জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—পশ্চিম আফ্রিকা কচ্ছপের কর্মফল /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—পশ্চিম আফ্রিকা 
কচ্ছপের কর্মফল
চিন্ময় দাশ 


এক বছর বন-জঙ্গলে ভারি দুর্ভিক্ষ। এক দানা খাবারও নাই কোথাও। পশু-পাখি কারও খাবার জোটে না। করারও নাই কিছু কারও। খুব কষ্টে দিন কাটে সকলের।
একদিন এক গিরগিটি বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে। মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে, এক চাষিকে দেখতে পেল। খেতের কাজে না গিয়ে, একটা পাথরের সামনে গিয়ে দঁড়াল লোকটা। ভারি কৌতুহল হোল ব্যাপারটা দেখে। সুড়ুত করে লোকটার পিছনে হাজির হয়ে গেল গিরগিটি।
এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে নিয়ে, পাথরটা ঠেলে সরিয়ে দিল লোকটা। কী অবাক কাণ্ড! পিছনে একটা গুহার মুখ! লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল। গিরগিটি আড়াল হয়ে রইল, দেখা যাক কী হয়।
বেরিয়ে এল যখন, লোকটার হাত ভর্তি কতকগুলো মিষ্টি রাঙা আলু। আবার পাথর চাপা দিয়ে, চাষি চলে গেল।
মওকা পেয়ে গেল গিরগিটি। দারুণ সুযোগ। চাষি চোখের আড়াল হতেই, পাথর সরিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। 
ঢুকে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! গাদা গাদা মিষ্টি আলু ভেতরে। থরে থরে সাজানো। তার তো আনন্দ ধরে না। দানা জুটছিল না পেটে। এখন একেবারে খাবারের খনির খোঁজ পেয়ে গেছে সে। টুক করে একটা আলু তুলে নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
এইবার একটাই কাজ হোল তার। প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। কে কোথায় দেখে ফেলবে, তার ঠিক আছে নাকি? চাষি পৌঁছবার আগেই গুহায় গিয়ে হাজির হয়ে যায় গিরগিটি। একটি করে আলু তুলে নেয়, আর বাড়ি ফিরে আসে। বসে বসে আয়েস করে খায় সারাদিন। পেটের চিন্তা উবে গেছে তার মাথা থেকে।
একদিন আলু নিয়ে ফিরছে। হঠাতই একটা কচ্ছপের সামনে পড়ে গেল। দোষ তার নিজেরই। একটু হুঁসিয়ার হওয়া দরকার ছিল। আসলে, এই অভাব অনটনের দিনে, আলুর একেবারে গুদাম আবিষ্কার করে, তার মেজাজ বেশ ফুরফুরে। কেউ দেখে ফেলার ভাবনাটা আজ মাথাতেই নাই তার।
কচ্ছপ দাঁড়িয়ে পড়েছে গিরগিটিকে দেখে। এই অভাবের দিনে, অমন টুসটুসে একটা আলু পেল কোথায় এ হতভাগা? এমন একটা আলু জোটাতে পারলে, সারাটা দিন দিব্বি কাটিয়ে দেওয়া যায়।
গিরগিটিকে বলল—করেছ কী, ভায়া? কোথা থেকে জোটালে অমন আলুখানা? 
গিরগিটি কম চালাক নয়। সহজে মুখ খুলবে না। ধানাই পানাই করতে লাগল। এদিকে কচ্ছপও ছাড়বার পাত্র নয়। নাছোড়বান্দার মত জিদ করতে থাকল। বাধ্য হয়ে গিরগিটি বলল—বলতে পারি, একটা শর্তে। 
--বলো, কী শর্ত। আমি রাজি। কচ্ছপের আর তর সইছে না।
-- শর্ত একটাই। কারও কাছে মুখ খোলা চলবে না। গিরগিটি বলল-- কথা থাকবে নিজের পেটের ভেতর।
কচ্ছপ বলল—অবশ্যই, অবশ্যই। কথা দিলাম তোমাকে।
🍂

--তাহলে কাল সকালে, ঠিক এই সময়ে এইখানটিতে এসে দেখা করবে আমার সাথে। আজ নিজের কাজে চলে যাও।
ঘরে ফিরে কচ্ছপের আর সময় কাটে না। কখন দিন ফুরোবে, কখন সকাল হবে। পরদিন সকাল সকাল এসে হাজির হয়ে গেল গিরগিটির জন্য। 
তখনকার দিনে কচ্ছপ যেমন দেখতে ছিল সুন্দর, তার দু’জোড়া পা-ও ছিল বেশ মজবুত আর বড় বড়।
যাইহোক, গিরগিটি এসে গেল সময় মতোই। দুজন মিলে রওণা দিল গোপন গুহাটার দিকে। সেখানে পাথর সরিয়ে দিতেই, পথ পরিষ্কার। ভেতরে ঢুকে কচ্ছপ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আলুর পাহাড় তার চোখের সামনে। কাঁড়ি কাঁড়ি মিষ্টি আলু ডাঁই করে রাখা। আহা, কী তাদের বাহারি লাল রঙ! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। 
সবাই জানে, কচ্ছপ খুব পেটুক। কিন্তু তার নিজের মনে হোল, সারা জীবন খেয়েও শেষ করা যাবে না, এত আলু মজুত আছে এই গুহাটার ভিতর।
গিরগিটি বলল—খুব সাবধানে কিন্তু। তাছাড়া, দেরি করা যাবে না।  মালিকের আসার সময় হয়ে আসছে। একটা করে আলু নিয়ে, চড়পট সরে পড়ি চলো। 
বলেই একটা আলু নিয়ে বেরিয়ে গেল গিরগিটি। কিন্তু কচ্ছপের লোভ বেশি। সে ঘুরে ঘুরে দেখল আলুর পাহাড়টাকে। অনেক বাছাবাছির পর, বড়স্ড় একটা আলু নিয়ে, কচমচ করে খেতে বসে গেল। গিরগিটি যে মালিক এসে পড়বার কথা বলেছে তাকে, গ্রাহ্যই করল না সেটা। 
পেটটা যখন বেশ ভারি হোল, তখন আলু নিতে শুরু করল কচ্ছপ। একটা নিল, দুটো নিল, তিনটা নিল। কতটা নিয়ে যেতে পারবে, সেটাও মাথায় নাই তার। লোভী হলে, যা হয় আর কী।
ওদিকে সেই চা চাষি যে এসে গুদামে ঢুকেছে, সে খেয়ালও নাই কচ্ছপের। চাষির চোখে পড়ে গেল, একটা কচ্ছপ তার আলু চুরি করছে। খপ করে কচ্ছপকে ধরে ফেলল লোকটা। 
--আরে হতচ্ছাড়া, তুই এখানে সেঁধিয়েছিস? আজ দফারফা করে ছাড়ব তোর। তার আগে বল, হদিশ পেলি কী করে তুই?
ধরা পড়ে কচ্ছপ তো ভারি ঘাবড়ে গেছে। তবে, স্বভাবে ভারি ধুরন্ধর সে। চটপট বলে দিল—আমার কী দোষ? একটা গিরগিটি ডেকে এনেছে আমাকে। 
--মিছে কথা বলবার জায়গা পাস না? চাষি রাগে চিতকার করে উঠল—কোথায় তোর গিরগিটি? 
--এই তো ছিল এখানে। তোমাকে দেখে সরে পড়ছে নিশ্চয়।
চাষি বলল—তাহলে আমাকে গিরগিটির কাছে নিয়ে চল। আগে কথাটা মোকাবিলা করি। তারপর দেখছি, কার মুণ্ডু ভাঙব আজ।
এদিকে গিরগিটি তো অতশত জানে না। সে ঘরে ফিরে, আরাম করে শুয়ে পড়েছে খেয়েদেয়ে। কচ্ছপ যে এমন বেকুবের মত আহাম্মকি করেছে ধরা পড়ে, সে জানেই না।
খানিক বাদে কচ্ছপকে বগল দাবা করে, চাষি সেখানে এসে হাজির। দেখে তো গিরগিটির বুক হিম। বেশ বুঝে গেল, আজ আর রেহাই নাই। কেন যে মরতে হতভাগাটাকে নিয়ে গিয়েছিল! 
চাষি গর্জন করে উঠল—এই হতভাগা, তুই কচ্ছপকে আমার গোলাঘরে নিয়ে গেছলি? 
জবাব দেবে কী! সেই মেঘের মত গর্জন শুনে, তোতলাতে লাগল বেচারা। তবে, মনে মনে বেশ বুঝতে পারছে, সত্যি কথা বললে, কপালে মরণ আছে আজ। কোনরকমে চিঁচিঁ করে বলল—কী যে বলো, তার ঠিক নাই। আজ কতোদিন একটা দানাও পড়েনি পেটে। না খেয়ে খেয়ে, মরতে বসেছি আমি। তাছাড়া, কোথায় তোমার গোলা, আমি জানব কী করে? নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছো সব। খিদের জ্বালায় কাতরাচ্ছি আমি। 
দেখে আর শুনে, চাষিরও মনে হোল, ঠিক কথাই বলছে গিরগিটি। ধরা পড়ে, এখন এই বেচারার ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে কচ্ছপটা। রাগে গরগর করে উঠল লোকটা—বুঝেছি সব। এটাই যত নষ্টের গোড়া। আজই ওর খেল খতম করে দিচ্ছি আমি। 
একটা পাথরের ফাটলে গিরগিটির বাসা। কচ্ছপটাকে সেই পাথরে সজোরে এক আছাড় লাগাল চাষি। গটগট করে বেরিয়ে গেল গজগজ করতে করতে। 
পাথরে ঘা খেয়ে নিদারুণ অবস্থা কচ্ছপের। ধপ করে যখন নীচে পড়ল, তাকানো যায় না সেদিকে। সুন্দর রঙ-বেরঙের খোল ছিল কচ্ছপের পিঠে। সেটা ভেঙে চুরমার। টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। পাগুলো প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও নাই বেচারার। যন্ত্রণায় চিতকার করছে কচ্ছপ। 
ঘাসের নীচে, ঝোপঝাড়ের ভিতর, পাথরের ফাটলের ফাঁকে ফাঁকে যত পোকামাকড় ছিল, সবাই বেরিয়ে এসেছে চিতকার শুনে। কচ্ছপের অবস্থা দেখে, কথা সরছে না কারও মুখে। 
এক বুড়ি মাকড়সা নিজের ফাঁদে বসে দেখছিল সব। সে বলল—গিরগিটি তোমার উপকার করেছিল। আর  তুমি কি না তার সাথেই বেইমানি করছিলে! ঠিক সাজাই হয়েছে তোমার। 
গিরগিটিও মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিতে লাগল তাতে। বুড়ি বলল—যাকগে, যা হবার তো হয়ে গেছে। তা, প্রাণে যখন মরোনি, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমার। 
এলাকায় যত মাকড়সা, সব্বার ঠাকুমা হোল এই বুড়ি। নাতিপুতিদের সবাইকে ডেকে এনে জড়ো করল। বুড়ির কথায়  ছড়ানো ছিটানো খোলের টুকরোগুলো সব জড়ো করল পোকামাকড়ের দল।
মাকড়সাদের মুখের লালায় ভারি আঠা। নাতিপুতির দল সবাই মিলে জুড়ে দিতে লাগল টুকরোগুলোকে। 
খোলটা জোড়া হয়ে গেলে, বুড়ি ঠাকুমা বলল—দেখতে একটু বেঢপ হয়েছে, এটা ঠিক। তবে, মজবুতও হয়েছে, বাছা। খোল নিয়ে ভয়ের কিছু নাই তোমার। কী আর করবে? বেঁচে তো থাকতে হবে। তবে, একটা কাজ অবশ্য হোল এতে। তোমার এই চেহারা যে-ই দেখবে, তারই মনে পড়ে যাবে—উপকারীর সাথে বেইমানি করতে নেই। তাতে এমন দশাই হয়।
সেদিন থেকে কচ্ছপের এমন চেহারা। পিঠের খোলটা দেখতে একেবারে তাপ্পি-তাপ্পা দেওয়া একটা বিতিকিচ্ছিরি জামার মতো। ছিল দুটো হাত আর দুটো পা। ভেঙেচুরে এমন দশা হয়েছে সেগুলোর, চারটেই এখন কচ্ছপের পা। চারটেতে ভর দিয়েই থপথপিয়ে চলাফেরা করতে হয় বেচারাকে। দরকার পড়লে, তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে পালাবে, সে উপায় আর নাই তার।
আর গিরগিটি? তারা আছে বেশ বহাল তবিয়তেই। যে কোন মানুষকে দেখলে, প্রথমেই তার মনে হয়, এ লোকটা সেই চাষিই নয় তো? প্রথমে চট করে একটু আড়ালে সরে পড়ে। আর, সেখান থেকেই মাথা নাড়তে থাকে দু’দিকে। মাথা নেড়েই বলে—যা করেছ, বেশ করেছ। একদম ঠিক করেছ।

Post a Comment

0 Comments