পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮০
চাপড়া ষষ্ঠী
ভাস্করব্রত পতি
"চাপড় যায় ভেসে / ছেলে বাঁচুক হেসে’।
কোন এক দেশে এক বণিক বাস করত। তাঁর তিন ছেলে আর তিন বউ। সকলেরই ছেলেমেয়ে রয়েছে। বণিক আর বণিকের বউ কিন্তু তাঁর নাতি নাতনীদের মধ্যে ছোট বউমার ছেলেদের সকলের চেয়ে বেশি পছন্দ করতো। বণিকের বউ সারা বছর সব ধরনের ব্রতোপচার করতো।
একবার ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষ তিথিতে চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত পালন করার দিন ছিল। বণিকের বউয়ের ইচ্ছে হল যে, নতুন পুকুর কেটে সেই পুকুরের পাড়ে বসে চাপড়া ষষ্ঠীর পুজোর আয়োজন করবে। সেই কথা সে তাঁর স্বামীকে জানায়। স্ত্রীর আর্জি মতো বণিক একটি পুকুর কাটিয়ে দিল চাপড়াষষ্ঠী পূজার আগেই। পুকুর খুব গভীর করেই কাটানো হলো। কিন্তু সেই পুকুরে এক ফোঁটা জল মিললো না। বণিক আর বণিকের বউ তা দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। তাঁরা ভাবল যে, এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তাঁদের হয়ত কোনো ভুলভ্রান্তি হয়েছে। তাই জল মেলেনি।
এইসব ভেবে ভেবেই তাঁরা দু'জনে মা ষষ্ঠীর নামে উপোস করলো। সারা রাত না খেয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। আর মাঝরাতে স্বপ্ন দেখল যে, একজন সধবা স্ত্রীলোক এসে বলছে, “তোরা ওঠ, আমি ষষ্ঠী ঠাকুর! তোদের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে যদি ছোট বউয়ের ছোট ছেলেকে কেটে আমার নাম করে শুকনো পুকুরে তাঁর রক্ত ছড়িয়ে দিস্, তাহলেই দেখবি পুকুরের জল থৈ থৈ করছে। এটা না করলে কোনো সুবিধা মিলবে না "।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর স্বপ্নের কথা মনে করে অশুভ ভাবনায় তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়ল। বেশ কিছু সময় কান্নার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিল যে, মা ষষ্ঠীর আদেশ তাঁরা পালন করবেই। তাতে যত কষ্ট হয় হোক। সেই মোতাবেক তাঁরা সকলের অজান্তে ছোট বউয়ের ছোট ছেলেকে কেটে ফেললো। সেই কাটা ছেলের রক্ত পুকুরে ছড়িয়েও দিল। আর তৎক্ষণাৎ নতুন পুকুরটি জলময় হয়ে উঠল। তখন সবাই অবাক হয়ে ভক্তি গদগদ চিত্তে পুকুর ঘাটেই ষষ্ঠীর আরাধনা শুরু করল। উপচার হিসেবে পিটুলির পুতুল আর চাপড়া জলে ভাসিয়ে দিল।
এদিকে ছোট বউ কিন্তু মা ষষ্ঠীর আদেশের কথা কিছুই শোনেনি। জানতোও না। নিবিষ্ট মনে ছোট বউও ষষ্ঠীর পূজো করে পিটুলির পুতুল আর চাপড়া জলে ভাসিয়ে দিল। আর ঠিক সেই সময় জল থেকে তাঁর ছোট ছেলে সরাসরি তাঁর মায়ের কাছে উঠে এল। ছোট বউ তড়িঘড়ি তাঁকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে বললো, “তুই কখন কি করে জলে পড়ে গিয়েছিলি বাবা?” এই বলে তাঁকে খুব স্নেহ ও আদর করতে লাগল। সকলেই অবাক হয়ে গেল এই ঘটনায়।
সঙ্গে সঙ্গে ছোট বৌয়ের সব খবর বণিকের কাছে গেল। বণিক তখন পুকুর ঘাটে এসে ঘুমের সময় স্বপ্নে মা ষষ্ঠীর আদেশের কথা সবাইকে জানাল। শুনে সকলে খুব আশ্চর্যান্বিত হলো। এর পর বণিকের সব ছেলেদের সব বউয়েরা তাঁদের ছেলেদের কোলে নিয়ে আঁচলে কলা বেঁধে ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্যের কথা শুনতে বসল। ধীরে ধীরে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে বণিক অনেক ধনসম্পত্তি পেল। আর বণিকের বউ চারিদিকে মা ষষ্ঠীর প্রচার শুরু করে দিল জনগণের মধ্যে।
ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই চাপড়া ষষ্ঠী লৌকিক উৎসব পালন করা হয় মূলত ছেলে মেয়েদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য। শুধু তাই নয়, এতে পরিবারের সকলের মঙ্গলও হয়ে থাকে। উপরোক্ত ব্রত কাহিনী থেকে এটুকু বলা যায় যে এই লোকাচারের সাথে নরবলির সংস্পর্শ রয়েছে। বণিকের ছোট বৌয়ের ছোট ছেলেকে কেটে রক্ত ছড়ানোর কাহিনী সেটাই প্রমান করে। ড. শীলা বসাক লিখেছেন, "নরবলি সেকালের সমাজে প্রচলিত ছিল। কিছু ব্রতের মধ্যে নরবলি প্রসঙ্গ আছে। উদাহরণ হিসেবে বনদুর্গার ব্রতে বুক চিরে রক্ত দান করার প্রথার কথা জানা যায়। আবার মন্থন বা চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতকথার মধ্যে নরবলির ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়"।
এই মন্থন ষষ্ঠী বা চাপড়া ষষ্ঠী আসলে চর্পট ষষ্ঠী নামেও পরিচিত।
চৰ্পট পুং[ √চুপ, দীপ্তি + অট্ ( অটন্ )-ক]
১ চপেট, চাপড়।
২ বিস্তার, বিপুলতা।
৩ পর্পট, পাপর।
চর্পটা -- (স্ত্রী) ভাদ্র শুক্লপক্ষীয়া ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী।
চর্পটী -- (স্ত্রী) পিষ্টকবিশেষ।
'চাপ' বা 'চাপড়' বা 'চাপড়া' অর্থে করতলসদৃশ চওড়া মৃত্তিকাখণ্ড বোঝায়। চণ্ডীদাস লিখেছেন, “মাটি খোদাইয়া, খাল বানাইয়া. উপরে দেওল চাপ"। আবার শিবায়ন কাব্যে পাই, "ছোট হালুয়া হুঙ্কারে চোটায়ে তোলে চাপ"।
চাপড়া ষষ্ঠীতে উপকরণ হিসেবে দরকার হয় কাঁঠালী কলা, পিটুলি, খোল বা এঁটে। ভাদ্র মাসের ষষ্ঠীর দিন পিটুলির পুতুল তৈরি করে এবং চাপড়া তৈরি করে পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হয়। কোথাও কোথাও কলা গাছের বাকল আর নারকেল পাতার খিলি দিয়ে বিশেষ ধরনের নৌকা তৈরি করা হয়। সেই নৌকায় রাখা হয় পিটুলি দিয়ে তৈরি পুতুল এবং রিংয়ের মতো দেখতে পিটুলির চাপড়া। সেটিতে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। পুজো শেষ হলে সেই নৌকাটি জলে ভাসিয়ে দেয় ব্রতীনীরা। মূলত ছেলেদের মায়েরা এই লৌকিক উৎসবে যোগদান করেন। তাঁরা আঁচলে কলা বেঁধে ছেলেমেয়েকে কোলে নিয়ে চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতকথা শোনেন। এদিন ভাত খাওয়া চলেনা। তার বদলে লুচি, পরোটা খাওয়ার বিধান রয়েছে।
চর্পটা ষষ্ঠী বা চাপড়া ষষ্ঠীর লোকাচার বর্ণনায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, "পশ্চিমবাংলার ঘটিদের রীতি অনুযায়ী ভাদ্রমাসে দুর্গা ষষ্ঠীর ঠিক একমাস আগে শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে চাপড়া বা চর্পটা ষষ্ঠীর ব্রত পালন করার নিয়ম। সন্তানের ধনলাভের কামনায় এই ব্রত পালিত হয়। বর্ষার জল পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা ভাদ্রের নদনদী, খালবিলে যখন দুএকটা করে পদ্ম ফুটতে সবেমাত্র শুরু করেছে, বাতাসে যখন পুজো পুজো গন্ধ নিয়ে শিউলি ঝরতে শুরু করেছে তখন হয় চাপড়া ষষ্ঠী বা চপটা ষষ্ঠী। কাঁঠালী কলা, পিটুলী গোলা দিয়ে পুতুল বানিয়ে পুকুরে ভাসায় গ্রামের মায়েরা, সন্তানের কল্যাণে। আর মটর ডালের চাপড়া বানিয়ে তাওয়ায় সেঁকে মায়েদের খেতে হয়। তালের রস দিয়ে চাপড়া পিঠে বানিয়ে দেবীকে উৎসর্গ করেন কেউ। পুজো শেষে তা বাচ্চাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়"। প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই লৌকিক উৎসবটি এখন কেবল পুঁথির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
0 Comments