সবুজ দ্বীপ আন্দামান
ত্রয়োদশ পর্ব
দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
আন্দামানে আজ সপ্তম দিন। সকাল সাতটাতে আমাদের গাড়ি এসে হাজির। আমাদের লাগেজ নিয়ে গাড়ীতে উঠলাম কারণ এখানে আমাদের থাকার মেয়াদ গতকাল রাত্রে শেষ হয়ে গেছে। আজ আমরা স্থলপথে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে জারোয়া অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল পেরিয়ে মধ্য আন্দামানে প্রবেশ করবো। সংরক্ষিত বনাঞ্চল পেরোণার নিয়ম সকাল নটার মধ্যে যে গাড়ি গুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রবেশপথ জিরাকাটাং পৌঁছাবে সেগুলিকে পুলিশ প্রহরায় বনাঞ্চল পার করিয়ে মিডলস্ট্রেট জেটিতে পৌঁছে দেবার পরে সেখান থেকে পুনরায় গাড়ির কনভয় ছাড়বে জিরাকাটাং-য়ের উদ্দেশ্যে। শেষ গাড়ির কনভয় মিডলস্ট্রেট থেকে বিকেল তিনটায় ছাড়বে। একই সাথে যাওয়া ও আসার গাড়ি ছাড়া হয় না। এখানে উল্লেখ্য যে সকাল ছটায় প্রথম গাড়ীর কনভয় শুরু হয় এবং বিকেল তিনটায় শেষ হয়।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে জিরাকাটাং চেকপোষ্টে আমরা যেয়ে পৌছালাম সকাল সাড়ে আটটায়। যেয়ে দেখছি সামনে অসংখ্য গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যারা প্রথম কনভয় যাওয়ার পরে এসে পৌঁছেছে। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম, সরকারী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যেককেই মানতে হবে। সকালের রোদে চারিদিক ঝলমল করছে, দূরে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনভূমি। রাস্তার দু পাশে অনেক দোকান তবে সেগুলোর বেশিরভাগই চা-বিস্কুট, মুড়ি-তেলেভাজা ও খাবারের দোকান। আমরা একটি দোকানে যেয়ে বাঙালির মুড়ি ও তেলেভাজার স্বাদ নিতে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম সব গাড়ির আরোহীরা ও ড্রাইভারেরা মে যার গাড়িতে উঠে বসে পড়ছেন। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এর পরে গাড়ি ছাড়া শুরু হবে। মনের মধ্যে কৌতূহল ও একরাশ উৎকণ্ঠা আন্দামানের আদিম অধিবাসী জারোয়াদের দেখার। অবশেষে সকাল নটা পনেরোতে গাড়িগুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশের কাগজপত্র পরীক্ষা করিয়ে যেতে শুরু করলো। দুপাশে বিস্তৃত আন্দামানের সুউচ্চ গভীর জঙ্গল। যেতে যেতে মনে হতে লাগলো হয়তো গাছের আড়ালে কোন জারোয়াকে দেখতে পাবো আমাদের দিকে বিষমাখানো তীর-ধনুক নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জারোয়া অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৩৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মিডলস্ট্রেট জেটিতে যেয়ে পৌছালাম। জঙ্গলে কোন জারোয়াকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলাম। অবশ্য এই দিনেই কদমতলা যাবার পথে জারোয়া স্ত্রী-পুরুষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সমুদ্রের খাঁড়ির উপরে যন্ত্রচালিত লঞ্চের উপরে গাড়িগুলিকে তুলে আমরাও ওপারে নীলাম্বর জেটিতে যেয়ে পৌছালাম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা মানুষ কৃতকৌশল বিদ্যার সাহায্যে সমুদ্রের বুকের উপরে সেতু নির্মাণ করে যাতায়াতের পথকে আরও সুগম করবে এবং সময়ের সাশ্রয় ঘটবে। এই ভ্রমনকাহিনী লেখার সময়ে পোর্টব্লেয়ার রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী প্রার্থনানন্দের কাছ থেকে জানতে পারলাম মিডলস্ট্রেট জেটিতে এখনও পর্যন্ত যন্ত্রচালিত নৌযানেই পারাপার হচ্ছে, তবে উত্তরা জেটিতে সমুদ্রের খাঁড়ির উপরে সেতু তৈরী হয়ে গেছে। নীলাম্বর জেটিতে পৌঁছাবার পরে ছোট যন্ত্রচালিত নৌকার সাহায্যে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বারাটাং চুনাপাথরের গুহা দেখাতে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরাও এইরকম একটি যন্ত্র চালিত নৌকার সওয়ারী হলাম। এই নৌকা গুলিতে ৮-১০ জনের বেশি লোক যেতে পারেনা। নৌকায় বেশি লোক হয়ে নড়াচড়া করলে নৌকাগুলি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা। নৌকায় বসার পরে নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তার জন্য আমরাও লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। দুপাশে ঘনসবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, মাঝখানে সমুদ্রের জল, মাথার উপরে নীল আকাশ। কিছুদুর যাবার পরে আমাদের 'নয়াদের' কাঠের জেটিতে নামতে হলো। সেখান থেকে পদব্রজে প্রায় এক কিলোমিটার যেতে হবে চূনাপাথরের গুহা পর্যন্ত। আমাদের সাথে নৌকার একজন লোক যাচ্ছেন আমাদের সেখানে সবকিছু দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অর্থাৎ এককথায় সেই আমাদের গাইড। জেটিতে নামার পরে অবশ্য অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটি। পথের দু'পাশে সুন্দরী, গরান গাছের জঙ্গল, কোথাও জলের উপরে বাঁশের সাঁকো বেরোতে হলো। কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভের গাছগুলি জলের উপরে তাদের মাথা গুলি আন্দোলিত করে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। এই পথের পরে সবুজ মাঠ ও আদিবাসীদের গ্রাম। এই গ্রামগুলিতে পুনর্বাসন প্রাপ্ত সমতলভূমির ছোটনাগপুরের আদিবাসী শ্রমিকরা বাস করেন। চুনাপাথরের গুহায় প্রবেশের পূর্বে বারাটাং দ্বীপ সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিচ্ছি।
🍂 বারাতাং দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৭.৮ কিলোমিটার প্রস্থ ১৪ কিলোমিটার। রঙ্গত তালুকে অবস্থিত বারাটাং দ্বীপে মোট ১২ টি গ্রাম আছে তন্মধ্যে বৃহত্তম জনবসতি নীলাম্বর গ্রামে যার নামে নীলাম্বর জেটি। সেখানের জনসংখ্যা ১৬০০ এবং বারাটাং দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫৭০০। ১৯১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী সবথেকে উল্লেখযোগ্য এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্বীপের জনবসতির সাক্ষরতার হার শতকরা একশ। বারাটাং দ্বীপের উত্তরে মধ্য আন্দামান এবং দক্ষিণে দক্ষিণ আন্দামান। দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য হলো সমুদ্রসৈকত, খাঁড়ি, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, চুনাপাথরের গুহা এবং কাদামাটির আগ্নেয়গিরি। স্থানীয় আদিবাসীরা এই মাটির আগ্নেয়গিরিকে 'জলকি' বলে। বারাটাং দ্বীপ বরাবরই গ্রেট আন্দামানিজদের বাসস্থান ছিল। ১৮৯০ সালের পরে জারোয়ারা এই দ্বীপের দখল নেয় কারণ ততদিনে গ্রেট আন্দামানিজের এই দ্বীপে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছল। এই দ্বীপে পুনর্বাসন পায় বন বিভাগের কর্মীরা এবং রাচিওয়ালার শ্রমিকেরা। দ্বীপের অধিবাসীরা সকলেই মূল ভূখণ্ডের ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী যার জন্য দ্বীপটিকে রাচিওয়ালা দ্বীপ বলা হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে রাচি শহরে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হওয়ার ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজ মিশনারীদের কাছে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। আন্দামানে উপনিবেশ স্থাপনের সময় ব্রিটিশরা এই সমস্ত আদিবাসীদের শ্রমিক হিসেবে এখানে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীকালে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড স্থাপনের সময় তারাই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রথমদিকে এই সমস্ত জারোয়া অধ্যুষিত অরণ্য ব্রিটিশ প্রশাসন ছিনিয়ে নিয়ে পূনর্বাসনের কাজ পুরোদমে চালায়। সেই শুরুর দিনগুলি জারোয়াদের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর ছিল। স্বাধীন ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনও জারোয়াদের প্রতি প্রথমদিকে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। কারণ তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে চলত। শুধুমাত্র সহানুভূতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের। তফাৎ শুধু ঔপনিবেশিক যুগের মতো তাদের বিরুদ্ধে মিলিটারি পুলিশের অভিযান ও তাদের কুটীরগুলিতে বোমাবর্ষণ হয়নি। ১৯৩৯ সালে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাকার্থির নেতৃত্বে পাঞ্জাব পুলিশ এই বারাটাং দ্বীপে জারোয়া ধরার অভিযান চালিয়ে এক জারোয়া মা এবং তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে ধরে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে যেয়ে তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করে। অবশ্য সেই চেষ্টা সফল হয়নি। বারাটাং দ্বীপটি অতীতের ঐতিহ্য বহন করে আছে। প্রচুর তালিপট পাম গাছ থাকার জন্য গ্রেট আন্দামানিজেরা এই তালিপট পাম গাছকে তাদের ভাষায় বলতো বারাটা এবং সেখান থেকে বারাটাং নামের উৎপত্তি। তাদের বিশ্বাস ছিল এই গাছ পৃথিবী ও মানুষের বিবর্তনের সাথে জড়িত। গ্রেট আন্দামানিজদের অবলুপ্তির পরে জারোয়ারা এই বনাঞ্চলে বহু কুটির বানিয়ে বাস করত। সভ্য মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচুর সংগ্রাম করেও এই দ্বীপকে জারোয়ারা রক্ষা করতে পারেনি। বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ বুশ পুলিশের সহায়তায় এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে গাছ কেটে উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াস চালায়। বড় বড় গাছগুলি কেটে সেখানে বনবিভাগ ছোট আকারের গাছ লাগায়, ফলে জঙ্গলের মধ্যে জংলী শূকরের সংখ্যা কমে যায়, যেগুলি দারোয়ানের খাদ্য ছিল। এছাড়াও বহিরাগত মৎস্য ও কুমির শিকারীদের আনাগোনায় বারাটাং দ্বীপ জারোয়াদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। উপনিবেশের মানুষদের সাথে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে তারা এই দ্বীপ ছেড়ে অন্য দ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। বর্তমানে বারাটাং দ্বীপে যে কয়েকজন জারোয়াদের দেখতে পাওয়া যায় তারা সংখ্যায় অতি নগন্য এবং সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে তারা পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে শিখেছে। কিন্তু আদিম জারোয়াদের বেশিরভাগ অংশই পশ্চিম সমুদ্রতটের নিকটস্থ গভীর জঙ্গলে থাকে।
পরবর্তী অংশ চতুর্দশ পর্বে
0 Comments