বাগদি চরিত (অষ্টাদশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
শিলাইয়ের উত্তর পাড়ে চাষা ঘরের বঙ্কা সাঁত। জমিজমা,ধানকল নিয়ে বেশ দুধেভাতে অবস্থা বঙ্কার। দখিন পাড়ের দিগার পাড়ার সবাই জানে বঙ্কা খুব ধাকুড়। ঘাঁটি পাড়ার বিকেতন চব্বিশ ঘন্টা মদে ডুবে থাকে। কোন কথা তার মুখে আটকায় না। একবার বঙ্কার সঙ্গে খুব কাউচাকাউচি হয়।
—- দেক্ বঙ্কা, বিগেরাম থিকে এসচু বেশি মাথা লাড়বিনি মোদের পাড়ে। শালা চাষাবাচ্চা! তরা দুটাকায় মরু বাঁচু। লঙ্কার পঁদ টিপে খাউ। ক্যানে এপাড়ে পড়ে থাকু জানিনি। কে ঘটিটা বাটিটা বন্দক দিবে আর তুই লিয়ে লিবি। বন্দকি কারবার আর চড়া সুদ এই লিয়ে ত তোর কামানি। সুদের টাকা কপালে সইবেনি দেখেলিবি।
— মুখ সামলে কথা বলবি বিকেতন। জাত তুলবিনি। মোর টাকা কি মাগনার। তরা বিপদে পড়লেই ত টাকা চাউ। বন্দকিটা দেখচু আর টাকা টা দিয়ে যে উপগার কল্লম তার কুনু দাম নাই। তোদের জাত ত খুব ভাল। গাঙ পেরালেই কুমির শালার পো। সকলাই ত খালিপেটে টেনে লিচু। কথা ঠিক করে বল, বলে দিলম।
—কেনে নাইলে কি করবি? মাল খেইচি মোর পয়সায়,তুই বলবার কে? গতর খাটাই খাই। তোর মতো লোককে টুপি পরাই নি।
—- ভাল হবে নি বলে দিলম, বিকেতন। তোর নেশার ঘুরমা কাটি দুব।
বচসা বেড়ে যাচ্ছে দেখে সবাই দুজনকেই থামি দেয়। জটলা কাটলে দু'চার জনকে কাছে পেয়ে বঙ্কা অভিযোগ জানায়,
—- দেখলে ত তমরা। কুনু কিছু নাই,কথা থিকে এসে পায়ে পা তুলে ঝগড়া কত্তে লেগে গেল। এবার থিকে ত ভাবছি তমাদের এপারকে এসাই চলবেনি।
সেই থেকে দিগার পাড়ার সবার সাথে আগের মত কথা বলে না বঙ্কা। তবে আসা বন্ধ করে না। বন্ধ করলে তার ক্ষতি। তাবাদে কাউচানের সময় অনেকেই যে বঙ্কার পক্ষ নিয়েছিল,সেটাও বঙ্কার চোখ এড়ায়নি।
—- উ মাতালের কথা বাদ দও ত বঙ্কাদো। অকে ত তুমি চিন। মাল পেটে পড়ে গেলে কুনু গেন থাকে নি। তুমি কিছু মনে করনি, বুইলে।
বঙ্কার মন আছে বটে,তবে সেই মন বেছেবুছে মন খারাপ করে। সব কথা গায়ে মাখে না সহজে। বিকেতন জাতে মাতাল, তালে ঠিক। বিকেতনের রাগ যে অন্য জায়গায় দিগার পাড়ার অনেকেই তা জানে।বঙ্কার উপনজর আছে তা পাড়ার কারো অজানা নয়। চড়া সুদের কারবারও যে করে তাও জানে। কিন্তু রাতবিরেতে দিগার পাড়ার কেউ বিপদে হাত পাতলে বঙ্কা তাকে ফেরায় না।
বঙ্কার বউ-ছেনা আছে। মাঠে ঘরে খাটনিও তার প্রচন্ড। অর্জুন গাছের মতো ঘিয়াটে পাকানো শক্ত শরীর। সুদের কারবার করে হাতে কাঁচা টাকাও যথেষ্ট আছে। না থাকার মধ্যে আছে বঙ্কার দেহ মনে সুখ। সেই সুখের একটু আধটু আঁচ পেতেই আড়া ছেড়ে পাড়া চষে বেড়ায়। তবে নিজের গ্রামে বঙ্কা সেভাবে থাকে না। তাদের সাঁত পাড়ার সোজা দখিন পাড়ের দিগার পাড়া। জল থাকলে নিজের পানসি বেয়ে সাঁঝ নামলেই এপাড়ে চলে আসে। মরাশুখার সময় তো হেঁটেই পার হয়। বঙ্কা অতটা হাতখোলসা নয়। তার মাথায় হিসাবী বুদ্ধি সারাক্ষণ কিলবিল করে। টাকা দিয়ে ভাল মানুষটি যেমন সেজে থাকে তেমন অনেকের মুখও বন্ধ রাখে। বঙ্কা তার বাপের কাছে শুনেছে টপকা, ট্যাঁকে থাকলে কড়ি,কুন শালার ধারী!
সুবলের সাথে এক ক্লাসে পড়ত বঙ্কা। সেই থেকে বন্ধুত্ব। বঙ্কা মাঝপথে পড়া থামালেও সুবল পড়া চালিয়ে যায়। তবে অনেক সময় বঙ্কা তার বন্ধুটিকে পড়ার খরচ দিয়ে সাহায্য করেছে। বন্ধুর এই সাহায্যকে সুবল কোনদিন ভুলে যাই নি। তার সুখে দুখে সবসময় সঙ্গে রেখেছে ছোটবেলার বন্ধুকে। বাগদি ঘরের ছেনা বলে বঙ্কার ঘরেও কোনদিন সুবলকে দুই দুই করেনি। একপাতে খেয়েছে। এক বিছানায় শুয়েছে। এ ঘাট থেকে ও ঘাট সাঁতার কেটেছে শিলাইয়ে। পানসি বেয়ে গঙ্গাতলার ঘাট উজিয়ে পৌজে গেছে জেলাঘাটে। কখনো আবার ভীমতলার ঘাটে। সুবল সবদিনই একটু ভীতু। বঙ্কা তার বিপরীত। হুড়দাঙ্গা মেজাজের। বাপের একমাত্র ছেলে। ছোটবেলা থেকেই সুবল কতকিছু শিখেছে বঙ্কার কাছ থেকে। যেসব জায়গায় যেতে সুবল ভয় পেত, সেখানেই বঙ্কা জোর করে নিয়ে যেত তাকে।
— বাগদি ঘরের ছেনা হয়ে তোর এত ভয়! যিখিনেই যাব তুই শালা আগে পেছ কাটবি! কেনে বল দিখি।
—-এই বয়সে অইসব দেখা কী ঠিক?
—--ঠিক বিঠিকের তুই কত্ত যেন জেনে গেছু। মনা কটালের এঁড়া পাল দিবে। তুই ত দিবি নি। সেটা দেখলে এমন কি হবে। হেবি মজা আছে চ না দেখবি।
মনা কটাল তার গোয়াল ঘরের পাশে তেঁতুল তলায় পাল দেওয়ার আস্তানা করে রেখেছে। অনেক সময় গাইকে ছাঁদতে হয়। বাঁশের তেকোনা ঘোলে গাইকে ঢুকিয়ে ঘেরে দেয় গাইকে। এঁড়া পাল দেওয়ার সময় গাই নড়তে পারে না। মনা কটাল গাই পিছু কুড়ি টাকা নেয়। বঙ্কার পাল্লায় পড়ে সেই প্রথম সুবল পাল দেওয়ার দৃশ্য দেখে। বঙ্কা এই ঘটনার কথা তার প্রথম পক্ষের বউ দুলালীকে বলেছিল। তারিনীকে বলেনি। বাদ বাকি বঙ্কার অনেক কথাই তারিনীকে বলেছে। বঙ্কা অনেক বড় পর্যন্ত তাদের ঘরে পান্তাভাত খেতে আসত। গেঁড়ি,ঝিনুকের ঝালচচ্চড়ি, গেঁড়া কাঁকড়ার টক কোনকিছুই বাদ দিত না। সুবল প্রায়দিন বঙ্কাকে খেপাত,
—-চাষা ঘরের ছেনা হয়ে তোর গেঁড়া-ক্যাকড়ার পতি লোভ মাইরি!
—-তুই কি জানু। বাগদির হাঁড়ির পান্তার সাদ আলাদা। গেঁড়া দিয়ে পুইশাকের ঘন্ট,গেঁড়ি চিছুনের ঝালচচ্চড়ি বাগদির ঘরে যে খাইনি তার মানুষ জন্ম বিথা।
—- অই জন্নে বাখুলের ঠাগমারা বলে সাঁতের পো বেগ্দাচাষা।
—-অতে মোর কুনু লজ্জা নাই। খাবার জিনিসে আবার বাগদি,চাষা কিসের! তোদের জাতের সবই কি খারাপ, ভালও ত আছে।
—- মোদের জাতের তোর আর কি ভাল লাগে, শুনি?
—--তুই শালা,ল্যালপেট্ট! চুন হাগা মুরগীর মতো ঝুমে ঘুরু।তোকে উসব বলে কিছু লাব নাই। বুজবিনি কুনুদিন।
বঙ্কার কথার ইশারা সুবল যে বোঝেনি তা নয়। তবে সেই মুহুর্তে না বোঝার ভান করে থাকে সুবল। সে জানে কথা বাড়ালে, বাড়বে। সুবলের মুখে কোনকিছু আটকায় না। বঙ্কার কীর্তিকলাপ তার অজানা নয়।
তারিনী যখন কথা বলে তখন যেন কলমী ফুলের গন্ধ ছড়ায়। হপ্তা ফেরত সুবলের মন ভরে যায় তার কথা শুনে। বিলের কাদাজলে কইমাছের খলবলানির মতো তারিনীর মুখে কথা কলকলায়। দুলালী তেমন ছিল না। সাত চড়ে রা কাড়ত না তার সহজে। মুখ থেকে টোকা পান্তার বাস ছাড়ত। হাতে লেগে থাকত লঙ্কা হলুদ বাটার রঙ। তারিনী খুব ফর্সা নয়। তবে গা হাত পা তার পরিস্কার ঝিরঝিরা। তারিনীর কেয়োকারপিন তেল খুব পছন্দের। রাতে গায়ে পাউডার মাখে। ঘর হেঁসেল গুছিয়ে থাতিয়ে রাখে। সুবল মনে মনে ভাবে, লোকের কথাই ঠিক। সৌভাগ্যবানের বউ মরে। তারিনী না এলে সে বুঝতেই পারত না সংসারে এত সুখ। মেইয়াম মানুষের শুধু শরীর ঘেঁটে সুখ পাওয়া যায় না, কাছে বসে দুটা চারটা কথার সোহাগেও মন ভরে যায়।রাতে তক্তপোশের বিছানায় শুয়ে সুবল তারিনীর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— বাখুলের লোক বলে সুবলা তুই লক্ষ্মীমন্ত বউ পেইচু।
—-আর তুমি কী বল?
—-- লোকে ত ঠিকই বোলচে। তুমি এসতেই চাগরি পেলম। সেজন্যে ত সংসারটাকে এবার একটু গুছি থাতি লিতে পাচ্ছি।
—- সেই দিদি কী লক্ষ্মীমন্ত ছিল না?
—- তার কথা আবার তুলচ কেনে।
—- কেন? সে কী তোমাকে কোন সুখ দেয় নি।
—- কেন দিবে নি। সুখের অনেক রকমফের হয়,বুইলে। সব কী শরীর দিয়েই হয় গ। দুটা মিঠা কথায়,চোখের ছলনে, হাঁসির বলনে কত সুখ আছে গ। সব মাছ এগ ভাবে ধরা দেয় নি। আর জাল থাকলেই হয় নি। মাছ ধরার কলন জানতে হয়। তুমি কত কিছু জান। সে যেন মরা ভোলা মাছের মতো পড়ে থাকত। এগবারে লেবজেন মারা হয়ে। আর তুমি আমাকে লেবজেন করে দাও।
🍂কথা শুনে হাসি ধরে রাখতে পারে না তারিনী। সুবলের ছাতির ভিতর মুখ গুঁজে খিলখিলিয়ে উঠে। দু'হাতের ফাঁসে সুবল তারিনীকে বেঁধে ফেলে।সুবলের গায়ে নোনা ঘামের গন্ধ। ক্রমে সেই গন্ধ মিশে যায় কেওকারপিন আর পাউডারের মিহি সুবাসের সাথে। নড়ে ওঠে তক্তপোশ।
শিলাই নদীর বাঁধে বড় বড় ইগড়ার গর্ত। ইঁদুরের মতো কিন্তু হুদমা গতর। হুড়ুস করে গর্ত থেকে বেরিয়ে বাঁধের এপার ওপার করে। জলে ডুব সাঁতার দিতে পারে। বাঁধ গায়ে সব ঘরেই ইগড়া রাতদিন উৎপাত করে। বঙ্কার ঘরকেও তছনচ করে ছাড়চে। বাঁশ গাছ বেয়ে ধানের হামারে ঢুকে পড়ে। চালের কাঠামার বাঁশ বেয়ে বারান্দায় লাফ দেয়। বঙ্কা কিছুতেই কায়দা করতে পারে না। কোন ফাঁস কলে ধরা পড়ে না ইগড়ার দল। কদিন ধরে বঙ্কার শরীরে মনেও একপাল ইগড়া যেন ছুটাদৌড়া করে চলেছে। কোন ভাবেই বশে আনতে পারছে না সে। বঙ্কা মেইয়াদের মন বুঝে,চাউনি বুঝে,কথার গিরোফাঁস বুজে। এই খেলায় বঙ্কা এক নম্বর ওস্তাদ। কিন্তু এবার সে যেন পাই হারা হয়ে যাচ্ছে। তবে হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। কতবার সে বানবন্যায শিলাইয়ের ঘূর্নিপাক কাটিয়ে পানসিকে পাড়ে ঠেকিয়েছে। এবারেও সে জয়ী হবে। বাগদি পাড়ায় থেকে বঙ্কা মাছ ধরার কায়দা শিখে গেছে। কোন চারে কোন মাছ ছটপটায়,বঙ্কা জানে। বঙ্কা চার ফেলা শুরু করে। সুবল তার বন্ধু। তারিনীকে সে বন্ধানী বলে ডাকে। বন্ধানীর সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি দোষের না। দোষ আবার কিসের?পেটের খিদা লঘুগুরু মাপজোখ বুঝে না। ধারালো হেঁসো শুধু কাটতে জানে। আগুন খালি পোড়াতে জানে। জল শুধু ডুবাতে জানে। তারা স্বভাবের অধীন। বঙ্কা তার স্বভাবের দাস।পাকা খেলুড়ের মতো ধৈর্য ধরে থাকে। হাল চষার আগে জমির ঘাসঘুসা পরিস্কার করে। দিনে দিনে কথার চার ফেলে মাছকে বশ করতে চায় বঙ্কা।
—- কি গ বন্ধানী! কত্তার জন্ন কী রাঁদচ? পুই ঘন্ট নাকি? তমার কত্তা ত গেঁড়া দিয়ে পুঁই ঘন্টর তরকারি এগবারে সাবাড়ে দেয়। মোকেও একদিন খাবাও।বন্ধানীর রান্না সুদু একা বন্ধুই কি খাবে!
—-কেন সে একা খাবে। তোমাকেও দেব।
—- কবে?
—- যেদিন ওটা রাঁধব। তবে স্বামী বলে কথা। তার বিয়ে করা নতুন বউ। তাই আগ তরকারি প্রথমে তার পাওনা, তারপর অন্যের।
—-বন্ধানী যে এগবারে পরপর ভাবছে মোকে।
—- কোথায় পর ভাবলাম। বলেছি তুমি স্বামীর পর। লাইনে থাক। পাবে।
—- তাই না হলে থাকলম লাইনে। দেখি বন্ধানী কবে মোকে যেঁচে খাবায়।
বঙ্কা কথার জালফাঁসে গিরো দেয়। রাসু খুড়া তার লাইকুন্ডুর কাছে জাল বুনার কঞ্ছা হাতের টানে কাত করে ধরে থাকে। জালের মূল খুঁট বাঁধা থাকে কঞ্ছার ডগায়। এপ্রন্তের সূতার টানে টানটান থাকে কঞ্ছা। কথা চলে মুখে,একই সাথে হাত চলে জাল বুনার কাজে। কেতার পেটে জালের ফাঁস। কেঁড়ার পাকে গিরো পড়ে ফাঁসের মাথায়। যেই মাছের যেই জাল,তেমন হবে ফাঁসের বহর। বঙ্কার কথার ফাঁসের বহর রাসু খুড়ার জালফাঁসের মত। মাছ ধরে ডাঙায় সে তুলবেই একদিন। আঁশজল ঘাঁটা তার ভালোই অভ্যাস আছে।
0 Comments