জ্বলদর্চি

শব্দ ছন্দের অপূর্ব মেল বন্ধনে একটি কবিতা মালা, 'বেহাগ বিধুর গীতি' /মিলি ঘোষ

শব্দ ছন্দের অপূর্ব মেল বন্ধনে একটি কবিতা মালা, 'বেহাগ বিধুর গীতি'

মিলি ঘোষ 


 প্রভাতের রাগিনীতে
  যে সঙ্গীত বেজেছিল
    সে সুর মিলায় অস্তরাগে--

প্রদোষের অন্ধকারে
  যে সঙ্গীত বেজেছিল
    বসন্তে নয়--তা বেহাগে।

আহা! কী অপূর্ব! 'সুর তরঙ্গ' কবিতাটি নিয়ে আর বলার কিছু থাকতে পারে না।

'বেহাগ বিধুর গীতি' বইটিতে কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ'র আরও একটি কবিতার কথা না বললেই নয়। 'বিচারের দরবারে' ---
  এলোমেলো হয়ে গেল
     জীবনের হিসেবের খাতা
  যোগফলে সবই শূন্য
     বিয়োগে ভর্তি হলো পাতা।
কবিতাটির প্রথম চার লাইনেই মূল বক্তব্য স্পষ্ট। হয়তো এ আমাদের সকলেরই মনের কথা। তবু কবি তাঁর সহজ সরল ভাষায় আমাদেরকে প্রাপ্তির খাতায় চোখ বোলাতে বাধ্য করেন। 

বলতেই হয় কবির 'ইঙ্গিত' কবিতাটির কথা। ঘড়ির টিক টিক শব্দকে তিনি বলেছেন, 'অনাগত কালের অভিমুখে অবিচল যাত্রার প্রতিধ্বনি ....'
কী ভয়ানক সত্য। যা আমরা এভাবে ভাবি না। আর যদি ভাবিও, প্রকাশ করতে পারি না। মাত্র নয় লাইনের ছোট একটি কবিতা। কিন্তু তার মধ্যেই রয়েছে জীবনের অত্যন্ত দামি কথাগুলোই। যা তিনি তাঁর কলমের জোরেই প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তাঁর 'সাধক' কবিতাটিতে যে শিল্পীদের কথা তিনি বলেছেন, তাঁরা তাঁদের শিল্প কর্মের মূল্য পান না বললেই চলে। দিন রাত এক করে তাঁদের শিল্প সাধনা চলে। তবু, তাঁদের না আছে অর্থ, না আছে মান, না আছে পরিচিতি। তাঁদের কথা ভেবেই সর্বজয়া দেবীর অসামান্য নিবেদন ...
    হে শিল্পী!
             অসীম আকুতি নিয়ে
             মৃন্ময়ী রূপে তুমি গড়েছিলে  
             চিন্ময়ী প্রতিমা।
যে কবিতার শুরুই এভাবে, তা শেষ না করে কি চলে যাওয়া যায়? 
      
কবির 'কথা দেওয়া ছিল' কবিতাটি মন ছুঁয়ে যাবে সকল পাঠকের।
এখানে তিনি মনুষ্য জীবনের বাস্তব দিকটি তুলে ধরেছেন। আমরা ভাবি এক। করি আর এক। ভালো কাজ করার আশ্বাস দিই। কিন্তু আমরাই হৃদয়হীন হয়ে যাই। সৃষ্টিকর্তার দানকে অস্বীকার করি। তাই কবি লিখেছেন,
         যার দানে দীর্ঘ জীবন--
             তাঁরই সাথে হলো প্রতারণা;
         কোন্ অধিকার আছে তবে
             পেতে পারি স্রষ্টার করুণা ?
কী প্রাঞ্জল কবির বক্তব্য! কী চমৎকার ভাব প্রকাশ! বারবার পড়ে দেখার মতো একটি কবিতা 'কথা দেওয়া ছিল'।
🍂

আবার 'ভুলের জীবন' কবিতাটিতে আমরা নিজেদেরকে ফিরে দেখি। আমাদের সমস্ত জীবনের ভুলভ্রান্তি বুঝতে বুঝতেই আমরা জীবনের একটা বড়ো অংশ পার করে ফেলি। যখন বুঝি, সেই ভ্রম সংশোধনের আর কোনও উপায় থাকে না। কবি এই কবিতায় সেকথাই বলতে চেয়েছেন...
   "ভুলগুলো সব পড়ল চোখে
   আধার যখন জীবন ঢাকে।" 
   
কবিতাটিতে শব্দের সঙ্গে ছন্দের বোঝাপড়া অতুলনীয়। তবে এ কবির একার কথা নয়। এ আমাদের সকলের কথা। আর এই জায়গাতেই কবির কাছে আমরা ঋণী থেকে গেলাম।

'প্রতিবেদন' একটি চার লাইনের কবিতা। যা অবশ্যই আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। করতে বাধ্য। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা থেকেই এই কবিতার সৃষ্টি। কবির চরম সত্য উপলব্ধি পাই আমরা এই কবিতায়। 
  "আশা যাওয়া সত্য জানি-- তবু কেন হায়
  মন কেন এ সত্য কখনও না মানে।"
  
গভীর বেদনার মাঝেও কবিতাটি মনুষ্য জীবনের অতি বাস্তব অনুভূতির প্রকাশ।

অসাধারণ লেগেছে কবির 'তারতম্য' কবিতাটি। আমরা জানি জীবনে ওঠা নামা সকলেরই আসে। পাশাপাশি এও দেখি, এই উত্থান পতন সবার ক্ষেত্রে সমান হয় না। 
কবি সর্বজয়া দেবীর কলমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
"প্রকৃতির পূর্ণতার মাঝে
   কেউ শোনে জীবনের গান--
     কেউ শোনে বিদায় রাগিনী"

কবিতাটির শব্দ চয়ন চোখে পড়ার মতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব যে হারিয়ে যায়নি, এ কবিতা তারই নিদর্শন।
             
এ ছাড়াও তাঁর লিখিত দয়া, স্বপ্ন বিলাস, ভাগ্যের চাকা, শেষ শয্যা, মুক্তো আমার, অন্তরালে রূপকার, সৈনিকের সন্ধান এমন আরও অনেক কবিতাই পাঠকের ভালো লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস।

কবি সর্বজয়া দেবীকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। তিনি শরীরে ও মনে ভালো থাকুন। আর তাঁর সৃষ্টি দিয়ে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করুন। 



Post a Comment

0 Comments