পর্ব ৮৪
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
স্বামীজীর ‘বর্ত্তমান ভারত’
স্বামী বিবেকানন্দ রচিত অপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘বর্ত্তমান ভারত’। এটিও উদ্বোধন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তী কালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় উদ্বোধন প্রকাশনা থেকে। এই গ্রন্থটির ভূমিকায় স্বামী সারদানন্দজী লিখছেন -- “স্বামী বিবেকানন্দের সর্ব্বতোমুখী প্রতিভাপ্রসূত ‘বর্ত্তমান ভারত’, বঙ্গসাহিত্যে এক অমূল্যরত্ন। তমসাচ্ছন্ন ভারতেতিহাসে একটা পূর্ব্বাপর সম্বন্ধ দেখা অতি কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে। স্থূলদৃষ্টি সাধারণ পাঠক ইহাতে দুই চারিটি ধর্ম্মবিপ্লব বা রাজ্যবিপ্লব, অতি অসম্বদ্ধভাবে গ্রথিত ভিন্ন আর কিছুই দেখেন না। গবেষণাশীল যশোলিপ্সু পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতকুলের সূক্ষ্ম দৃষ্টিও, প্রাচ্য জাতিসমূহের মানসিক গঠন, আচার ব্যবহার, কার্য্যপ্রণালী প্রভৃতির দ্বারা প্রতিহত হইয়া, এখানে অনেক সময় সরল পথ ত্যাগ করে এবং কুজ্ঝটিকাবৃত কিম্ভূতকিমাকার মূর্ত্তি সকলই দেখিয়া থাকে। বিশেষতঃ যে শক্তি ভারতের অস্থিমজ্জায় প্রবিষ্ট, যাহার খেলা বৈদিক অধিকার হইতে বৌদ্ধাধিকার পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকার উচ্চভাব সমুদয়ের সমাবেশ করিয়া ভারতকে শিরোভূষণ করিয়াছিল, যাহার হীনতায় পুনরায় মুসলমান প্রভৃতি বিজাতীয় রাজগণের ভারতে প্রবেশ, সেই ধর্ম্মশক্তি পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের দৃষ্টিতে ছায়াময় অবাস্তব মূর্ত্তিবিশেষরূপে প্রকাশিত সুতরাং উহাদ্বারা যে জাতীয় উন্নতি এবং অবনতি সমাধান হইতে পারে, ইহা তাঁহাদের বুদ্ধির সম্পূর্ণ অগোচর। ব্যক্তিগত ভাবসমূহই সমষ্টিরূপে সমাজগত হইয়া জাতিবিশেষের জাতীয়ত্ব সম্পাদন করে। এই জাতীয়ত্বভাব ভিন্ন ভিন্ন জাতির পরস্পর বিভিন্ন বলিয়াই এক জাতির পক্ষে অপর জাতির ভাব বুঝা দুষ্কর হইয়া উঠে এবং সেই জন্যেই ভারতেতিহাস সম্বদ্ধভাবে বুঝিতে যাইয়া পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতকুল অনেক সময়ে বিফল মনোরথ হন। আমাদের ধারণা, ভারতে ইতিহাসের যে অভাব তাহা নহে কিন্তু উহার সম্বদ্ধ সংযোজনে ভারত সন্তানই একমাত্র সমর্থ এবং উহার যথার্থ পাঠক্রম তাঁহাদের পাঠক্রম তাঁহাদের দ্বারাই একদিন না একদিন আবিষ্কৃত হইবে। বহুল পরিভ্রমণ, গর্ব্বিত রাজকুল হইতে দরিদ্র প্রজা পর্য্যন্ত সকলের সহিত সমভাবে মিলন, ভারত এবং ভারতেতর দেশের আচারব্যবহার এবং জাতীয়ত্ব ভাবসমূহের নিরপেক্ষ দর্শন, অশেষ অধ্যয়ন এবং স্বদেশবাসীর প্রতি অপার প্রেম ও তাহাদের দুঃখে গভীর সহানুভূতির ফলে স্বামীজির মনে ভারতের যে চিত্র অঙ্কিত হইয়াছিল, ‘বর্ত্তমান ভারত’ তাহারই নিদর্শন স্বরূপ।
🍂 ‘বর্ত্তমান ভারত’ গ্রন্থটির সূচনাপর্বে পুরোহিততন্ত্রের প্রবল আধিপত্যের কথা প্রাঞ্জল ভাষা ও ভাবে লিখছেন স্বামীজী। লিখছেন --“বৈদিক পুরোহিত মন্ত্রবলে বলীয়ান্, দেবগণ তাঁহার মন্ত্রবলে আহূত হইয়া পানভোজন গ্রহণ করেন এবং যজমানকে অভীপ্সিত ফল প্রদান করেন। ইহলৌকিক মঙ্গলের কামনায় প্রজাবর্গ, রাজন্যবর্গও তাঁহার দ্বারস্থ। রাজা সোম ( সোমলতা -- বেদে উহা ‘রাজা সোম’ এই অভিধানে উক্ত ) পুরোহিতের উপাস্য, বরদ ও মন্ত্রপুষ্ট; আহুতিগ্রহণেপ্সু দেবগণ কাজেই পুরোহিতের উপর সদয়; দৈববলের উপর মানব-বল কি করিতে পারে? মানব-বলের কেন্দ্রীভূত রাজাও পুরোহিতবর্গের অনুগ্রহপ্রার্থী। তাঁহাদের কৃপাদৃষ্টিই যথেষ্ট সাহায্য, তাঁহাদের আশীর্ব্বাদ সর্বশ্রেষ্ঠ কর; কখন বিভীষিকাসংকুল আদেশ, কখন সহৃদয় মন্ত্রণা, কখন কৌশলময় নীতিজাল-বিস্তার, রাজশক্তিকে অনেক সময়েই পুরোহিতকুলের নির্দেশবর্ত্তী করিয়াছে। সকলের উপর ভয় -- পিতৃপুরুষদিগের নাম, নিজের যশোলিপি পুরোহিতের অধীন। মহাতেজস্বী জীবদ্দশায় অতি কীর্ত্তিমান্, প্রজাবর্গের পিতৃমাতৃস্থানীয় হউন না কেন, মহাসমুদ্রে শিশিরবিন্দুপাতের ন্যায় কাল সমুদ্রে তাঁহার যশঃসূর্য্য চিরদিন অস্তমিত; কেবল মহাসত্রানুষ্ঠায়ী, অশ্বমেধযাজী, বর্ষার বারিদের ন্যায় পুরোহিতগণের উপর অজস্র-ধন-বর্ষণকারী রাজগণের নামই পুরোহিতপ্রসাদে জাজ্বল্যমান। দেবগণের প্রিয়, প্রিয়দর্শী ধর্ম্মাশোক ব্রাহ্মণ্য-জগতে নাম-মাত্র শেষ; পরীক্ষিত জনমেজয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার চিরপরিচিত।
রাজ্য-রক্ষা, নিজের বিলাস, বন্ধুবর্গের পুষ্টি ও সর্ব্বাপেক্ষা তুষ্টির নিমিত্ত রাজরবি প্রজাবর্গকে শোষণ করিতেন।”
‘বর্ত্তমান ভারত’ গ্রন্থটির সাহিত্যমূল্য বিষয়ে সারদানন্দজী আলোকপাত করেছেন এইভাবে --“‘বর্ত্তমান ভারত’ প্রথমে পাক্ষিক পত্র ‘উদ্বোধনে’ প্রকাশিত হয়। অনেকের মুখে ঐ সময়ে শুনিয়াছিলাম যে, উহার ভাষা অতি জটিল এবং দুর্বোধ্য। এখনও হয়ত অনেকে ঐ কথা বলিবেন কিন্তু অদ্য আমরা সেই মতের। পক্ষাবলম্বন করিয়া ভাষার দোষ স্বীকার পূর্ব্বক ‘বর্ত্তমান ভারত’ উপহার হস্তে সলজ্জভাবে পাঠক সমীপে সমাগত নহি। আমরা উহাতে ভাব ও ভাষার অদ্ভুত সামঞ্জস্য দেখিয়া মোহিত হইয়াছি। বঙ্গভাষা যে অত অল্পায়তনে অত অধিক ভাবরাশি প্রকাশে সমর্থ, ইহা আমরা পূর্বে কোথাও আর দেখি নাই।"
আরও পড়ুন
0 Comments