জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৩ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৩ / সালেহা খাতুন 


ক্লাস এইট বেশ ফাইট করে কেটেছে। ফাইট কোনি ফাইট সবাই জানি। কিন্তু মণিও যে নিজেকে ফাইট মণি ফাইট বলেছিল এ কথা কজন জানেন?আমার বন্ধু সাগিরা আমাকে বলেছিল আমার বাবার নাকি আমাকে নিয়ে অনেক আশা। ওর বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে ও শুনেছে বাবা নাকি আমি যতদূর পড়তে চাইবো ততদূর পড়াবেন। আমাকে এম. এ. পড়াবেন। বাবা আমাদের পাড়ার সইদুলদার সঙ্গে মর্নিংওয়াকে যাওয়ার সময় নাকি এ কথা বলেছেন। সাগিরার কথা শুনে নিজের উপর আস্থা বেড়ে যায়। 

মাধ্যমিকের জন্য অঙ্কে ইংরেজিতে আলাদা করে যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করেন বাবা। স্কুলে তপনবাবু, শ্যামবাবুর কাছে অঙ্ক এবং জয়নাল সাহেবের কাছে ইংরেজি পড়তে থাকি। পান্নাবাবু যত্ন নেন ভূগোলে। বাবা ইতিহাসে। হেড মাস্টারমশাই বিশ্বনাথ বাবু, ধ্রুববাবু বাংলায় পারদর্শী করে তোলেন। নয়নবাবু জীবনবিজ্ঞানে। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট যাতে হয় তার জন্য স্কুলের মাস্টারমশাইরা গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি,পুজোর ছুটিতে আলাদা করে ক্লাস নিতে শুরু করেন। সুখেনবাবু, সলিলবাবু খেলার ক্লাসে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। দিদিমণি শেখান সায়া-ব্লাউজ, কার্ডিগান বানানো।
 এক্সটার্নালের কাছে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে যাই। আবৃত্তি করি রবীন্দ্রনাথের “বিদায়” কবিতা – “তবে আমি যাই গো তবে যাই/ ভোরের বেলা শূন্য কোলে /ডাকবি যখন খোকা বলে/বলবো আমি 'নাই সে খোকা নাই'।" এখন মনে হয় কবিতাটি আমি আমার স্কুলকেই শুনিয়ে ছিলাম। কেননা তাকে ছেড়ে আসার সময় বড়ো কাছে চলে এসেছিল। নাইন টেন এই দুটি মাত্র ক্লাস তখন শেষ করে টেস্ট পরীক্ষাও দেওয়া হয়ে গেছে। কুদ্দুস বাবুর কাছেও কিছুদিন অঙ্ক প্র্যাকটিশ করলাম।

 এই এতো যে দিন রাত এক করে পড়াশোনা তো রাতের অন্ধকারে পড়বো কীভাবে? একে কেরোসিনের শিখা তায় বরাদ্দ মাপা তেল। টাকা থাকলেও তেল পাওয়া যেতো না।পাশের বাড়ির মোতি বাবুরই দোকান থেকে কেরোসিন দেওয়া হতো। তিনি পাড়ার লোকের কাছে অনুরোধ করতেন মেয়েটার মাধ্যমিক পরীক্ষা ওদের এক দু লিটার তেল বেশি দিই। কেউ কর্ণপাত করতো না উপরন্ত বাধা দিত। বাবু তার নিজের অংশের তেল থেকে আমাকে কিছুটা দিতেন কেননা তিনি রাত তিনটেয় তাহাজ্জদের নামাজ পড়তে উঠে দেখতেন আমি পড়ছি।
🍂

দেখতে দেখতে এসে গেল মাধ্যমিক পরীক্ষা। বাসুদেবপুর হাইস্কুলে সীট পড়লো। নাইন টেনেই স্কুলে শাড়ি পরতে হতো। মাধ্যমিকও দিলাম শাড়ি পরে। অন্য স্কুল বলে বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন প্রথম কয়েকটা পরীক্ষায়। ঐচ্ছিক পরীক্ষার দিন আমি একাই যাই। মজার একটি বিষয় ছিল আমার। আমার ঐচ্ছিক পেপার ছিল পিসিকালচার অর্থাৎ মৎস চাষ।পরবর্তীতে মাছ চাষ না করলেও বাজারে গেলে মাছ চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমি অবাক হয়ে যাই অনেকেই ঠিকঠাক মাছ চেনেন না। আসলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প হয় না। আর এটা এমন একটা সম্পদ যা কেউ কেড়ে নিতেও পারে না। তিনমাস অপেক্ষার পর রেজাল্ট বেরোলো।
 
ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলাম। জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলাম। যেদিন রেজাল্ট বেরোলো নিজেকে স্থির রাখার জন্য সেলাই নিয়ে বসেছিলাম ছাদে। আমার বন্ধু সহপাঠী আশরাফ এলো। সালেহা সালেহা করে ডাকতে লাগলো। আমি বেরোতে বললো, অদুদবাবু বলে পাঠালেন তুই ছশো তিন পেয়েছিস। আমি শুনলাম তিনশো ছয়। কেননা ওটাই পাশ মার্ক। শেষ মুহূর্তের টেনশনে মনে হচ্ছিল পাশ করতে পারলেই হবে। ফলে মাকে জানালাম মা আমি পাশ করেছি। বাবা সন্ধ্যায় মিষ্টি নিয়ে ফিরলেন। বাড়ির সবার জন্য। আমার নম্বরটা বললেন। আমার পাগলামো দেখে বললেন গাধা কোথাকার! 
স্কুলে ক্লাস ফাইভ টু টেন আমি ফার্স্ট হলেও ক্লাস নাইনে অরুণ আমাকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। মাধ্যমিকেও তাই। অরুণ আমাকে অঙ্ক কষতে সাহায্য করতো। ফিনাইল সাবান তৈরি করা শিখিয়েছিল। ও ভালো আঁকতেও পারতো। আমার পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই করা হয় নি। আমার বন্ধু অরুণাংশু এখন হার্ট সার্জেন। বাবা যেমন তাঁর বিলেত ফেরত ডাক্তার বন্ধু শ্যামল রায়কে ( বোমু কাকু) নিয়ে অহংকার করতেন আমিও আমার বন্ধু অরুণকে নিয়ে গর্ব করি। নানান ক্রাইসিসে ওকে ফোন করে বসি। ও অভয় দিয়ে রেখেছে যখন খুশি ফোন করিস। ইতস্তত করি বলে বলেছে "ব্যস্ত থাকলে ধরবো না। রিং ব্যাক করবো।" 
(ক্রমশ)
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments