জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক বিনয় কুমার সরকার /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক বিনয় কুমার সরকার

নির্মল বর্মন

 ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতির অধ্যাপক ও জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব বিনয় কুমার সরকার ২৬শে ডিসেম্বর ১৮৮৭ ভারতের মালদা জেলা তে জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকারের পৈতৃক নিবাস ঢাকা বিক্রমপুরের সেনাপতি, ১৯০১ সালে মালদা জেলা বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯০৫ এ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আঠারো বছর বয়সে "ঈশান" স্কলারশিপ  পান এবং ইংরেজি ও ইতিহাসের স্নাতক হন । ১৯০৬ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন। বিষয় অর্থনীতি।
১৯৬০ থেকে ১৯১১ অবধি বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদে অধ্যাপক থাকাকালীন মালদাতে অনেক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৯ সালে এলাহাবাদের পানিনি কার্যালয়ের গবেষক হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ বিশ্ব পর্যটনে যুক্ত ও বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক ও অধ্যাপক ছিলেন।
১৯২৬ থেকে ১৯৪৯ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।১৯ ৪৭ এ বিভাগীয় প্রধান হিসাবে মর্যাদা পান। অধ্যাপক সরকার  স্বাধীন ভারতের বাণী প্রচারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ২৪ শে নভেম্বর ১৯৪৯ এ ওয়াশিংটন ডি.সি তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার বহু ভাষাবিদ, "আর্থিক উন্নতি" পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রূপে, বিস্মিতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

       জাতীয় সমাজ বিজ্ঞানী বিনয় কুমার সরকার শুধু অর্থনীতি বা সমাজতত্ত্ব নয় ইতিহাসে, নৃতত্ত্ব ,রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের চর্চায় তাঁর খ্যাতি অসামান্য। নানা বিষয়ে প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব বিনয় কুমার নিজস্ব দর্শন ও বাগভঙ্গিতে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য মুদ্রিত করে গেছেন।
বিনয় কুমার ছাত্র থেকেই স্বাধীনচেতা স্বদেশ ভক্ত ছিলেন । সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ডন সোসাইটির সদস্য ও স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক সরকার ধনবিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার মাতৃভাষা সহ পাঁচটি ভাষায় লেখালেখি করেছিলেন ।তার রচিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। প্রায় ৩০ হাজার  পৃষ্ঠায় তাঁর লেখালেখির স্থান পেয়েছে। 
অধ্যাপক সরকারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলঃ-
   "নিগ্রোজাতির কর্মবীর" ; "ক্রিয়েটিভ  ইন্ডিয়া"; "হিন্দু সমাজতত্ত্বের বাস্তব ভিত্তি" ; "বর্তমান জগৎ"; "ধন দৌলতে রূপান্তর" ; "বিশ্বশক্তি হিসাবে হিন্দু সংস্কৃতি সূচনা"; "চিনা সভ্যতার অ-আ-ক-খ" ; "বাড়তির পথে বাঙালি"; ও "হিন্দুর দৃষ্টিতে চিনা ধর্ম"! এছাড়া ও ইংরেজিতে রচিত গ্রন্থ হলঃ- 
  "The political Ideas of Benay kumar Sarkar" ;
"The Science of History and the Hope of Mankind"; "Political Theories and Institutions of the Hindus"; "Sociology of young Asia"; "Economic Development " ; Villages and Towns as Social Pattern"!
🍂

        অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকারের সমাজতত্ত্বের প্রতি নিগুঢ় ধারণা, সহজ সরল নিজস্ব বাগভঙ্গিতে ও গদ্য রীতির পরিবেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ফলতঃ কঠিন ও জটিল বিষয়কে পাঠকের দরবারে প্রাঞ্জল করে তুলেছিলেন। গদ্য রীতির অবাধ গতিশীলতা , তথ্যের সমাবেশে প্রবন্ধ গুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। বিনয় কুমার সরকারের "বাড়তির পথে বাঙালী" গ্রন্থ থেকে 'বিবেকানন্দ দু-মুখো ছুরি' প্রবন্ধটি একটুখানি আলোচনা করা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে বিবেকানন্দকে বিশ্ববন্দিত চরিত্র হিসেবে তাঁর নিজস্ব ভাবনায় রসালো মন্তব্য করেছেন। কয়েকটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য --
*"ফরাসিকে, ইতালিয়ানকে , জার্মানকে, দুনিয়ার সাদা চামড়াওয়ালা সকল পশ্চিমী নরনারীকেই বিবেকানন্দ "কলা" দেখাইতেছে আর বলিতেছে--"বাপের বেটা হস তো  একে লড়ে" যা। দেখা যাউক কার মত মরদ , কার মগজে কতখানি ঘি, কার চরিত্রে কতখানি মনুষ্যত্ব"।
* "বিবেকানন্দ সাহিত্য এক বিপুল বিশ্বকোষ, ঠিক একখানা মহাভারত আর কি"!
*বিবেকানন্দের নীতির কথা বোঝাতে গিয়ে চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন---"লাগা কুস্তি জোরসে " , 'খা বেলা পেট ভরিয়া' , 'লোকসেবা' , ' জলদান , অন্নদান ও বিদ্যাদান'।
*বিবেকানন্দ সম্বন্ধে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, "বিবেকানন্দ যেন বলে বলছেন--"বাধা আসুক হাজার হাজার, বিঘ্ন আসুক পর্বত প্রমাণ । সবই তোর ব্যক্তিত্বের নিকট লোপাট হইতে বাধ্য"।
অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার প্রাবন্ধিক রূপে তার শব্দচয়ন ,ক্রিয়াপদের ব্যবহার ,স্পষ্টবাদিতা, সমাজতাত্ত্বিক ভাবনা-চিন্তা তথা নির্ভীক বক্তব্য পরিবেশনে দক্ষতা ও যোগ্যতা উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক সরকার সযত্নে কয়েকটি ক্রিয়াপদের ব্যবহার ও বেশ আকর্ষণীয়-- 'ঢুঁড়িয়া' , 'সমঝিয়া' 'হাঁটকাইয়া' ইত্যাদি ছাড়াও "ভারতবাসী তো ম্যাড়াকান্ত" ; "বাঙালীরা তো গরু" প্রভৃতি।
প্রাবন্ধিক বিনয় কুমার সরকারের পান্ডিত্য, প্রতিভা, রস বোধ, ভাষার প্রাঞ্জলতা, সংযুক্ত যুক্তিনিষ্ঠ নতুন ভাষা প্রয়োগ, সমাজের প্রতি আবাল্যভালবাসা সবকিছু মিলেমিশে ভারতীয় সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 27, 2023

    ভালো লেখা ভালো লাগলো। ড. নির্মল বর্মন এ ধরনের লেখা উপহার দিয়ে আমাদের পাঠকদের সমৃদ্ধ করছেন। শুভেচ্ছা

    ReplyDelete