জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— লাওস (এশিয়া)পাপের শাস্তি/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প— লাওস (এশিয়া)
পাপের শাস্তি 
চিন্ময় দাশ 

এক বণিক বেরিয়েছিল জিনিষ বেচতে। ছোটখাটো ব্যবসা তার। গাঁয়ে গাঁয়ে গেরস্ত বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বিক্রিবাটা করতে হয়। একদিন ঘুরতে ঘুরতে সূর্য ডুবে গেল। ঘরে ফেরার উপায় নাই আজ আর।
অগত্যা এক সরাইখানায় ঢুকল রাত কাটাবার জন্য। সরাইওয়ালার বউ বেশ খাতির করে, ঘর খুলে দিল তাকে। 
পুঁটলিটা ঘরের এক কোণে রেখে, বিছানায় গড়িয়ে পড়ল বণিক। বউটিকে বলল—রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়ি দিলে ভালো হয়, অনেক হাঁটতে হয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারলে, সকাল সকাল বেরুতে পারব। 
বউটি বলল—সে তো অবশ্যই। চিন্তার কিছু নাই। চটপট খাবার বানিয়ে দেব আমি।
কথা বলছে, আর চেয়ে চেয়ে দেখছে পুঁটলিটাকে।
রান্নাঘরে কাজে বসেও, মনে সেই এক পুঁটলির ভাবনা। স্বামীকে ডেকে চুপিচুপি বলল—লোকটার পুঁটলিটা সরিয়ে ফেললে কেমন হয়?
--পুঁটলি সরিয়ে ফেলব? তার তো মাথায় ঢুকল না ব্যাপারটা।
--হ্যাঁগো, হ্যাঁ। পুঁটলি সরিয়ে ফেলব। অনেক টাকাকড়ি, জিনিষপত্র আছে নিশ্চয় ওতে। 
--তারপর সকালে উঠে কী জবাব দেব? স্বামীর মনে কিন্তু-কিন্তু ভাব।
সে সকাল হলে, তখন দেখা যাবে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে, একটা গোল বাধিয়ে দিলেই হোল। মারধোর করে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে তখন। তুমি শুধু উপায় বার করো একটা। 
লোভ এসে গেল লোকটার মনেও। সে বলল—উপায়ের আবার অভাব আছে না কি? এক হাজার একটা উপায় আছে এর। 
🍂

বউ গজগজ করে উঠল—হাজারটা তোমার কাছে জমিয়ে রাখো। এখন কেবল একটা উপায় বলে দাও আমাকে। 
সরাইওয়ালা বলল—মেগা গাছের এক মুঠো পাতা তুলে আনো। তরকারির সাথে মিশিয়ে দাও। তারপর দ্যাখো, কী হয়? 
বউর তো আনন্দ ধরেনা। তবে যত না আনন্দ, তার চেয়ে বেশি কৌতুহল। খাবারে পাতা মিশিয়ে দিলে, উপায় হয়ে যাবে? 
স্বামীকে ধরে পড়ল—বলো না গো, কী হবে? আমার তো মাথায় কিছু আসছে না।
--খাওয়া শেষ না হতে ঘুম আসবে। ভালো করে ঘুম না আসতে, কোন না কোনও একটা জিনিষ তার মাথা থেকে মুছে যাবে। বণিক মানুষ। নিজের মালপত্তর ছাড়া, তার মাথায় আর কী থাকবে? সেটাই ভুলে যাবে যাবার বেলায়। ঝোলা ফেলেই চলে যাবে। তোমাকে তার ঘরে ঢুকতেই হবে না চুরি করতে। এখন নিশ্চিন্তে থাকো, আর খেলা দেখতে থাকো। 
বণিক তো আর এসবের কিছু জানে না। সে খাওয়া শেষ করে, বিছানায় গড়িয়ে গেল। সারাদিন ছোটাছুটি গেছে। সাথে সাথেই ঘুম। ঘুমের কোন অতল রাজ্যে তলিয়ে গেল মানুষটা। স্বামী-স্ত্রীও খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। 
সবে সকাল হয়েছে।  ঘুম ভেঙে গেল বউয়ের। বিছানা ছেড়ে, বণিকের ঘরের দিকে উঁকি দিতে গেল। 
একটু বাদেই বউয়ের চিৎকার। ঘরে ঢুকে দেখেছে, পুঁটলিটা ঘরের কোণে নাই। বিছানাও খালি। সেখানেও কেউ নাই। সব ভোঁ-ভোঁ। পাখি উড়ে গেছে ভোর না হতেই। অমনি নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠেছে। 
পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এসেছে সরাইওয়ালা—কী হয়েছে গো? অমন করে চেঁচালে কেন? 
--কী আবার হবে? নিজের চোখেই চেয়ে দেখ। লোকটা চলে গেছে। যাওয়ার সময় কিছুই ভুলে যায়নি সে। পোঁটলা-পুঁটলি যত্ন করেই নিয়ে গিয়েছে নিজের সাথে। তোমার মুরোদ বোঝা গেছে। ঘাসপাতা খাইয়ে স্মৃতি মুছে দেওয়া যায় কখনও? 
--যায়, যায়। কিছু না কিছু একটা ভুলে তাকে যেতেই হবে। না হয়ে পারে না। দ্রব্যগুণ বলে কথা। বিফলে যেতেই পারে না।  
বউ চেঁচিয়ে উঠল--না হয়ে পারে না নয়, হয়েছে। কিছুই ভুলে যায়নি সে।  
লোকটা বলল—দাঁড়াও তো, একটু ভাবতে দাও আমাকে। এমনটা হয় কী করে? 
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—ভুলেছে। সকালে যাবার আগে, আমাদের ভাড়া দিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। বলেছিলাম না তোমাকে, কিছু একটা তাকে ভুলতেই হবে। ঠিকঠাক মিলেছে তো কথাটা?
তখন কী আর করবে? বসে বসে কপাল চাপড়াতে লাগল দুজনে।


Post a Comment

0 Comments