জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৮ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ৮

বিজন সাহা 

তভের 

নিলোভা পুস্তিন থেকে আমরা রওনা হলাম তভেরের পথে। পরিচিত পথ। ঘণ্টা দেড়েক পরে এলাম তরঝকে। আগেই ঠিক করেছিলাম এখানে কিছু খেয়ে নেব। তভেরৎসা নদীর আগে নেমে এক ক্যাফেতে ঢুকে হাল্কা খেয়ে নিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল একটু ভেতরে গিয়ে গির্জাগুলো দেখে যাওয়া। কিন্তু সময়াভাব। তাই আবার শুরু হল পথচলা। এখন আর যাত্রা বিরতি নেই। পথেই দেমিদ থাকার ব্যবস্থা করে নিল। তবে মহিলা ফ্রি হবেন আটটার পরে, তাই ঘরের চাবি হাতে পেতে দেরি হবে। সেদিক থেকে আমাদের খুব একটা তাড়া ছিল না। রিল্যাক্স মুডে চললাম আমরা আর তভেরে ঢুকে একটা সুপার মার্কেটে ঢু মারতেও ভুললাম না।  

তভের। সোভিয়েত আমলে এই শহরের নাম ছিল কালিনিন। সঠিক ভাবে বললে ১৯৩১ সালে তভেরের নামকরণ করা হয় কালিনিন। কেন কালিনিন? কে এই কালিনিন? মিখাইন ইভানোভিচ কালিনিন ছিলেন রুশ বিপ্লবী, সোভিয়েত রাষ্ট্রনেতা। ১৯১৯ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রধান। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুপ্রিম সোভিয়েতের সভাপতি। শ্রমিক-কৃষকের রাষ্ট্রপতি নামে পরিচিত মিখাইল কালিনিন ১৮৭৫ সালে তিনি তভের অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। আর তাই যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রাম, গঞ্জ, রাস্তা, ঘাঁট সব কিছু বিভিন্ন বিপ্লবীদের নামে নামান্তরিত হচ্ছিল তখন তভের নাম বদলে হয় কালিনিন। যুগের  সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না?    

আমার মনে পড়ে গেল ছাত্রজীবনের কথা। মনে হয় ১৯৮৮ সাল। সেবার ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা এক ক্রুইজে গেছিলাম – ভোলগায় জাহাজ ভ্রমণ। শুরু হয়েছিল ইয়ারোস্লাভল থেকে, পথে উগলিচ আর তভের হয়ে শেষে মস্কো এসে পৌঁছেছিলাম। না, আমরা খুব বেশি কিছু তখন দেখিনি, আশেপাশের কিছু কিছু জিনিস – মাত্র কয়েক ঘন্টার বিরতি। তাছাড়া ছাত্রজীবনে বেশ কিছু বাংলাদেশি এই শহরে পড়াশুনা করত, ওদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ফলে কিছু কিছু পুরানো স্মৃতি ছিল এই শহরটা নিয়ে। সেই ভ্রমণ থেকে এখনও যেটা স্মৃতিতে গেঁথে আছে তা হল শহর নিয়ে এক রুপকথা। শহর ও সমাধির বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে জানা যায় যে প্রাচীন কাল থেকেই এখানে জনবসতি ছিল। রূপকথা অনুযায়ী স্থানীয় রাজা ঈগল শিকার করতে গিয়ে তভের থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে এদিমোনভো নামে এক গ্রামে এসে গির্জার সামনে জটলা দেখতে পান। তিনি দেখেন সেখানে তার দলের একজন স্থানীয় মাতব্বরের সুন্দরী কন্যা ক্সেনিয়ার সাথে বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।  ক্সেনিয়ার রূপে রাজা এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি নিজেই তাকে বিয়ে করেন। এতে দলের সেই লোক প্রচণ্ড মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে নদীর অন্য তীরে সন্ন্যাস জীবন যাপন করতে শুরু করে।  

  🍂


তভের শহরের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন জনশ্রুতি চালু আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ভার্সন হল এখানে প্রথম জনপদ ছিল তভেরৎসা নদী যেখানে ভোলগায় পড়েছে সেখানে। পরে সেখানেই অত্রোচ মনাস্তির গড়ে ওঠে। খননকার্য  থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় যে ভোলগার ডান তীরে ত্মাকা নদীর পাশে একাদশ শতকে ছোট জনপদ ছিল। দ্বাদশ শতকে এটা ছিল ছোট্ট এক বানিজ্য কেন্দ্র। ১১৩৫ সালে রাজপুত্র ভসেভলোদ মস্তিস্লাভিচের লেখায় এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ধরা হয় যে তভেরৎসা ও ত্মাকি নদী যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে ১১৩৫ সালে তভের শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। তভেরৎসা নদী থেকেই এর নাম তভের। মস্কো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত তভের ভোলগার তীরে প্রথম বড় শহর। ১২৪৭ সাল থেকে এই শহর তভের রাজ্যের কেন্দ্র। এই বছর তভের আলেক্সান্দর নেভস্কির কাছে হস্তান্তরিত করা হয়। আর ১২৫২ ও ১২৫৫ সালের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে তভের তার ভাই ইয়ারোস্লাভের কাছে চলে যায়। তিনিই তভের রাজবংশের গোরাপত্তন করেন। তভেরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র ছিল তভের ক্রেমলিন। ১৩২৭ সালে তাতার – মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় তভের ছিল অন্যতম প্রতিরোধ কেন্দ্র। সে সময় তভের মস্কোর সাথে উত্তর পূর্ব রুশের রাজনৈতিক কেন্দ্র হবার প্রতিযোগিতায় নামে। তবে সেই প্রতিযোগিতায় হেরে ১৪৮৫ সাল থেকে মস্কোর অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়। ১৭৯৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তভের ছিল তভের প্রদেশের আর ১৯৩৫ সালে থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কালিনিন রেজিওনের কেন্দ্র। নতুন রাশিয়ায় সে অবশ্য পুরানো নাম ফিরে পায়। ১৭০৩ সালে জার পিটার দ্য গ্রেট নেভা নদীর উপর সেন্ট পিটার্সবার্গ (সাঙ্কত পিতেরবুরগ) শহর নির্মাণ করে সেখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তখন তভের হয় দুই রাজধানীর সংযোগ স্থল। সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনা (দ্বিতীয় ক্যাথেরিনা) এই শহরকে যাত্রা বিরতির স্থান হিসেবে বেছে নেন। ফলে এখানে নতুন করে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়, গড়ে ওঠে নতুন নতুন রাস্তাঘাট। কথিত আছে সেই সময় শহরের প্রধান রাস্তাগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হয় যাতে তারা মস্কো ও পিতেরবুরগ এই দুই রাজধানীকে সরল রেখায় সংযুক্ত করে।     

এখন প্রায় প্রতিটি বড় শহরের চলছে ব্যাপাক নির্মাণ কাজ। নতুন নতুন ঘরবাড়ি দেখা যাবে প্রায় সব জায়গায়। চোখের সামনেই দুবনা কিভাবে বদলে গেল। মস্কোর কথা আর নাই বা বললাম। তভেরও ব্যতিক্রম নয়। আরও একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে প্রচুর লোকজন আজকাল ফ্ল্যাটে ইনভেস্ট করে। কারণ ফ্ল্যাটের দাম কমে না বললেই চলে, আর ভাড়া দিতে পারলে তো কথাই নেই। অনেকেই শহরে এরকম ফ্ল্যাট কিনে সেগুলো ভাড়া দেয় আর সেই ইনকাম দিয়ে সংসার চালায়। এটা ইনফ্ল্যাশনের হাত থেকে সঞ্চয় রক্ষার একটা অন্যতম প্রধান উপায় এখানে। অনেকেই আবার দীর্ঘ মেয়াদি ভাড়া না দিয়ে এক দুই দিনের জন্য ভাড়া দেয় আমাদের মত ট্যুরিস্টদের কাছে। এতে অবশ্য ইনকাম বেশি। এতে দুটো সুবিধা। আমরা যারা যাই তারা হোটেলের চেয়ে কম দামে থাকতে পারি আর নিজেদের ইচ্ছেমত প্ল্যান করতে পারি। হোটেলে কিছুটা হলেও রুটিন আছে। তাই নিজেদের গাড়ি থাকলে সেটা সব দিক থেকেই সুবিধাজনক। তাছাড়া করোনার পরে হোটেলে কিছু কিছু রেস্ট্রিকশন ছিল, ছিল ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কড়াকড়ি। কিন্তু বাসায় সেসব আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা নেই। তবে এখানেও পাসপোর্ট দেখে আর দলের কারও পাসপোর্টের কপি ওদের দিতে হয়। তাই অনেক দিক থেকেই এ ধরণের ব্যবস্থা লোভনীয়। তবে এই সুযোগে অনেকেই যে সন্ত্রাসবাদী কিছু ঘটাতে পারে সেটাও মাথায় রাখা দরকার। 

সেই রাতে আমরা আর কোথাও বেরুলাম না। সময় কাটল পরের দিনের প্ল্যান করে। যদিও আমরা দিনের বেলায় রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে খেতাম, রাতের খাবার বাসায় খাব বলেই ঠিক হল। আমি নিজে রান্না করতে পটু। সে এক দারুণ গল্প। ১৯৮৩ সালে আমরা যখন মস্কো আসি তখন থেকেই রান্না করে খাই। রান্না করি মেস করে। এর মূল কারণ রুশ খাবার আমরা ঠিক হজম করতে পারতাম না। আসলে সেটাও মিথ্যে কথা। হজম করার জন্য খাবার খেতে বা অন্তত গলাধঃকরণ করতে হয়। আমরা সেটাই পারতাম না। আমাদের প্রায় কেউই দেশে রান্না করতে পারত না। আমি দেশে দু একবার চা করলেও অন্য কিছু আর করা হয়নি। একবার ক্লাবে সরস্বতী পূজায় পায়েসে হলুদ দিলে রান্না ঘরের পথ আমার বন্ধ হয়ে যায়। প্রস্তুতি পর্বে সেদিন আমার রান্নার ভার। কয়েক জন সিনিয়র ভাই এসেছে। আমি রান্না বসিয়ে সবার সাথে গল্প করছি। কিছুক্ষণ পর পর রান্না ঘরে গিয়ে দেখে আসি। এদিকে রাত অনেক। ওদের ফিরতে হবে। ওদের একজন রান্না ঘরে গিয়ে আমার রান্না দেখে বলল, «মুরগী যেভাবে সাঁতার কাটছে তাতে আজ আর খাওয়া হবে না। আমরা চললাম।» আসলে আমি মাকে দেখেছি বাড়িতে রান্না করার সময় ঝোল দিতে। তাই ঐ জল। পরিমাণ? পাত্রে যতটুকু ধরে। এতে অবশ্য শাপে বর হয়েছিল। এরপর যদি মেসে চাল ডাল বা মাংসের বাড়ন্ত হত আর অতিথি থাকত, মেসের লোকেরা আমাকে রান্না করতে পাঠাত। এটা দেখে সব অতিথি দুগগা দুগগা করে বাড়ি চলে যেত।  মোরাল – শুধু গুন নয়, দোষও অনেক সময় খুবই উপকারে আসে।  

আমরা যে বাসায় উঠলাম – সেটা একেবারে নতুন। সেখান থেকে রাতের তভের দেখা যাচ্ছে। দূরে চাঁদ ঝুলে আছে আকাশের বুকে – ঠিক যেন হার। আমরা এক রাতের জন্যই বাসা নিয়েছিলাম। কারণ দিলীপ তখনও ঠিক করতে পারেনি কয় দিন এখানে থাকবে। সকালে উঠে আবার শহরের দিকে তাকালাম। দূরে একের পর এক বিল্ডিং সোভিয়েত আমলে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাঝে গির্জার গম্বুজ কেমন যেন বেমানান মনে হচ্ছিল। বাসায় ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরুলাম শহর দর্শনে। দিলীপের প্রধান আকর্ষণ আফানাসি নিকিতিনের স্ট্যাচু। 

তভেরের কিছু ছবি পাওয়া যাবে এখানে 

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=242 

আর ভিডিও 

https://www.youtube.com/watch?v=hpqUls7_LsY

 

Post a Comment

0 Comments