জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান /একাদশ পর্ব/দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান
একাদশ পর্ব

দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী


পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ

পৃথিবীর সাতটি শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকতের মধ্যে রাধানগর সমুদ্র সৈকত অন্যতম। সোনালী সৈকত থেকে সিকি মাইল দূর অবধি বঙ্গোপসাগরে কোমর সমান গভীর জল কাঁচের মত স্বচ্ছ, রং হালকা সবুজ। সামনের দিকে জলের নিচে বালুকণা, নুড়ি বা পাথরের ছোট ছোট টুকরো গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সিকি মাইল দূরের সবুজাভ জলের রঙ পরিবর্তিত হয়ে নীল হয়ে দূরে আরও দূরে গভীর সমুদ্রে যেয়ে গাঢ় কালো রঙ। মনে মনে ভাবছি জলের এই কালো রঙের জন্যই বুঝিবা আন্দামানকে কালাপানি বলা হত। ঢেউগুলি আস্তে আস্তে বেলাভূমিতে এসে আছড়ে পড়ছে, আর সেইসব ঢেউ ফুঁড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ুক্কু মাছ উঠে এসে রূপোলী ঝিলিক দিয়ে পুনরায় সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থেকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সময় সমুদ্রের বিভিন্ন রূপ দেখার পরেই সূর্যদেব আকাশ আর সমুদ্রের দিকচক্রবালে এক মুঠো আবীর ছড়িয়ে পাটে বসলেন। সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না, কারণ আমি তো সরস সাহিত্যের ছাত্র নই, আমি নীরস হিসাব শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং সারা জীবন সেইটি পেশা করে চাকুরী করেছি। অজস্র দর্শনার্থী ক্যামেরা ও মোবাইলে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য নিজেদের কাছে ধরে রাখতে আকুল প্রয়াসী হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। আমরাও অপটু হাতে কয়েকটি ছবি তুললাম। রাধানগর সমুদ্রসৈকতের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ২০০৪ সালের বিশ্ব বিখ্যাত 'টাইম ম্যাগাজিনে' প্রকাশিত নিবন্ধে রাধানগর সমুদ্র সৈকতকে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং পৃথিবীর সপ্তম শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত বলা হয়েছে। সমুদ্রে স্নান করা যায় স্বচ্ছন্দে। জলের তলায় কোন পাথর বা প্রবাল দ্বীপ নেই। রাধানগর সমুদ্র সৈকতের বাম দিকে গভীর অরণ্য ও নারকেল বীথি এবং দক্ষিনে আদিগন্ত নীল জলের সমারোহ।   
রাধানগর সমুদ্র সৈকত থেকে সন্ধ্যের সময় ফিরে এসে স্থানীয় বাজারে গিয়ে দেখলাম এখানকার সব অধিবাসীই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি শরণার্থী। এঁরা সবাই ১৯৬০ সালের মধ্যে এখানে এসে সরকারিভাবে পুনর্বাসন পেয়েছেন। বেশিরভাগ অধিবাসীরাই কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে যুক্ত। এঁদের দেখে মনে হলো না যে মূল ভূখন্ড থেকে সমুদ্রের বুকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কোন দ্বীপে আছি। ভাষা, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, গৃহনির্মাণ দেখে মনে হলো আমি বাংলার কোন জনপদে আছি। দুই একজনের সাথে সামান্য সময় কথাবার্তা বলে ফিরে এলাম আমাদের রিসর্টে। ডলফিন রিসর্টের চতুর্দিকের সীমানা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। রাত্রের দিকে ডাইনিং হলে খেয়ে আমরা সীমানার ধার দিয়ে বেড়ানোর একটি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের ঢেউগুলি নিস্তরঙ্গভাবে বেলাভূমিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে বসার জায়গা করা আছে এবং চারদিকে বিজলি বাতির ব্যবস্থা আছে। কিছুক্ষণ পদচারণা করার পরে আমরা আমাদের কটেজে ফিরে গেলাম। পরের দিনে সকালে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট করে রিসর্ট থেকে সকাল সাড়ে ন'টায় বেরিয়ে গেলাম। আমাদের এখান থেকে পরের গন্তব্যস্থল  নীল দ্বীপ বা শহীদ দ্বীপ। 
সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের লঞ্চ ছাড়লো নীল দ্বীপের উদ্দেশ্যে। ১৮ কিলোমিটার দূরের নীল দ্বীপে যেতে স্টিমারের সময় লাগে দেড় ঘন্টার মত। নীল দ্বীপে আমাদের থাকার জায়গা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালা 'হাওয়াবিল নেস্ট'-এ। জেটি থেকে অতিথিশালার দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার। আমরা একটি অটো করে অতিথিশালায় পৌছে দেখলাম আমাদের জন্য একটি দ্বি-শয্যা বিশিষ্ট শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর দেওয়া হল। এখানকার চেক্-ইন টাইম সকাল ১১ টা থেকে পরের দিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত। অতিথিশালায় দুপুরের লাঞ্চ করে আমরা একটি অটো করে বেরিয়ে পড়লাম লক্ষণপুর সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। তার পূর্বে নীল দ্বীপের সম্বন্ধে দু'একটি কথা বলছি। নীলদ্বীপ লম্বায় প্রায় চার কিলোমিটার এবং চওড়াতে ছ' কিলোমিটার।  দ্বীপের পশ্চিমে লক্ষণপুর এক নম্বর বেলাভূমি, উত্তরে ভরতপুর, দক্ষিণে রামনগর ও সীতাপুর সৈকত এবং পূর্বে বিজয়নগর। পোর্ট ব্লেয়ারের ৩৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে এই নীল দ্বীপ অবস্থিত  হ্যাভলকের মত এখানেও গ্রীষ্মে সর্বাধিক তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি এবং শীতকালে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শিক্ষিতের হার এখানেও শতকরা ৮৫ জন। ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস নীলের নাম অনুসারে দ্বীপের নাম হয় নীল দ্বীপ, পরবর্তীকালে দ্বীপের নাম হয় শহীদ দ্বীপ। ১৯৬০ সালের পূর্বে দ্বীপটি জনমানবহীন ছিল। ১৯৬০ সালের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ছিন্নমূল হিন্দু শরণার্থীদের এখানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। দ্বীপটির একটি বৈশিষ্ট্য অন্য দ্বীপগুলির তুলনায় এখানকার জমি সমতল, যার ফলে অধিকাংশ জায়গায় ধান ও শাকসবজির চাষ হয়। দ্বীপের বাসিন্দাদের প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত তরিতরকারি পোর্টব্লেয়ার ও অন্যান্য বসতিপূর্ন দ্বীপগুলিতে সরবরাহ করা হয়। দ্বীপের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মৎস্য শিকার করা। দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সুবাদে এখনো পর্যন্ত সবুজের আভা দেখা যায়। হ্যাভলকের মত পাঁচটি গ্রাম নিয়ে নীলদ্বীপ- এগুলি হল সীতাপুর, ভরতপুর, নীল কেন্দ্র, লক্ষণপুর ও রামনগর। এখানে উল্লেখ্য আন্দামানের পূর্বদিকে কুড়ি কিলোমিটার ব্যাপ্ত যে ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপমালা দেখা যায় তার মধ্যে শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ আজকের পর্যটকদের কাছে স্বর্গভূমি। অসংখ্য দ্বীপমালার সমষ্টিকে 'রিচিস আর্কিপেলাগো' বলা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ নৌবাহিনী জরিপকারী জন রিচি প্রায় উনিশ বৎসর এই সমস্ত জনহীন দ্বীপগুলিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমীক্ষা চালিয়ে ছিলেন। তাঁর তৈরি ভূতাত্ত্বিক ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ সালে কলোনি উপনিবেশ গঠনের উপযোগিতা উপলব্ধি করে রস দ্বীপে কলোনি উপনিবেশ, কারাগার ও ফাঁসির মঞ্চ স্থাপন করেন। ১৭টি দ্বীপ ও অসংখ্য খাঁড়ি নিয়ে এই দ্বীপমালার বেশীরভাগ অঞ্চল উঁচু-নীচু পর্বত ও গভীর জঙ্গলে আবৃত। তার মধ্যে হ্যাভলক দ্বীপ আয়তনে সর্বাধিক। হ্যাভলক দ্বীপ এবং রস দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গাতে এই নীলদ্বীপ। অতীতে এই অঞ্চলগুলি গ্রেট আন্দামানীজদের বাসভূমি ছিল।  
লক্ষণপুর সমুদ্রসৈকতের প্রধান আকর্ষণ 'ন্যাচারাল ব্রিজ' বা 'হাওড়া ব্রিজ'। কেন যে হাওড়া ব্রিজ নাম হয়েছে বোঝা যায় না। বেলাভূমিতে প্রবেশ করে বাঁ দিকে কিছুটা গেলে এই হাওড়া ব্রিজ। চুনাপাথরের পাহাড় যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে সেখানে শত শত বৎসর ধরে সমুদ্রের জলের ধাক্কা খেয়ে একটি যাতায়াতের রাস্তা সৃষ্টি করেছে যেটি পেরিয়ে ওপাশে যাওয়া যায়। তবে বেশি দূর না যাওয়াই ভালো, কারণ সমুদ্রে জোয়ারের সময় এই অঞ্চলগুলি জলে ডুবে যায়, ফলে ফিরে আসার পক্ষে খুব অসুবিধা হয়। পাহাড়ের উপরে গাছপালা। আমরা বিকেলের দিকে গিয়েছিলাম, তখন ভাটার সময়। সমুদ্রের বুকে ছোট ছোট পাথরের উপরে পা দিয়ে ওখানে যেয়ে সামান্য সময় কাটিয়ে আমরাও অন্যান্য পর্যটকদের মত ছবি তুললাম। এখান থেকে আমরা গেলাম ভরতপুর সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রে স্নান করার বা সানবাথ নেওয়ার একটি আদর্শ জায়গা। সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যাবস্থা আছে। কমবয়েসীরা সেগুলিতে অংশগ্রহণ করছে। বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে পদচারণা করে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম। অবশ্য সূর্যাস্ত প্রতিটি সমুদ্রসৈকতে প্রায় একই রকম। রুপোলি থেকে ডিমের কুসুম হয়ে সিঁদুর মেখে সমুদ্রের জলে সূর্যদেবের ডুব দেওয়া। গতকাল হ্যাভলকের রাধানগর সমুদ্রসৈকতেও একই জিনিস দেখেছি। ভরতপুর সমুদ্র সৈকত সূর্যোদয়ের জন্য বিখ্যাত। আগামীকাল সকালে যাওয়ার ইচ্ছা আছে যদি আকাশে মেঘ না থাকে। ভরতপুর সমুদ্র সৈকতের পরে রামনগর সমুদ্র সৈকতে, যেটি সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত, সেখানে আর যাওয়া হলো না। আমরা ভরতপুর সমুদ্র সৈকত থেকে আমাদের আবাসস্থলের উদ্দেশ্যে ফিরে এলাম। হ্যাভলকের মত সমুদ্র এখানে পর্যটক আবাস স্থলের পাশে নয়। রাতের খাবারের পর সীমানার মধ্যে কিছুক্ষণ পদচারণা করে বিছানায় গন্তব্য স্থল। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে এখান থেকে আমাদের বিদায় নিতে হবে দুটি রাত্রির অভিজ্ঞতা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। পরের দিন সকালে আকাশ মেঘলা থাকার জন্য সূর্যোদয় দেখতে ভরতপুর বিচে যাওয়া হলো না। সকাল ন'টার মধ্যে আমাদের অতিথিশালা ছেড়ে যেতে হবে। আমরা ব্রেকফাস্ট করে জেটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, কারণ আমাদের পোর্টব্লেয়ার ফিরে যাওয়ার স্টিমার সকাল সাড়ে দশটায়। দু'ঘণ্টা স্টীমারে করে সমুদ্রের বুকে জলবিহার করে পোর্ট ব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটিতে এসে পৌছালাম দুপুর সাড়ে বারোটায়। এখান থেকে আমরা স্টেট ব্যাঙ্কের অবকাশ কেন্দ্র রাজীব গান্ধী নগরে যেয়ে দুপুরের লাঞ্চ করার পরে বিকেলে মেরিন মিউজিয়াম দেখে ও সন্নিহিত মেরিনা পার্কে কিছু সময় অতিবাহিত করে সন্ধ্যের পরে ফিরে এলাম। পরের দিন সকালে আমাদের নর্থ বে দ্বীপ ও রস দ্বীপে যাবার লঞ্চের টিকিট কাটা আছে। 
                                                    পরবর্তী অংশ দ্বাদশ পর্বে

Post a Comment

0 Comments