগলে রাখে, তাই মায়ের  শশানকালী নাম হইচে। আর ফলহারিনী মানে ফল হরণ করা নয়। মা নাকি কীসব চারবর্গের ফল আহরন করে তার ছ্যানাদের দেয় বলে ফলহারিনী মা কালী। মোর কী  বেশিদূর লিখাপড় আছে যে অতসব বুজব।
—--উমানাথ ঠাকুরকে চিনি। বড় গেনি মানুষ রে। তার বিচারধারা মিথ্যা লয়। মাস্টারকে জানু এইজন্ন খুব আশীব্বাদ করি। গেরামকে লিয়ে,গেরামের সবকিছুকে লিয়ে কত চিন্তা ভাবনা করে। লিখাপড়া করে। মা যেন মাস্টারকে ভাল রাখে। 
বলেই হাত জোড় করে কপালে ঠেকায় ভগীরথ খুড়া। দেখাদেখি লোখায় ভক্তি ভরে প্রণাম করে।

পূজার সবকিছুর মধ্যে লোখার ভাল লাগত আরেকটা জিনিস। আশেপাশে কোথাও কোন কালী পূজায় তা হয় না। তাদের গ্রামের  কালীপূজা মানে কবিগান হবেই। কবিগানের ঢোল না বাজলে মায়ের পূজা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মা সন্তুষ্ট হয় না। খগেন মাস্টার একবার তাকে এই ঢোল নামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে  কবিগানের কথা  বলেছিল।
—- বুজলু লোখা, ঢোল বল্লে কেন  অত রাগু তুই। যারা জানেনি তারা রাগবে। তুই রাগি সিনি। ঢোল মানে কবি গানের ঢোল। মোদের মায়ের পূজার সাথে ওই পাচীন লোকবাদ্যের সুর জড়িত। ইটাত মোদের পবিত্ততার পতিক। পুজার মাঙ্গলিক আচার। সেই ঢোল থিকেই ত ঢোল। এতে ত রাগের কিছু নাই।
তখন লোখা কিছু উত্তর করে না। কিন্তু পরে কথাটা ভগী খুড়াকে শোনায়,।
—জান থুড়া মাস্টার বলে কবিগানের ঢোল থিকেই নাকি মোদের ইদিকটাকে ঢোল বলে? তমার মত কী উটাই? বল দিখি।
—-মাস্টার কথাটা ভুল বলে নি। মোদের মা ঢোল কাঁসির  বোল না শুনলে পূজা কুনু দিন লিবেনি। তোদের তখন জম্ম হয়নি। এই কবিগান লিয়ে মায়ের থানে একটা আশ্চয্য ঘটনা ঘটে। সেবার মোদের ইদিকটায় খরা হয়। ধানটান কিচ্ছু হয়নি। সবার ঘরেই টানাটানি। কিন্তু মায়ের পুজায় ত কুনু তুটি কল্লে চলবেনি। পুজা শুরু হইচে। জাত বসেচে। কবিগানের দল এসেচে কেশপুর থিকে। রাতে কবিগান হবে। হায়! সেই দল কখন লুকি পালি গেছে। কেনে? না, এরা দলের ভাড়ার পয়সা দিতে পারবেনি। 
—-- বল কী গো খুড়া! তারপরে?
—-- তখন আর দল পাবে কুথায়! ইদিকে পুজার দিন গুলানের মধ্যে মাকে ত কবিগান শুনাতে  হবেই। কী হবে! ঠিক হয়,কমিটির লোকেরা দল খুজতে যাবে সকাল হলেই। হঠাৎ ভোর ঝুঝুকার সময় সেই দল ঢোল কাঁসি লিয়ে মায়ের থানে হাজির। দেখে লোকজন রাগবে কী অবাক! কিছু বলার আগেই তাদের দলের সবাই মা'র থানে গলায় কাপড় গামছা দিয়ে হাতজোড় করে ভুল স্বীকার করে। পরে জানা গেল মা নকি স্বপ্ন দিচে দলের অধিকারীকে,যেদি কবিগান কত্তে তরা না যাউ তোদের কারো বংশে বাতি দিতে রাখবোনি। সেই শুনেই সকাল না হতেই অন্য একটা আসর ছেড়ে সজা হাজির মোদের মা'র থানে। মোদের খেপি মা যে ঢোল কাঁসির বোল খুব পিয়। সেই থিকেই হয়তো লোকজন মোদের ইদিকটাকে ঢোল বলে।
—- এতসব কান্ড আছে গো খুড়া মোদের ঢোল নামের মধ্যে! এই ঢোল লিয়ে কি কম কথা শুনতম ছোট থিকে। এখনো শুনি। তবে এবার যেদি কেউ বলে শালার টুঁটি চিপে ধরব। বোলবো, ঢোল কেনে নাম হইচে বল দিখি? আর যেদি না পারে শালার কাপড় খুলে ল্যাংটা করি দুব, দেখবে খুড়া।
—--অত মাথা গরম ভাল লয় রে  লখি। যারা বলে, বলতে দে। ঘাটের চানে কত লোক পা ঘষে, অতে কী চান খয়ে যায়!
—-জান খুড়া, এই ত গত বছরটাই বাজারে রজা সাঁত মোকে দেখে দাঁত বের করে বলে,"কীরে ঢোল কুম্পানি দাদের মলম"। শুনেই শালা মাথায় রক্ত উঠে গেল। বল্লম, ক্যানে, মোদের নাইলে ঢোল কুম্পানি দাদের মলম, তমাদের কী? কৈবত্ত কুম্পানি চুলকানির মলম? মোদের পেছান না চুলকালে ত তমাদের ভাত হজম হবেনি।
—-কেনে তক্কাতক্কি কোরু বল দিখি। উসব ছেড়ে দে। সবাই ত আর খারাপ লয়। কেউ পেছানে লাগে আবার কেউ ভালও পায়। জানু কেনে মোদের পূজার আগে দেশের শীতলার থানে পূজা দিতে হয়? কেনে পাঠক বামুনদের পসাদি পাঁঠা দিতে হয়?
—-অত সব জানি নি ত খুড়া। কেনে বল দিখি?
—-অই যে বল্লম সবাই খারাব লয়। হাগা বাজ্জ বমিতে গেরামটা যখন উজাড় হচ্ছে তখন মুরুব্বিরা ত মায়ের মুত্তি বসাল। কিন্তু পুজা করবে কারা? বাগদি জাতের মা বলে কুনু বামুন পুজা কত্তে চাইল নি।
—-বল কী গো খুুড়া! মা কালীকে লিয়েও বাগদি- বামুন বাছ-বিচার!  কুনু দিনত শুনিনি ত  ইটা। তারপর?
—--তারপর আর কী হবে। পুবের পাঠক বামুনরা রাজি হল পুজা কত্তে। তাদের হাতেই মায়ের পতিষ্টা হয়। তারপর থিকে  কিশোরপুরের চক্কবতিরা পুজা করে আসচে। কিন্তু পাঠকদের ত সম্মান রাখতে হবে। তাই মুরুব্বিরা ঠিক করে মা শীতলার থানে যে পাঁঠা উচ্ছুগ্গু হবে সেটা তাদের দিয়া হবে। সেই থিকেই পধা চলে এসেঠে। তবে পাঠকদেরও ভক্তিশোদ্ধা আছে রে। মাকে তারা নৈবিদ্যি হিসাবে তিনটা ডাব দেয় সবদিন।বুজলু।
—-এতসব কথা সত্তি জানতম নি খুড়া। তবে মা মোদের জাগ্গত। কাকেও নিরাশ করে ঘুরায় নি কুনুদিন। ওই জন্নে দেখনি বছর বছর মানসিকি পাঁঠা বেড়েই চলেঠে।
—--তার সঙে খিরিশ তলায় তরাও লন্ঠন মেলায় ভীড় বাড়াওঠু। জাতটা কুনুদিন শুদরাবে নি, বুজলু! যাদের জম্ম দেখেচি তাদের কাছে পুজার সময় যেতে লোজ্জা পায়। ভয় লাগে।
—--কেনে খুড়া? বছরের ত একদিন। মায়ের পুজায় ছ্যানা ছকরারা একটু মদ হেড়া খাবেনি?  এট্টু ফুত্তি আমোদ করবেনি।তমরা যখন যুবক ছিলে তখন কী ইসব হোতো নি? ছোটবেলায় দেখতম ত বাপ খুড়ারা ভালই নেশাভাঙ করে হুড্ডাহুড্ডি কোত্ত।
—-- তা যে কোত্তনি সেটা লয়,তবে কি জানু এখন যেন সবার রাগ বেড়ে গ্যাছে। হুক্ কথায় লাঠিতাড়া লিয়ে বেরি পড়ছে। পাড়ায়,বাখুলে মিলমিশ নাই। সকলে যেন আলাদা আলাদা। নিজের ছেনাগুলানের চোখমুখ গুলান দেখলেও ছাতিটা ধড়পড় করে। ভুল করিঠি রে লখি,ভুল করিঠি। যে বলেচে কথাটা তাকে শত কোটি গড় করি,বাগদির দশা ফিরেচে,দিশা ফিরেনি। ফিরবেউ নি বোধহয় কুনু দিন।

Post a Comment

0 Comments