জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( ঊনবিংশ পর্ব ) শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (ঊনবিংশ পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

দেড় বছরের মাথায় সুবলের আবার মেয়ে হয়। চারিবুড়ি সুবলের মা। নাতনি হয়েছে শুনেই রেগে খরখর করে। শুকনো কঞ্ছার মতো তার চেহারা। শোনার পর থেকেই গটা পাড়া একসা বাখান করে বেড়ায়,
—- মুইয়াগুন হউ অমন বউড়ির। এট্টা বেটাছেনা বিয়াতে পাল্লনি। মোর সুবলাটার মুখে আগুন কে দিবে গো? দেখতেই অই রূপের গাদা। মুখে কথার যেন খই ফুটেঠে। মার, মার,অমন  মেইছেনাটার মুখে নুন দিয়ে মেরে দে দিখি। বিয়া সাজনি হলে মোর সুবলার যা থাকবে সব বেঁদেছেঁদে লিযাবে অরা। হায় গো! লাতির মুখ দেখতে পাবো নি না কি গো?  লাতি হলে কত আল্লাদ কত্তম গো! সাদে কি বলে,বেটার ঘরের লাতি সগ্গে দিবে বাতি,ঝিয়ের ঘরের লাতি আলের গড়ায় পুতি। ঝি,বেটা কারো ঘরে একটা বেটাছেনা দিল নি।অলাউঠা হউ একচোখা ভগমানের!
সুবলের মনটাও বেশ খারাপ হয়ে যায়। বেশ আশা ছিল তার এবার  একটা বেটাছেনা হবে। কিন্তু তার আশার মুখে পাঁশ পাছুড়া হয়ে গেল। নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেয়,
—- কি আর করা যাবে। একসঙে সব সুখ মিলেনি কুনুদিন। ভাবছিলম দুটাই ছেনা থাকবে। একটা বেটা একটা ঝি। বেশি পাত বাড়াবনি। কিন্তু শালার কপালটাই খারাব।
তবে আরও একটা চিন্তা সুবলের মনে চেপে বসেছিল তারিনী পোয়াতি হওয়ার দিন থেকেই। প্রথম পক্ষের ঝি মাধবী মায়ের মতোই শান্ত সরল। দুলালীর বাপের ঘরের অবস্থা তেমন নয়। মা মরা মেইছেনাটাকে নিয়ে যাওয়ার কোন নাম করেনি কখনো। তার উপরে দাদু দিদিমা নেই মেইছেনাটার। কথায় বলে সদমা কখনোই হবে নি নিজের মা। সুবল দিনরাত ভাবত যদি আবার মেইছেনা হয় তবে মাধুটার কপালে দুঃখ আছে। কত আর সে আগলে রাখবে। তার ভাবনাটাই সত্যি হল।  নিজের পেটের ছেনাকে বাদ দিয়ে কে আর সতীনের ছেনাকে টানবে। তারিনী যতই মুখে বলুক, সুবল জানে অবলা মেইছেনাটার জীবনে এবার কষ্টের দিন শুরু হল।
এতসব চিন্তাভাবনার কথা সুবল কারো কাছে মন খোলসা করে বলতে পারে না। সেদিন বঙ্কাই কথাটা তুলে,
— কিরে আবার মেইছেনা হইচে বলে মন খারাব কচ্চু? 
—- তা এট্টু হইচে জানু। বউটারও মনটা ভালো নাই।
—- আরে তুই ত এখনি ছেনা হবার লাড়ে গিঁট বেঁদে দেউনু। ত আরেকটা ছেনা লিবি। পঞ্চানন্দের ওষুদ খাওয়াবি বন্ধানিকে, দেখবি পরেরটা বেটাই হবে।
—- কালিবুড়ি লাভি ছেদন কত্তে গিয়ে দেকচে  বউয়ের নাকি এর পরে সবই সাদা গাঁট,কুনু কাল গাঁট নাই।
—- দূর মড়া কাল গাঁট সাদা গাঁট ছাড়ত। যত্তসব সেকেলা কথা। অরা যেদি সব জানত থাইলে ডাক্তারের আর দরকার হত নি। পরেরটা তোর বেটাই হবে। তোখে আমি সব শিখি দুব।
🍂

যত হোক তারিনী প্রথম মা হয়েছে। মনের ভিতর তার খুশির উথাল-পাথাল। শুধু স্বামীর কথা ভেবে প্রথম মাতৃত্বের আনন্দকে সামান্য  আড়াল করে রাখে। কিন্তু পরক্ষনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,
— কেন আমি আনন্দ করতে পারব না? আমার তো এই প্রথম মেয়ে হয়েছে। আগের মেয়ে তো আমার মেয়ে নয়। ওই মেয়ের জন্য আমি কেন মন খারাপ করে থাকব? 
এই ছোট্ট ছোট্ট জিগ্যাসা গুলো কুল কাঁটার মতো বিঁধতে থাকতে তারিনীর মনকে। ক্রমে সেই ক্ষতের যন্ত্রণা ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে সুবলের সংসারে। 
তারিনী আর আগের মতো ঘর সংসার গুছায় না। বেশিরভাগ সময় কোলের মেয়েকে নিয়ে সময় কাটায়। বেশ টুকটুকে দেখতে হয়েছে মেয়েটা। অনেকটা তারিনীর মতো। আদর করে তারিনী মেয়েকে টুকি বলে ডাকে। গলায় নজর কাঠি পরিয়ে দেয়। কোমরে কালো কারে গুয়া বাবলার ছাল  আর জালকাঁঠি বেঁধে রাখে। তার মেয়ের উপর যেন কারো কুনজর না পড়ে। মনসাপাতায় লন্ঠনের কালি ধরে, তাতে সরসের তেল গুলে কাজল করে পরায়। সুবলকে ফিহপ্তায় এটা ওটা কিনে আনার হুকুম করে। ডিবা দুধ, পিতলের কাজল লতা,ঝুমঝুমি,লাটিম, ছোটদের পাউডার, জামা আরো কত কি। মাধুর জন্য কোন কিছু কিনে আনতে সুবল সাহস পায় না। আনলেই সংসারে তুমুল অশান্তি বাঁধে। সুবল অনুভব করে তারিনী আর আগের মতো নেই। শুধু কথার গড়নটাই রয়ে গেছে আগের মতো। তবে সেই কথার ভিতর ঝাঁজ বেড়েছে যেন ঝাটিলঙ্কার জ্বলুনি। তার বুড়ি মা'কে পর্যন্ত তারিনী আজকাল রেয়াত করে না। ঝুড়ে ঝগড়া করে। চারিবুড়িও ছাড়বে কেন! বাগদি ঘরের গিন্নিবান্নি বলে কথা। চারিবুড়ি কোমরে কাপড় বেচ দিয়ে গুঁজে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার মতো করে ঝুঁকেঝুঁকে লাফিয়ে গালিগালাজ শুরু করে।
— ছেলে হয়নি বলে আর একবারও কথা তুলবেনি তুমি। যদি তুল তো আমার একদিন কি তোমার…! 
—- কেন রে আঁটকুড়ি! একশ বার বোলব। তুই খাওয়াউঠু না পরাউঠু লো। কি করবি লো তুই?
—-- ওই রকম ভাষা বল্লে অন্ন আর জুটবে না ঘরে।
—- বেটাটাকে ত ওষুদ করে কেঁচা করে দিচু।  সাদে কি বলে দোজপক্ষের মাগ গজরা হাতি/ বরকে মারে তিনটা লাথি। বউ যতই ধিতিং লাচ করুক উ ছেনা কিছু বলবেনি। তোর অন্ন খাইনি লো,মোর বেটার অন্ন খাই।
—- ওই বেট বেটা করে ত মরে যাচ্ছ। আমার বেট হউ আর ঝি হউ তুমি বলার কে শুনি? সাত বজা কাঠের ত পাঁচ বজা  মড়াঙাঙাকে এগি গেছে,তবু এখনো তোমার তেজ দম্ফ যায়নি। অমন শাউড়ি থাকার চে না থাকা ভাল।
—- তোর শাপে মোরবোনি লো সগি,সব্বনাশি। গরুখাকি। বেটার মম্ম পরে বুজবি লো। মোর মুখে আগুন দিবার আছে তোর কে দেয় দেখবি। নরকেও থান পাবিনি। 
চারিবুড়ির মুখের সঙ্গে তারিনী পেরে উঠতে পারে না। সুবলও ঘরে নেই যে থামাবে দুজনকে। তবে থাকলে তার উপরে এক চোট নিত তারিনী কিন্তু তার উপায় নেই। ওদিকে টুকি চিৎকার করে কাঁদে। তারিনী শেষমেশ তাকেই দাবড়ানি দেয়। রাগ তাতেও কমতে চায় না সহজে। অগত্যা সব ঝড় পড়ে মাধুর উপর। হাজারটা কাজের ফিরিস্তি মেয়েটার কাঁধে চাপায়। সেদিন সামান্য ভুলভাল মানেই তার পিটে দু'চারটা চড়চাপড় পড়বেই। ওদিকে চারির মুখের বিরাম পড়বে না তখনো। এর ঘর ওর ঘর হয়ে গোটা বাখুল বলে বেড়াবে। 
—-শুনলু তরা, বউড়ির মুখের বেখান! যত হউ ত আমি একটা শাউড়ি! দুটা গেনের কথা আমি বোলবোনি ত কে বলবে? শুনি!  মোর ছেনাটাউ হইচে তেমনি। মাগ যা বলবে, তাই! আগে মোর শাউড়ি বোলত, শাগ টুন টুন, টুন/ সবার কথা ছেড়ে দিয়ে মাগের কথা শুন। তেম্নি হইচে মোর বেটাছেনাটা। তার উবরে দেখুনু মা মরা মেইছেনাটার উবরে কিরকম নানাস্তানি করেঠে। উ ত পেটের লয়,সতীনের! উ ত চোখের কাঁটা হবেই! লোকে বলে শতল মা  পুত্নার জাত। যদ্দিন আছি দেখব,আর চোখ বুজি যাই ত ফুরি গেল। যেমন কপাল লিয়ে এসচে। সে বউড়ি আমার ভাল ছিল গো। তার গুন তার কাছে। লাত মার ঝাটা মার লা' কাড়তনি সে। সব্বনেশা ভগমান কি যে রোগ দিয়ে পাঠাল গো! সে থাকলে এই চারি বাগদির কি এম্নি দুদ্দশা হোত গো! 
বলে সুর করে চারিবুড়ি গলা তেড়ে কেঁদে যাবে কিছুক্ষণ। তারপর কদিন শাউড়ি বউয়ে কোন কথা থাকবে না। যা কিছু চালাচালি হবে মাধুর মাধ্যমে। আবার কখনোে ঝগড়া গুরুতর হলে চারিবুড়ি বুচকি বেঁধে মাধুকে নিয়ে সোজা মেয়ের বাড়িতে উঠবে।

সুবলের চালচলন আগের থেকে অনেক বদলে যায়। এরই মধ্যে সে পিয়ন থেকে পোস্টমাস্টার হয়ে গ্যাছে।মাটির বাড়ির মেঝেকে পাকা করে। দেয়ালে রঙ চাপায়। টুঙিতে অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেয়। সুবল আজকাল খুব একটা মাঠ ঘাট যেতে চায় না। মজুর করে চাষবাস করে। ইস্ত্রি করা জামা ছাড়া পড়ে না। গলায় মোটা করে পাউডার ছড়িয়ে যায়। বাঁ হাতে  ঘড়ি এঁটে রাখে। পাড়ার মধ্যে সে একজন চাকুরে বলে কথা! বাখুল ঘরের লোকেরা তাকে মান্যগণ্য করে। দোষের মধ্যে ঘরে সারাদিন থাকতে পারে না। রবিবার টুকু সে গ্রামে থাকে। সুবলের কথাবার্তার ভোল পাল্টে গেছে অনেকখানি। এখন তার ঘরে সকালে পান্তাভাতের জামবাটি নিয়ে কেউ বসে না। সুবল একসময় চালভাজা খেতে খুব পছন্দ করত। ভেলিগুড় আর  মুড়ি গামছার খুঁটে ঝুলি বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে খেত। খুদ সিদ্ধ হাপুর হুপুর শব্দ করে খেত। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে আলের উপরে গেঁড়া উঠত। কাঁকড়া বেরোত গর্ত থেকে। সুবল গেঁড়া গুড়াতে, কাঁকড়া ধরতে ওস্তাত ছিল। আজকাল এসব সে পছন্দ করে না। রবিবার বাজার যায়। সারা সপ্তাহের ভূসিমাল বাজার করে আনে একবারে। তারিনীকে হাট যেতে দেয় না। সব্জি মাছ কেনার জন্য গেঁড়া সাঁতরাকে হাত খরচা দেয় সুবল। সে-ই ফাইফরমাশ খেটে দেয় তার।কথায় কথায সুবল এখন বলো,
— বুজলি বঙ্কা মোদের জাতটা মানুষ হবে না কোনদিন । একটু সভ্য হওয়ার চেষ্টা করল না জীবনে। সবদিন গালাগালি,মারপিট,হিংসা বিবাদ নিয়েই রয়ে গেল।
বঙ্কা বুঝতে পারে বন্ধুকে তার ভদ্র -সভ্য সাজার রোগে পেয়েছে। জাতের গন্ধ গা থেকে মুছে ফেলতে চায়।বঙ্কার কাছে সুবলের এই পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। গোটা ঢোলে তার বন্ধুর মতো অনেকেই আছে। বাগদি জাতের সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরির সুবিধা নিতে হামলে পড়ে। তারপর যেই সরকারি চেয়ারে বসে অম্নি জাতের তকমাটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। লোকের কাছে নিজের জাতের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে। তাতে বঙ্কার তেমন মাথাব্যথা নেই খুব একটা। বঙ্কা চিরকাল হিসাবী মানুষ। সুবলদের এই রোগের ফলে তার আমদানি হয় ভালমতো। ঢোলের বহু চাকুরে বঙ্কার কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয়। আসলে চলনে বলনে ভদ্রসভ্য সাজতে চাইলেও,জাতের স্বভাব মুছতে পারে না সহজে। বঙ্কা জানে বাগদি জাতটা বেহিসাবী। লবরচবরে ওস্তাদ। বঙ্কা তার দাদুর কাছে বাগদি জাতকে নিয়ে একটা শোলোক শুনেছে,বাগদির হাঁড়িয়ে যদি থাকে পান্তাভাত/ বাগদি তবে লাফাবে চোদ্দ হাত। এই লাফান ঝাপান জাতটার অধঃপতনের কারণ। বন্ধু সুবলের কথায় সায় দেয়,
— তুই ঠিকই বলেচু। একইরকম রয়ে গেলু তরা। তবে বাদ দে ত বাকিবদের কথা। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। নিজের কথা তুই ভাব দিখি। 
দুজন বন্ধুর এইসব সাতপাঁচ কথার মাঝখানে এসে পড়ে তারিনী। পাশটিতে আসন পেতে বসে। বঙ্কা দেখে তার বন্ধানীর হাতে বোনা আসন। সুযোগ পেয়ে বঙ্কা তারিনীর প্রশংসা করতে ছাড়ে না,
—- আসনটা নিশ্চই বন্ধানী নিজেই বুনেছ। দারুণ হইছে। উলের কালার গুলান ভালোই চয়েস করেছ। তা মোদেরকে দিলে মাদরি আর নিজের তৈরি আসনে নিজেই বসলে! ভাল!
তারিনী লাউ ফুলের মতো হাসি মেলে ধরে বলে,
—- আচ্ছা পরের বার থেকে এই আসনই দুব। ভাল হয়েছে বোলছো?
—-  দেখছু সুবলা তোর বউয়ের গুনগান কচ্ছি তাও বিশ্বাস করেনি। সে না কর করবে। আমি কিন্তু মন থিকেই বলেচি। তাবাদে আগে এদের সব ঘরে খেজুরপাতার তালই, তালপাতার তালচাটি, গুলামাথির চাঁচি পেতে দিত কেউ এলে। পিঁড়াও দিত বসতে। এই পথম তমার হাতে বুনা আসন দেখে সত্যিই অবাক হইচি!
বঙ্কার কথা শুনে তারিনীর মুখ চকচক করে ওঠে খুশিতে। পাশে বসে থাকা সুবলের মুখেও সেই ঔজ্জ্বল্যের প্রতিফলন দেখা যায়।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments