জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৯ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ৯

বিজন সাহা 

আফানাসি নিকিতিন 

আফানাসি নিকিতিন – রুশ পরিব্রাজক, লেখক, সওদাগর। তিনি মধ্য যুগের প্রথম ইউরোপীয়দের একজন যিনি নিকোলো কন্টির পরে ভারতে এসে পৌঁছেন। আর সেটা ঘটেছিল ভাস্কো দা গামার ভারত আবিষ্কারের ৩০ বছর আগে। আফানাসি নিকিতিন পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে তভেরে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু নিকিতিন তভেরে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ভারতে বা সঠিক ভাবে বললে দিল্লির দরবারে উপস্থিত হন তাই দিলীপের বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর ব্যাপারে। ও আফানাসি নিকিতিনের উপর পড়াশুনা করে এসেছিল, সাথে এনেছিল বেশ কিছু বই। আর আমার বিশ্বাস এ কারণেই ও যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিল এই তভের থেকে। এটা ছিল একান্তই প্রতীকী। আফানাসি নিকিতিন ১৪৬৮ থেকে ১৪৭৪ (মতান্তরে ১৪৬৬ থেকে ১৪৭২) সালে পারস্য, দিল্লি ও তুরস্ক ভ্রমন করেন। এই ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে তৈরি হয় তাঁর “খাঝদেনিয়ে যা ত্রি মারিয়া” বা “পাল তুলে তিন সাগরের পরে”, যা ছিল রুশ সাহিত্যে অন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনায় পরিপূর্ণ বানিজ্যিক ভ্রমণের উপর প্রথম বই। এর আগের সমস্ত বইই ছিল কোন না কোন ভাবে তীর্থযাত্রা ও ধর্মের সাথে জড়িত। এটা কোন তীর্থযাত্রা ছিল না, তাই নিকিতিন তাঁর এই ভ্রমণকে পাপ বলে মনে করতেন। আফানাসি নিকিতিনের ভারত ভ্রমণের ৫২৫ বছর উপলক্ষ্যে ব্যাংক অফ রাশিয়া ১৯৯৭ সালে দু'টো দুই রুবলের কয়েন বাজারে ছাড়ে। আর এই ভ্রমণের ৫৫০ বছর উপলক্ষ্যে রাশিয়ান পোস্ট ২০২১ সালে একটা স্ট্যাম্প চালু করে। 

তভের রাজ ও সেখানকার ধর্মগুরুর আশীর্বাদ নিয়ে নিকিতিন তভের থেকে যাত্রা শুরু করেন। ভোলগা পথে তিনি আসেন নিঝনি নভগোরাদ, যেখানে সিরভানশাহের রাষ্ট্রদূত হাসানবেকের জন্য দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করেন।  কাস্পিয়ান সাগরে ভোলগার মোহনায় অন্যান্য সওদাগর সহ তিনিও তাতারদের হাতে পড়ে সর্বস্ব হারান। তাতার দস্যুরা তাদের ভোলগার উজান বেয়ে ফিরতে না দিলে তারা দুটো জাহাজে দেরবেন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঝড়ের সময় ছোট জাহাজটি তারকি নামে শহরের ডুবে গেলে কিতাইকিদের হাতে বন্দী হন। বর্তমান রাশিয়ার দাগিস্তানে অবস্থিত দেরবেন্ত থেকে তিনি যান বাকু। আর বাকু থেকে পারস্য হয়ে দিল্লি আসেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে সময় দিল্লির মসনদ লোদি বংশের অধীনে ছিল। যেহেতু নিকিতিন এই ভ্রমণে একাধিক মুসলিম রাজ্যে অবস্থান করেছিলেন তাই অনেকের ধারণা ছিল তিনি হয়তো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তবে নিকিতিন নিজে সেটা অস্বীকার করেন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন তিনি যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন তাহলে অর্থডক্স তভেরে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হত না। 

সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান খাওয়া দাওয়া করে আমরা পথে নামলাম। চাবি রেখে গেলাম মহিলার দেখানো লেটার বক্সে। উদ্দেশ্য ভোলগা তীরে আফানাসি নিকিতেনের স্ট্যাচু, যেখান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ বছর আগে তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ভোলগার উৎসের পর এই আমাদের প্রথম ভোলগা দর্শন। মাঝে অস্তাশকভ, তরঝক, নিলোভা পুস্তিন – এদের কোনটাই ভোলগা তীরে নয়। এই স্ট্যাচুটি ভোলগার তীরে ভস্ক্রেসেনিয়ে খ্রিস্টা বা যীশুর পুনরোত্থান গির্জার সম্মুখে অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে এই স্ট্যাচুটি স্থাপিত হয়। কথিত আছে নিকিতা খ্রুশেভ যখন ভারত সফরে যান তখন জহরলাল নেহরু তাঁর কাছে জানতে চান «জন্মভুমিতে আফানাসি নিকিতিনের স্ট্যাচু আছে কিনা।»  খ্রুশেভ হ্যাঁ বোধক উত্তর দেন যদিও বাস্তবে তখন কোন স্ট্যাচুই ছিল না। ভারত থেক ফিরে খ্রুশেভ যত দ্রুত সম্ভব তভেরে আফানাসি নিকিতিনের স্ট্যাচু স্থাপন করার নির্দেশ দেন। সেই স্ট্যাচুর গায়ে খোঁদাই  করে লেখা আছে
সাহসী রুশ পরিব্রাজক আফানাসি নিকিতিনের স্মৃতিতে যিনি ১৪৬৯ – ১৪৭২ সালে বন্ধুত্বপূর্ণ সফরে ভারত যান 

সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে পি মেননের উপস্থিতিতে আর্কিটেক্ট জাখারভের তৈরি এই মূর্তিটি উদ্বোধন করা হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় তিনি যেন জাহাজে করে কোথাও যাচ্ছেন। জাহাজের মুখে শোভা পাচ্ছে এক ঘোড়ার মাথা। তিনি যেন সেখান থেকে ভোলগার দিকে তাকিয়ে আছেন আর দেখছেন নদীর অন্য তীরে শহরের উদ্যান যেখানে আগে ছিল তভের ক্রেমলিন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে পৃথিবীতে আফানাসি নিকিতিনের মোট তিনটি স্ট্যাচু আছে – তভেরে, রেভদন্ড বলে মহারাষ্ট্রের এক শহরে আর ক্রিমিয়ার ফিওদোসিয়ায়।  

🍂

নিকিতিনের স্ট্যাচুর পেছনে দেখা যায় শ্বেত শুভ্র ভস্ক্রেসেনিয়ে খ্রিস্টা গির্জা। আগে এখানে ছিল কাঠের গির্জা। ১৭২৮ থেকে ১৭৩১ সালে এখানে বারোক স্টাইলে বর্তমান গির্জা তৈরি করা হয়। ১৭৯৭ – ১৮০৫ সালে গির্জার স্টাইলে কিছু পরিবর্তন এনে ক্ল্যাসিকবাদ যোগ করা হয়। গির্জার দু' পাশে রয়েছে অনেক পুরানো স্থাপনা যা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হল রিকনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। যেহেতু বর্তমানে সমস্ত রাশিয়া জুড়ে এ ধরণের কাজ চলছে তাই আশা করা যায় কয়েক বছরের মধ্যে তভের নতুন সাজে সেজে উঠবে। যদিও শুধুমাত্র নদীর অপর পাড়ে শহরের উদ্যান থেকে এই স্ট্যাচুর পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, সময়াভাবে আমাদের আর ওদিকে যাওয়া হয়নি। এখানেই কিছু ছবি তুলে আমরা রওনা হলাম নদীর অন্য পাড়ে ক্যাথেরিন প্যালেস বা সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনার ভ্রমণ প্রাসাদ দেখতে।  

আগে যেখানে তভের ক্রেমলিন ছিল সেখানে দুটি প্যাভেলিয়নের এই প্রাসাদ তৈরি করা হয় ১৭৬৪  - ১৭৬৬ সালে বারোক এলিমেন্ট সহ মূলত ক্ল্যাসিক স্টাইলে পিওতর নিকিতিনের নকশা অনুয়ায়ী। যখন রাজ পরিবার পিটারবারগ থেকে মস্কো যেতেন তখন পথের ক্লান্তি দূর করার জন্য এখানে অবস্থান করতেন, সেই থেকেই এর নাম ভ্রমণ প্রাসাদ। ১৭৬৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা প্রথম এখানে আসেন। রোসি উনবিংশ শতকের শুরুতে এই প্রাসাদ পুনর্নির্মাণ করেন। সে সময় এখানে জার প্রথম আলেক্সান্দরের বোন ইয়েকাতেরিনা পাভলভনা বাস করতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এই প্রাসাদ তভেরের এলিট শ্রেণির আড্ডা স্থল তথা ফ্যাশনেবল সাহিত্য আসরে পরিণত হয়। মস্কো ও পিটারের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তখন এখানে আসতেন। ঐতিহাসিক কারামজিন এখানেই জার আলেক্সান্দারকে নিজের রচনা পাঠ করে শোনান। প্রাসাদের পশ্চিম দিকে ছিল ইয়েকাতেরিন গির্জা। 

বিপ্লবের পর শ্রমিক-কৃষকের সোভিয়েত বসে এখানে। ১৯৪১ সালে ফ্যাসিস্টদের হাতে প্রাসাদ ক্ষতিগ্রস্থ ও ১৯৪২ – ১৯৪৮ সালে পুনর্নির্মিত হয়। ১৯৯০ সালে থেকে এই প্রাসাদ রিকনস্ট্রাকশনের জন্য বন্ধ ছিল। ২০১৫ সালে সেই কাজ শেষ হয়। বর্তমানে সেখানে আর্ট গ্যালারী কাজ করে। ২০১৪ সালে প্রাসাদের পাশে আবার স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি গির্জা পুনর্নির্মিত হয় যা ২০১৮ সাল থেকে উপাসনার জন্য খুলে দেয়া হয়। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা যাই তভের স্টীমার ঘাঁটে। 

তভেরের এই ঘাঁটটি ত্মাকা নদী যেখানে ভোলগায় পড়েছে তার পাশে। কাছেই ট্রাম ডিপো। ত্মাকা নদীতে একজন বসে মাছ ধরছিলেন। আসলে মাছ ধরা এখানে পুরুষদের এক নেশা। যত না মাছ ধরা তারচেয়ে বেশি নদীতে বড়শি ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। ঘাঁটে একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল।  কিছুটা দূরে ভোলগার অপর তীরে দেখা যাচ্ছিল সেন্ট ক্যাথেরিনা মহিলা মনাস্তির। এই মনাস্তিরের পাশেই তভেরৎসা নদী মিশেছে ভোলগার সাথে। সেই তভেরৎসা নদী যার নামে তভেরের নামকরণ। ১৫২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই শহরে বাস করে প্রায় ৪১৫ হাজার মানুষ। আছে প্রচুর দর্শনীয় স্থান। গির্জা, মসজিদ, পুশকিনের স্ট্যাচু, ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি। আছে দেখার মত বাগান। তবে দিলীপ চাইছিল সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে এগুতে। তাই যদিও ঘড়িতে মাত্র সাড়ে এগারোটা, আমরা তভের ত্যাগ করে পথে নামলাম। আজ আমাদের গন্তব্য অনেক দূর। যাব কিম্রি, বেলি গোরাদ, কালিয়াজিন এসব পেরিয়ে উগলিচ, যদিও পথে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও নামব কিম্রি ও কালিয়াজিনে। 

তভের থেকে কিম্রির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার মত। পরিচিত পথ। এর আগেও এসেছি এই পথে। পথের দুপাশে পড়বে বিভিন্ন পরিত্যাক্ত গ্রাম আর ছোট শহর, ধ্বংস প্রায় যৌথ খামার। এক সময় এই এলাকায় অনেক নামকরা যৌথ খামার ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সাথে তাদের অনেকেই দেউলিয়া হয়ে আজ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।    

তভেরের কিছু ছবি পাওয়া যাবে এখানে 
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=242 

আর ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=KsIu3ObshvQ 

ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন 👇

হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী


Post a Comment

0 Comments