জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৭৯
শালবনে চায়ের গন্ধ
সূর্যকান্ত মাহাতো
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাঙালিকে বাংলাদেশের 'হাবা'(গাগড়া) মাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রশ্ন হল, বাঙালিকে তিনি এমন মাছের সঙ্গে তুলনা করতে গেছিলেন কেন? এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ওই মাছের মতো বাঙালিও নাকি সহজেই 'টোপ' গিলে ফেলায় অভ্যস্ত এক জাতি। (আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৯) তা বাঙালিদের মধ্যে কী দেখে প্রফুল্ল চন্দ্রের এমন ধারণা হয়েছিল যে বাঙালি সহজেই 'টোপ' গিলতে অভ্যস্ত? এর উত্তরে তিনি বাঙালির প্রিয় চা-পাণের কথাকেই উল্লেখ করেছেন।
চা-পাণ যে একরকম বিষ পান সেটা জেনেও ইংরেজরা কেবল বাড়তি অর্থ লাভের ব্যবসায়িক স্বার্থেই বাঙালিকে 'চা -খোর' করে তোলার 'টোপ'টি গেলাতে পেরেছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ব্রিটিশদের বাড়তি মুনাফা লাভের সেই কৌশলকে বর্ণনাও করেছেন। তাদের ধারণা ছিল "বাঙ্গালার পৌনে পাঁচ কোটি লোককে পরন্তু সমগ্র ভারতের ত্রিশ কোটি অধিবাসীকে চা-খোর করিতে পারিলে টাকার মাচায় বসিয়া টাকার ছিনিমিনি খেলা সম্ভবপর হয়--- টাকার গাছ পুতিয়া চুনি পান্নার ফল পাড়িয়া খাওয়া যায়।"(আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৯)
কিন্তু বাঙালি এমন টোপটি কি না জেনে শুনেই গিলে ফেলেছিলেন? এর কারণ হিসাবে প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন বাঙালি 'নাবালক' আর 'নালায়েক' জাতি বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।(প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৯) তাই হয়তো তারা 'টোপ' টি ধরতে পারেননি।
🍂জঙ্গলমহলে চা খাওয়ার চল বেশ কিছু দশক আগেও তেমন একটা ছিল না। গ্রাম থেকে দূরের বড় রাস্তায় কিছু কিছু চায়ের দোকান কয়েকটা হাতেগোনা ছিল মাত্র। তখন চা খাওয়াকে বিলাসিতা আর বড়লোকিপনা বলেই মনে করা হত। সাধারণ ঘরগুলোতে তো চা খাওয়ার কোন চল ছিল না। আরো গরিব পরিবারগুলোতে চা কেনার তেমন পয়সাও ছিল না। কেবল বাড়িতে কোন আত্মীয় এলে তাদের সম্মান রক্ষার্থে দোকান থেকে চা কিনে এনে চা বানিয়ে খাওয়ানো হত। সেটা একমাত্র অতিথিদের সম্মান রক্ষার্থেই। ব্যবহারের পর চা পাতার অতিরিক্ত অংশটুকু তুলে রাখা হত পরবর্তী অতিথি বা কোন আত্মীয়ের জন্য। জঙ্গলমহলবাসীরা নিজেরা খুব একটা চা খেত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চায়ের এই নেশাটা একটু একটু করে যেন বাড়তে লাগল। আত্মীয়ের জন্য বানানো অতিরিক্ত চা খেতে খেতেই হয়তো সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল সাধারণ পরিবারগুলোও। ধীরে ধীরে চাহিদা মতো বাড়তে লাগলো চায়ের দোকান। এখনতো প্রায় প্রতিটি গ্রামের মুখেই একটি নয়, কয়েকটি পর্যন্ত দোকান গজিয়ে উঠেছে। জঙ্গলমহলের প্রতিটি বাড়িতেই এখন দিন শুরু হয় চা দিয়ে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে খাঁটি কথাটাই বলে গেছেন, আগে 'কা কা' শব্দে মানুষ বিছানা ছাড়তো, এখন 'চা চা' ডাক দিয়ে শয্যা ত্যাগ করে। (প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৯১)
জঙ্গলমহলের চা দোকান গুলোর প্রকৃতিও অনেকটা একই রকম। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে চায়ের দোকানগুলোতে চা খেতে খেতে বসে আড্ডা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে চা দোকানের এই আড্ডা কিছুটা আবার চিত্ত বিনোদনও বলা যেতে পারে। সেখানে যেমন তর্ক হয়, মারামারি কিংবা হাতাহাতিও হয়, তেমনি বন্ধুও গড়ে উঠে। অনেকে আবার তাদের জ্ঞানের বহরও প্রকাশ করে চায়ের এই আড্ডায়। 'সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ' তার 'ভারতবর্ষ' নামে একটি ছোটগল্পে চা দোকানের যে একটি নিখুঁত ছবি বর্ণনা করেছেন। সেই বর্ণনার সঙ্গে জঙ্গলমহলের চা দোকানগুলোর তেমন একটা পার্থক্য নেই। সেই গল্পে চা দোকানের আড্ডা ও তর্ক বিতর্ক প্রসঙ্গে 'মুস্তাফা সিরাজ' লিখেছেন," তর্কের কোন প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ নেই--- একটা কিছু পেলেই হলো।... বোমবাইয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা গায়ক, অথবা ইন্দিরা গান্ধী, মুখ্যমন্ত্রী, এম. এল. এ.--- নয়তো সরা বাউরি সে- সবই এসে পড়ে। জোর কথা কাটাকাটি হয়, চা ওলার বিক্রিবাটা বাড়ে। ধানের মরশুম--- আজ না হোক, কাল পয়সা পাবেই, তাই ধারের অঙ্ক বেড়ে চলে।" ধারে চা খাওয়াটা মূলত গ্রামের দিকের দোকানগুলোতে বেশি চলে।
এই যে জঙ্গলমহলের মানুষ মাটির কলসির জল, ঘোল, শরবত ভুলে চায়ে মেতে উঠল তা কি এমনি এমনি। চায়ের কি কোনও গুনাগুন নেই? প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন, কিছুই যে নাই তা নয় তবে হোমিওপ্যাথির কয়েকটি ফোঁটার সঙ্গেই তাকে তুলনা করেছেন। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ বসু চায়ের গুণ সম্পর্কে বলেছেন, পরিশ্রমের পর চা পান শরীরকে আরাম দেয়। চা খেলে রাত জাগা যায়। অর্থাৎ চা নিদ্রা হরণকারক। এই গুণ নাকি আবার গ্রিন টিতেই বেশি মেলে। এদিকে ডাক্তার 'বাইলিং' এর মতে, চা স্নিগ্ধকারক, উত্তেজক, ঔষধের নেশা নিবারক, শ্রান্তিনাশক। মেদোরোগ নিবারক। স্যার হাম্ফ্রি ডেভির মতে গ্রিন টি তে ট্যানিন(Tannin) এবং কালো চা তে এক ধরনের উদ্বেয় তরল থাকে।(বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খন্ড, নগেন্দ্রনাথ বসু, পৃষ্ঠা- ২০৪) তবে গুণের থেকে অগুণ বা ক্ষতিকর দিকটিও কম নয়। প্রফুল্লচন্দ্র রায় তার প্রবন্ধের শিরোণাম দিয়েছেন, "চা পান না বিষ পান?"(চা যদি বিষ-ই হয় তাহলে তিনি শেষে প্রশ্নচিহ্ন টা রেখে দিলেন কেন? এটা বিতর্কিত) তারপরেও চা যে ক্ষতিকর সেটা একরকমের সত্যি। কারণ 'বিষ' কথাটা তিনি সচেতন ভাবেই ব্যবহার করেছেন। চা কে তিনি বলেছেন উত্তেজক(স্টিমুলেন্ট)। চায়ের একটি ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর দিক হিসাবে তিনি বলেছেন, এটি ক্ষুধামান্দ্য অর্থাৎ খিদা নষ্ট করে। সর্বোপরি এটি একটি নেশা দ্রব্য। কিন্তু এটি যে নেশাদ্রব্য সেটা কীভাবে প্রমাণিত হয়! কারণ নেশা দ্রব্যগুলো সময়মতো না পেলেই আমাদের শরীর বারবার যেভাবে সাড়া দিতে থাকে চা-ও ঠিক সেরকমই। প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলছেন, যারা চা নেশাগ্রস্ত(Addicted) তারা সময় মতো চা না পেলেই তাদের হাই ওঠে, গা গুলোই, মন অস্থির ও চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। (পৃষ্ঠা- ৪৯০, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড) অর্থাৎ চা ছাড়া কোন কাজেই তাদের মন বসে না। মনটা কেবল 'চা চা' করতে থাকে। সুতরাং একে নেশা ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়।
কালো চা(Black Tea), বোহিয়া(Bohya) ব্রিক চা(Brick Tea) হরিৎ চা(Green Tea) হাইসন(Hyson), বারুদ চা(Gunpowder Tea) প্রভৃতি চায়ের এই যে বিভিন্ন রকমের সব নামকরণ এগুলো সবই চিনাদের দেওয়া। তারা চায়ের রং আর যে স্থানে উৎপত্তি সেই স্থানের নামেই এমন নামকরণগুলো করেছেন। ভারতে প্রথম চা আবিষ্কার করেন ১৮১৯ সালে আসামের কমিশনার ডেভিড স্কট সাহেব। তিনি সে সময় ভারতীয় গভর্মেন্টের প্রধান সেক্রেটারি 'জি সুইন্টন' সাহেবকে মনিপুর থেকে কতগুলো চা পাতার নমুনা পাঠিয়েছিলেন। সেই নমুনা নাকি এখনো লন্ডনের 'লিনিয়াম' সভাগৃহে রাখা আছে।( বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খন্ড, নগেন্দ্রনাথ বসু, পৃষ্ঠা- ২০১) ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর তত্ত্বাবধানে এরপর ভারতে চা চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। চারা আনা হয়েছিল চিন থেকেই। কিন্তু নতুন চা বাগানে যে চায়ের ফলন হচ্ছিল তা প্রথমে ব্যবহারের যোগ্য হয়ে উঠছিল না। তাই চিন থেকে প্রশিক্ষণের জন্য লোকও আনা হয়েছিল (বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা- ২০১) পরে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে চা সম্বন্ধে আরো বেশি তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্রিটিশরা 'ফর্চুন' সাহেবকে চিন দেশে পাঠিয়েছিলেন। চা খাওয়ার সময় আমরা চায়ে যে সুগন্ধটা পাই সেটা চায়ের নিজস্ব গন্ধ নয়। ওতে আরো বিভিন্ন রকমের সুগন্ধী ফুল সংমিশ্রিত থাকে। 'ফর্চুন' সাহেব চিনে গিয়ে চায়ের সুগন্ধিকরণ কীভাবে বাড়ে সেটাও শিখে এসেছিলেন। চায়ের সুগন্ধ বাড়াতে কমলাফুল, মল্লিকাফুলের মতো বেশ কিছু সুগন্ধি ফুল চায়ে সংমিশ্রিত করা হয়। বিভিন্ন ফুলের জাত অনুযায়ী ওই সুগন্ধের স্থায়িত্ব নির্ভর করে।
তাই বলাই যায় চায়ের উপকার বা অপকার ভেবে নয়, কেবল চায়ের নেশায় মজেছে আজ জঙ্গলমহলবাসীও।
তথ্যসূত্র- ১) আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড
২) বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খন্ড/ নগেন্দ্রনাথ বসু
0 Comments