বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক অতুলচন্দ্র গুপ্ত
নির্মল বর্মন
ব্যারিস্টার, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক অতুলচন্দ্র গুপ্ত বারোই মার্চ আঠারোশো চুরাশি তে অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার বিল্লাইক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনিশশো এক এ রংপুর জেলা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন । কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও দর্শন শাস্ত্রে অনার্স পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাশ করেন। উনিশশো সাত এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন।
বাংলাদেশের রংপুরের জাতীয় বিদ্যালয় কিছুকাল চাকরি করেছিলেন। পরে রংপুর হাইকোর্টে প্র্যাকটিসও করেন। উনিশশো আঠারোতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের রোমান 'ল' , জুরিস 'ল' ও জুরিস প্রূডেন্সের অধ্যাপক হয়েছিলেন। এই সময় অতুলচন্দ্র গুপ্ত "Trading with the Enemy"প্রবন্ধ রচনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে " অনাথনাথ দেব" পুরস্কার লাভ করেন। আঠারোশো আঠাশ সালে পুনরায় আইন ব্যবসায় ফিরে যান। আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্ত ভারতীয় কংগ্রেস দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী'র কাছের বন্ধু অতুলচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্যকর্মে বৈদগ্ধ ,নান্দনিকতায় ভাস্বর ও বৈজ্ঞানিক মনন ও বিশিষ্ট রচনাশৈলী তাঁর রচিত "বৈজ্ঞানিক ইতিহাস" সবুজপত্রের পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।
অতুলচন্দ্র গুপ্ত পেশায় আইনজীবীও পরে ব্যারিস্টার হলেও হৃদয়বৃত্তিতে কোমল ও স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ। নগেন্দ্রনাথ সেন বাল্যকালেই অতুলচন্দ্র গুপ্ত'র মনে দেশাত্মবোধক সঞ্চারিত করেন। বিখ্যাত 'কাব্য জিজ্ঞাসা'র লেখক অতুলচন্দ্র গুপ্ত স্বাধীন বিচার-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতেন । প্রধানত ব্যবহারজীবী ও রসতত্ত্বের ব্যাখ্যাতা হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও সমাজ , শিক্ষা ,ইতিহাস রাজনীতি ইত্যাদি আলোচনায় তার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় মেলে। এহেনো মহান ব্যক্তিত্ব কালের অমোখ নিয়মে বারোই ফেব্রুয়ারি উনিশশো একষট্টী সালে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
🍂সাহিত্যিক অতুল চন্দ্র গুপ্ত'র কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলঃ-
"শিক্ষা ও সভ্যতা" ১৩৩৪ ; "কাব্য জিজ্ঞাসা" ১৩৩৫ ; "নদীপথে" ১৩৪৪ ; " জমির মালিক" ১৩৫১; "সমাজ ও বিবাহ" ১৩৫৩ ; "ইতিহাসের মুক্তি" ১৩৬৪।
রাইটার অতুলচন্দ্র গুপ্ত মহোদয় "কাব্য জিজ্ঞাসা" গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন-----
"১৩৩৩ সালের সবুজপত্রে কাব্যজিজ্ঞাসা নামে আমার যে - কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছিল, এই বইখানি, উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না করে ,সেই প্রবন্ধ গুলির একত্র সংগ্রহ মাত্র"!
অভিনব গুপ্ত ও আনন্দ বর্ধনের মত তথা সংস্কৃত আলংকারিকদের বিচার, মীমাংসার পরিচয় দিয়েছেন অতুলচন্দ্র। শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি," তাঁদের নানাস্থানে ছড়ানো মত ও কথাকে একসঙ্গে সাজিয়ে গাঁথতে হয়েছে, যার সুতোটি আমার । মাঝে মাঝে তাঁদের কথাকে প্রাচীন পরিচ্ছদ ছাড়িয়ে হালের পোশাক পরাতে হয়েছে । কিন্তু ঞ্জানতঃ তাঁদের মত কথাকে বিকৃত করে আধুনিক মত কথার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করি নি"।
ব্যারিস্টার অতুল চন্দ্রগুপ্ত মহোদয়ের "কাব্য জিজ্ঞাসা" পাঁচটি অধ্যায় সুবিন্যস্ত -" ধ্বনি, রস ,কথা ,ফল ও সাহিত্য"! কাব্যের তত্ত্ববিচারে 'রস' নামক কঙ্কাল কে নিয়ে যে নাড়াচাড়া তা বোঝাতে গিয়ে অতুলচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের "কঙ্কাল " গল্পের অবতারণা করতে কুন্ঠা বোধ করেননি। সেইসঙ্গে "রবীন্দ্রনাথ ও সংস্কৃত সাহিত্য " তুলণামূলক আলোচনাও আমরা দেখতে পাই। যেমন-
"রবীন্দ্রনাথের কাব্যে সংস্কৃত কাব্যের সুর, ধ্বনি ,ভাব ছড়ানো রয়েছে, কিন্তু তার আস্বাদ সংস্কৃত কাব্যের স্বাদ নয়। নব প্রতিভার নবীন রসায়নে তা থেকে নতুন রসের সৃষ্টি হয়েছে"। 'নদীপথে' পত্রাকারে রচনা করেছেন ভ্রমণ কাহিনী। এখানে ভ্রমণপিপাসু দৃষ্টি, মার্জিত ও পরিসীলিত মন ও ভাষার সাবলীল মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সাহিত্যিক।
প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্তের "ইতিহাসের মুক্তি" কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্ত 'অধরচন্দ্র মুখার্জি' বক্তৃতা সংকলন ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা প্রতিফলিত। "ইতিহাস" প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস ঐতিহাসিক তাৎপর্য ঐতিহাসিক ও কবি র পার্থক্য যুক্তি পরম্পরায় মন জুড়ানো ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত , -- "মানুষ অতীতের মধ্যে নিজেকে দেখতে চায়, ভবিষ্যৎকে নিজের স্পর্শ দিতে চায়। ইতিহাস এই আশঙ্কা নিভৃতির উপায়। কিন্তু যারা ইতিহাস লেখে ও যারা ইতিহাস পড়ে তারা একথা মানতে রাজি নয় যে, ইতিহাসের কাজ মানুষ সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহল মেটানো"।
সাহিত্যিক অতুলচন্দ্র গুপ্তের পাণ্ডিত্য ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রে সুচারুভাবে কাজে লেগেছিল ।তিনি সাহিত্য ,সমাজ শিক্ষা, দর্শন, ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক ছিলেন। রাজনৈতিক ,সামাজিক ও শিক্ষামূলক কার্যালয়ে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করতেন ।এমনকি গরীব দুঃখী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য ও গরীব রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতেন। এককথায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও তাঁর পান্ডিত্য,স্বতস্ফূর্ত রসবোধ, ভাষার প্রাঞ্জলতা, সংযত যুক্তি-নিষ্ঠা চিন্তা আপামোর জনসাধারণের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।।
0 Comments