বাগদি চরিত ( সপ্তদশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
ঢোলের কালীপূজা মানেই খগেন মাস্টারের মন খারাপ শুরু। তবে বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। একথা একমাত্র লোখা জানে। লোখা বলে,মাস্টারের মনটা যুগ্গেশ্বরের দ'য়ের মতো। সমবচ্ছর কাঁচপারা জল দ'য়ে টলটল করে। দ'য়ের উত্তরে বাবুদের বাঁধানো ঘাটে নেমে সবাই ঝাঁপাইঝুড়ে চানটান করে। সাঁতার কাটে। যুগ্গেশ্বরের দ'য়ের জল কাউকে বাধে না। যেন কত ভালবাসা মিশে আছে সেই জলের শীতলতায়। অথচ ডুব সাঁতারে এপার ওপার করতে সাহস হয় না কারুর। মাঝে গিয়ে দ'য়ের তল ছুঁয়ে দেখার কারুর বুকের পাটা নেই। হয়তো ভয় করে তার গভীরতাকে। হয়তো সমীহ করে তার বিশালতাকে। খগেন মাস্টার বড্ড ভালো মানুষ। গ্রামের কেউ তার পর নয়। কারুর সাথে তার শত্রুতা নেই।কত সহজেই ধরা দেয় সবার কাছে। কিন্তু সেই ধরা শুধু ধরাই থেকে যায়। মুঠোর ভিতর জলকে যেমন ধরা যায় না,মাস্টারের মেলামেশার ধরণটিও তেমন। পূজার কটা দিন মাস্টার চরম ব্যস্ত থাকে। কত দায়িত্ব তার মাথার উপর। সেই দায়িত্ব কেউ তাকে দেয় না কোন দিন। নিজেই সে নিজেকে ওই দায়িত্বের মধ্যে সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে। লোখা প্রথম দিকে ভাবত জীবনের অতীত যন্ত্রনাকে ভুলে থাকতে মাস্টার এসব করে। কিন্তু পরে তার ভুল ভাঙে।
মাধবী খগেন মাস্টারের অতীত। দিগার পাড়ার সুবল দিগারের বড় মেয়ে মাধবী। সুবল দিগার পোস্ট অফিসের পিয়ন। আকাট বাগদি পাড়ার একমাত্র চাকুরে লোক। পলিমাটির সাথে খড়ের ছানি আর পাট কুচানো মিশিয়ে ওলোট করা ঘর। মেঝে পাকার। মাটির কাঁথে আলকাতরা আর চুনে রঙ করা দুয়ারে লোহার গ্রীল দেওয়া। গাঁয়ে যে কজনের টিভি ছিল সুবল দিগার তাদের মধ্যে একজন। একটা সন্তোষ কোম্পানীর রেডিও ছিল তার। রোববার মানেই সুবল দিগার বেশির ভাগ সময়টা আকাশবাণী শুনে কাটাত। এক ছেলে,তিন মেয়ে সুবলের। তারিনী তার বউ। মা সরস্বতী তাকে কৃপা করে নি। অথচ তার সাথে কথা বলে কেউ তা টের পাবে না। পাড়ায় তারিনীর মতো অমন গুছিয়ে কথা কেউ বলতে পারে না। তারও একটা কারণ ছিল। সুবল দিগারের প্রথম পক্ষের বউ দুলালী মারা যায় জলে ডুবে। তার মৃগীরোগ ছিল। বড় মেয়ের তখন বয়স পাঁচ বছর হবে।সুবল দিগার তখনো চাকরী পায় নি। সুবল দিশেহারা হয়ে পড়ে। ওইটুকু মেয়ের দেখভাল করবে কে! সংসারটা তার উঠে দাঁড়ানোর মুখেই কোমর ভেঙে পড়ে গেল। বাখুলের অনেকে তাকে স্বান্তনা দেয়,
—-অত ভেঙে পড়িসিনি সুবলা,বুজলু। কী করবি বল। বৌমা তার পরমায়ু লিয়ে এসছিল। তোর- আমাদের কুনু সাধ্যি নাই তাকে আটকাবার। কিন্তু তুই পুরুষ মানুষ,একা কদ্দিন থাকবি। তারচে আরেকটা বিয়া করে লে।
সুবল মুখে কোন উত্তর করে না। তবে আপত্তিরও কোন চিহ্ন তার মুখের রেখায় ফুটে উঠতে দেখা যায় না। গ্রামের সমবয়স্করা সুবলের সঙ্গে মস্করা করে। বলে,
—- কিরে সুবলা! তুই যে এগবারে বউ পাগলা হয়ে গেলু। চাপ দাড়ি রেখে দিছু। বেওলা হয়ে ঘুরুঠু। বউয়ের শোকে তুইও কি মরবি শেষকালে। তোর ত এখনো বিয়ার বয়স যাইনি। আরেকটা বিয়া করে লে দিখি। কথায় বলে, অভাগার গাই মরে আর সৌভাগ্যবানের বউ মরে। তোর এখন ত পুয়া বার। লোতন আবার একটা বউ আনবি! আবার সবই লোতন লোতন পাবি! হেবি মজা মাইরি!
কথা গুলো কানে কর্কশ ঠেকলেও পাল্টা কোন উত্তর দেয় না সুবল। ভিতর থেকে অনেকটাই তার রাশ হাল্কা হয়ে গেছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। ছোট্ট মেয়েটার মুখ চেয়ে সুবল রাজি হয় বিয়েতে। কিন্তু দোজবরের মেয়ে পাওয়া অত সহজ না। শেষমেশ ব্যাঙরাল থেকে সম্বন্ধ আসে। কালি পাঁজারি সুবলকে বলে,
—-- লাতি তমার জন্নে একটা মেইছেনা দেকেচি। যেদি রাজি হও ত বল। ব্যাঙরালের মেইছেনা। তারও আগে বে হয়ইছিল। কিন্তু ছ্যানা লবংসু বলে মেইছেনা পালি এসে। তাপরে এখন কোলকাতায় মাসির কাছে থাকে। দেখলেই তমার মনে ধরে যাবে। এগবারে ডাঁটল মেইছেনা।
কালিবুড়ি হাটে হাটে পাঁজারি ব্যাবসা করে। কাজির হাট হামেশাই যায়। অনেক ছেনা মেইছেনার হাত জড়া করেছে সে। তার উপরে অনেকেরই বিশ্বাস। সুবলের স্ত্রী মারা যাওয়ার মাঝে এক বছর গলে যায়। এদিকে মাঝেমধ্যেই সুবলের শরীরটা রাতে বালিবড়া সাপের মতো ফুলে ফুলে গর্জন করে। সাপের আধার ধরার মতো কাঁথা বালিশকে দুমড়েমুচড়ে রাগ শান্ত করে। কতদিন আর এভাবে খিদাকে মেটাবে সে। কালি পাঁজারির মুখে তারিনীর কথা শুনে চাপা খিদাটা যেন চাগড় দিয়ে উঠে। রাজি হয়ে যায় সুবল। দোজবরের কি আর বাজনা হাঁকিয়ে বিয়ে হবে। দেখতে গিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। কালি পাঁজারি মিথ্যা বলেনি। নজর আছে মানতে হবে বুড়ির। প্রথম স্ত্রীর মুখটা সুবলের চোখের সামনে ক্রমে ঝাপসা হতে থাকে।
প্রথম রাত। আবার প্রথম নয় দুজনের কাছেই। এই রাতের অভিজ্ঞতা তাদের দুজনের আছে। তবে তারিনীর কাছে তা সুখকর ছিল না। ভীষণ বিস্বাদের। সাপের মুখ থেকে আধার ছাড়ালে যেমন সাপ মুখ ফিরে চলে যায়। কিন্তু ভিতরে রাগে গরগর করে। প্রতিশোধের ছোবল প্রস্তুত করে। তারিনী এতদিন ধরে ক্ষুধার্ত ছিল। চরম খিদে নিয়ে খাবারের কাছে গিয়েও মুখ ফেরাতে হয়েছে। ভিতরে তার বিষ জমা ছিল একরাশ। সুবলকে কাছে পেয়ে যেন সে গিলে খেতে চায়। ছোবলে ছোবলে সুবলের সারা শরীরটাকে নীল করে দিতে চায়। সুবল ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার ধারণা গুলিয়ে যায়। সুবল জানত মেইয়া মানুষদের শরীর একই রকম। শুধু আদল টুকুর রকমফের হয়। বাকিটা চোখের নেশা। মনের উজানভাটান খেলা। কিন্তু তারিনী তার ভাবনাকে ভেঙে দেয়। নদী মানে নদী নয়। এক একটা নদীর ঘূর্নিপাক এক এক রকম। দুলালীর সব ছিল। ভগবান যেথায় যেটুকু মাস লাগে তারচে বোধহয় বেশি দিয়েই দুলালীকে গড়েছিল। কিন্তু বড্ড নির্জীব লাগত সুবলের। অমন চুপচাপ নদীতে সাঁতারে মজা নাই। সেদিক থেকে তারিনী ছুটন্ত কাঁসাই। কত আঁকনবাঁকন প্যাঁচ জানে। দারুণ মজা হয়। তারিনী তার শরীরে খিদা মিটিয়ে দিয়েছে ভরপুর। কিন্তু একটা খচখচানি গোপনে বাসা বাঁধতে থাকে মনের ভিতর। সেই কথা বলতে সাহস পায় না সুবল। শুধু একটা কথা সেই প্রথম রাত থেকেই তারিনীকে সে শোনাতে থাকে,
—--মা মরা মেইছেনাটাকে তুমি দেখো। তমার কুনু অভাব হতে দুব নি।
তারিনী খলখল করে কথা বলতেই বেশি ভালবাসে। তবে যেহেতু সে এখন নতুন বউ তাই গলার স্বর মৃদু করেই বলে,
—-ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ওকে আমি নিজের মেয়ের মতোই দেখবো সবদিন।
কলকাতায় মাসির কাছে তারিনী প্রায় দু'বছর ছিল। মাসিদের মনোহারী দোকানে থাকত। ব্যাংরালের মেইছেনা শহরের জল হাওয়ায় শুধু ফুলাফাঁপুরা হয় নি,কথার বাঁধুনিও বেশ শিখেছে। সুবল তাতেই আরো সিদ্ধ খামালুর মতো গলে যায় গর্বে। পাড়ার কাকি খুড়িরাও তারিনীর সুনাম করে। সুবলের কানে টুকরাটাকরা কথা আসে,
—-যাই বল মোদের সুবল ঠাকুরপোর এই পক্ষের বউয়ের কথা গুলান ভারী সুন্দর
—-হবে নি! শুনি ত উ নাকি কলকাতায় থাকতন। তবে মেইয়ার চোখমুখ দেখে মনে হয় সুবিধার লয়।
—---সুবল ঠাকুরপোকে চরি খাবে বলুঠু?
—--শুধু চরাবেনি অকে হাতের পুথুল করে লাচাবে,দেখবে খন।
কথা শুনে সুবলের মনটা ভাল-মন্দের দোলাচালে ঢেউয়ের ধাক্কায় পানসি নৌকার মতো টলমল করে। আবার সেই গোপন চিন্তাটা চেপে বসে।
এরই মাঝে হঠাৎ একদিন সুবলের বাড়িতে গোষ্ঠ পিয়ন একটা বাদামী খাম নিয়ে হাজির হয়। বলে,
—ভায়া,তমার পিয়নের চাকরিটা হয়ে গেছে। তবে পথমে তমার পোস্টিং হয়েছে গড়বেতায়।
🍂চাকরির খবরটা শুনেই আনন্দে লাফাতে থাকে সুবল। তারিনী মুখ খুশিতে ঝলমল করে। গ্রামে খবর রটে যায় সুবল দিগার পিয়নের চাকরি পেয়েছে। কেউ খবরটায় খুশি হয়। কারো আবার মুখটায় ঈষৎ বাঁক ধরে। এরপর সুবল কী করতে পারে, তারিনীর চালচলন কেমন হবে সেই নিয়ে দফায় দফায় পুকুরঘাটে,মাচায়,মন্দির তলায় আলোচনা চলে। তবে সব আলোচনা ছাপিয়ে একটা কথা সুবলের মনকে ভরিয়ে দেয়। তা হল,
—--দেখলু সুবলার কপাল। অম্নি বলেনি সৌভাগ্যবানের বউ মরে। এই পক্ষের বউটা কেমন অর পয়া দেখলু। লোতন বউ এল আর সুবলা চাকরি পেই গেল। ইবার অকে ধরে কে!
—-ছাড় ত ক'টাকা বেতন পাবে উ। অই ত পিয়নের চাকরি। তাউ আবার গড়বেতায় শুনিঠি। অকে ত অখিনেই থাকতে হবে। থাইলে য'টাকা পাবে তায় অর থাকা খাওয়াই ত ফুতুরফাঁই হই যাবে।
—- বুজু কত! কেনদেরের চাকরি। এত সজা লয়।
সুবল সেই রাতে তারিনীকে খুব আদর করে। তারিনীও সেই সুযোগে স্বামীর কাছে নিজের কদর আরো বাড়াতে চায়। সুবল গলার স্বর সামান্য মিহি করে বলে,
—-কি গো একা থাকতে পারবে ত? অসু্বিধা হবে নি কুনু?
—--অসুবিধা তেমন হবে না। তবে তোমাকে সারা হপ্তাটা ছেড়ে থাকতে হবে সেই ভেবে মনটা খারাপ লাগছে।
শুনে সুবলের মনের সেই গোপন কিন্তুটার ভার অনেকটাই হাল্কা বোধ হয়।
পরের দিন ফুরফুরে মেজাজে রওনা দেয় সুবল তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
কয়েক মাস দিব্যি কাটছিল। এমনকি তারপরেও কেটেছে। শুধু ওই একটা কিন্তু সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ে সুবলের সংসারে। হপ্তার শনিবার রাতে আসে সুবল। রবিবারটুকু থেকেই আবার রওনা দেয়। এখুনি তার যে ট্রান্সর্ফার হবে না, সুবল সেটা জেনে গেছে। যাতায়াতে গাড়ির ধকল তার উপর চাষের কাজ। সারা সপ্তাহের কাজ এই একটা দিনেই সারতে হয় সুবলকে। বাপের জল কালা জমি যেটুকু তাতে কত আর মজুর করে চাষ করবে। জোর খাটুনিতে শরীর বেশি টানতে পারে না। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বেশি রাত অব্দি জাগতে পারে না সুবল। দুলালী তার প্রথম যৌবনের অর্ধেক তেজ নিঃশেষ কর দিয়ে গেছে। বাকি টুকু দিয়ে তারিনীকে সে জয় করতে পারবে কিনা তার মনে সংশয় ছিল। যখন তখন সেই চিন্তা তাকে ধাক্কা দেয়। অথচ তারিনীর কোন আচরণই তার ধারনাকে দৃঢ়মূল হতে দেয় না। তবে গড়বেতা যাওয়ার পর থেকেই সুবল নিজেকে অনেকটা কমজোরি ভাবে। আর ভাবে তারিনীর খিদের ভিতর কোন ফাঁক থেকে যাচ্ছে না তো! দিন দিন তারিনীর শরীরটা যেন বর্ষার পুঁইডাঁটার মতো লিকলিক করছে। অমন বউকে সারা সপ্তাহ একা ফেলে রেখে যেতে চিন্তা তো হবেই। মেইযা মানুষের শরীরে উপর পুরুষের নোলা কেমন সুবল তা জানে। তাবাদে ওইটুকু মেইছেনা নিয়ে ঘরে একা থাকে
তারিনী। মন খুলে কথা বলার মতো কেউ নেই তার। সবার সাথেই সে আপন করেই মিশতে চায়। এতদিন শহরে থাকলেও তার গুমারচটক নেই। কিন্তু তারিনী জানে আড়ালে আবডালে তার নামে অনেক কথাই হয়।
—-- দেখতে পাউনি চটকমটক। দোপড়া মেইয়া তার উবরে আধগুমারী।
—- মিথ্যা বোলুনু। এবার ভাতার চাগরি পেইচে আরো গুমারে মাটিয়ে পা পড়বেনি,দেখবি।
তারিনী অতসব কথায় মাথা ঘামায় না। তার জা-জাউলি সেভাবে নেই। পাড়ার একদিকে রাস্তা ধারে সুবলের ঘর। তারিনী প্রাণ খুলে একটু কথা বলতে পারে শুধু বঙ্কা ঠাকুরপোর সাথে। শিলাইয়ের উত্তর পাড়ে বঙ্কিম পাত্রের ঘর। সুবলের একগলা বন্ধু বঙ্কা। বিয়ের দিনও সে সারারাত ছিল তারিনীর বাপের ঘরে,সুবলের সঙ্গে।
ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন 👇
হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments