বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮২
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং
মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী
উপপর্ব — ১৭
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
সময়টা নভেম্বর মাস। ২০০২ সাল। মিঃ লুইস-এর আহ্বানে ১৯৮৯ সালের পর পুনরায় এশিয়ার সর্ববৃহৎ পরিবেশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাঁচগনিতে হাজির রামচন্দ্র বাবু। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছলে এক অন্য রকম ভালো লাগায় হৃদয় ভরে যায়। চির সবুজ বনানীর মাঝে প্রসন্ন হয় অশান্ত মন। পাহাড়ে এবার ঠাণ্ডা সম্ভবত জাঁকিয়ে বসবে বলে ধারণা। নভেম্বরেই তার পূর্বাভাস মিলেছে। এই তো সবে শীতের শুরু। এখনই বাতাসে হিমের ছেঁকায় টেকা দায়, বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে গরম পোশাক গায়ে চাপিয়ে রাখতে হয়। নাহলে ঠাণ্ডার চোটে কাবু হতে কতক্ষণ? শেষ যে বার তিনি পাঁচগনি এসেছিলেন, সেটা ছিল এপ্রিল মাস। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। শীতের শেষে গরমের হালকা পরশ ছিল বাতাসে। বেশ মনোরম ছিল পরিবেশ। এখন ঠিক তার উল্টো। আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এইবার যুক্ত হয়েছে ভীষণ মন খারাপের পালা। সময় সময় বিষন্নতা গ্রাস করে। অবশ্য হতাশা তীব্র হওয়ার স্কোপ পায় না। তার আগেই পণ্ডিত মানুষটি নিজেকে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যস্ত করে ফেলেন নিমেষে। তাঁর মনখারাপের একটা মস্ত বড় কারণ ছিল রাজনীতি। যে মানুষটি খেজুরীর উন্নয়নে নিজের সবকিছু পণ করেছিলেন, রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে সেই মানুষটিই কিনা আষ্টেপৃষ্ঠে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন! শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছেন। এরপর থেকে রাজনীতির প্রতি তাঁর তীব্র বীতশ্রদ্ধা জন্মায়। শেষমেশ বিকল্প পথে চালিত হয় খেজুরীর সার্বিক উন্নতির তাঁর লক্ষ্য। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল। দীর্ঘ পাঁচ বছর বিধায়ক থাকার পর তাঁর মোহভঙ্গ ঘটল। নাহ! তখনও ঠিক মোহভঙ্গ হয়নি। সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা তিনি করেছিলেন। তখনও তাঁর হৃদয় সুন্দরী খেজুরীর উন্নতির নিঃস্বার্থ ভাবনায় আচ্ছন্ন। কোনও কালে যে রাজনৈতিক অন্যায়, দুর্নীতির সঙ্গে তিনি আপোষ করেননি, সেটাই তাঁর স্বতন্ত্র ভাবনায় ধস নামিয়ে চলে গেল। সততা, স্বচ্ছতা ও নিজের আত্মবিশ্বাস বাজি রেখে দ্বিতীয় তথা শেষ বারের জন্য ভোটের ময়দানে নেমেছিলেন তিনি। এবার বদলে গিয়েছিল দলীয় প্রতীক এবং রাজনৈতিক দল। ফরওয়ার্ড ব্লকের পূর্বতন বিধায়ক সুনির্মল পাইক-এর বিরুদ্ধে ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করতে তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) দলে যোগ দিলেন তিনি। ভোটের রেজাল্টে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের শেষে হার মানতে বাধ্য হলেন প্রৌঢ়। নির্বাচনের আগে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল দল পরিবর্তন করে অনায়াসে জয়ী হবেন তিনি। অচিরেই তাঁর সেই ভুল ভেঙে গেল। এক্ষেত্রে দায়ী তাঁর ভ্রান্ত সহজ ধারণা। আপাতদৃষ্টিতে যা নিতান্তই সহজ একটা ব্যাপার বলে তাঁর মনে হয়েছিল। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি নির্বাচনে হার। কারণ, স্বার্থান্বেষী সিপিএম পার্টি ডাহা মিথ্যা কথাগুলো সত্য কথার মতো প্রচার করে নির্বাচনে বাজিমাত করে। অথচ, বিরোধী প্রতিযোগীর বিরুদ্ধে এমন সব মিথ্যে কথা কস্মিনকালেও রামচন্দ্র বাবুর পক্ষে প্রচার করা দূরে থাক, উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। ভোট বাক্সে এর প্রতিফলন পড়ল। তাই তাঁর এই পরিণতি। আল্ট্রা আধুনিক রাজনীতিতে তিনি বড্ড বেশি বেমানন। নীতিহীন আদর্শের যূপকাষ্ঠে তিনি কখনও নিজেকে বিসর্জন দেননি এবং দেবেনও না। তার চাইতে বরং চিরতরে ছদ্ম রাজনীতির জটিল আবর্তে না হারিয়ে গিয়ে, ঘুরপাক খেতে খেতে রাজনীতির মাঠ ছেড়ে আপন গবেষণার ক্ষেত্রে ফিরে আসা, তাঁর মতে, ঢের ভালো। এ হেন ফিল্ডে তিনি অপ্রতিরোধ্য। অদ্বিতীয়। অতীতের এমন হাজারো ঘটনা ভীড় করে স্মৃতির পাতায়। সেগুলো রোমন্থনে মন ভারী হয়। কষ্ট লাগে। দুঃখ বাড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নীচে তাকাতে যেমন ভয় লাগে, অতল তলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়; ঠিক তেমনই ভবিষ্যতের যাত্রীদের বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে তাকাতে নেই। অতীতের থেকে কেবল শিক্ষা নিতে হয়। সেজন্য দৃষ্টি উঁচু রাখা ভীষণ জরুরী। অতীত তো অতল খাদের মতো। ডিপ্রেসনে একবার ঢুকলে মন বার বার অতীতে ফিরে যায়, অতীতে ফিরে যেতে চায়। মনে পজিটিভ ভাবনা পোষণ করা আশু প্রয়োজন। কাজের মধ্যে থাকলে মনখারাপের মেঘগুলো নিমেষে অন্তর্হিত হয়।
দীর্ঘ বছর তেরো পর তাঁর পঞ্চগনিতে আসা। সেখানকার ফার্মের শ্রমিক পরিচালনার বন্দোবস্ত বেশ ঢিলেঢালা, কঠোর অব্যবস্থা। ওখানে পৌঁছে রামবাবুর প্রথম চোখে পড়ল শ্রমিকদের দুরাবস্থা। গুরুত্ব সহকারে ঢেলে সাজানো দরকার সবকিছু। সবার প্রথমে একটি ভেষজ উদ্যান অথবা হার্বাল বাগান তৈরি করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ মেডিশেনাল প্ল্যান্ট বা ঔষধি গাছ সংগ্রহ করা। দুষ্প্রাপ্য ভেষজ গাছগাছালি সংগ্রহ করে এক একর জমিতে গড়ে উঠল ভেষজ উদ্যান। উদ্যানে যত ভেষজগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের গায়ে সায়েন্টিফিক নাম এবং স্থানীয় নামের লেবেল সাঁটা। বাগান ভিজিট করতে আসা যে-কারও চিনে নিতে অসুবিধা হবে না গাছগুলোর সম্পর্কে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল এমন অভিনব আইডিয়া।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। এই বিশাল প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পারিপার্শ্বিকে যে APCEL (Asia Plateau Centre of Environmental Learning) গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ জন্মেছে। উদ্ভিদগুলোর প্রত্যেকটিকে চিহ্নিত করে মারাঠি, ইংরেজি আর বায়োলজিক্যাল নামের লেবেল সেঁটে দেওয়া যথেষ্ট কষ্টকর কাজ। যদিও রামবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেই অসাধ্যসাধন কাজ করতে পেরেছিলেন। এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। দেশ বিদেশের পর্যটক এবং যারা ট্রেনিং-এ আসতেন, তারা পর্যন্ত অধিকাংশ গাছগাছড়ার ভেষজ গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে গেলেন।
এছাড়াও মুষ্টিমেয় কয়েকটি গাছ প্রত্যেক বাড়িতে হোম হার্বাল গার্ডেনের জন্য চিহ্নিত করে সেল্ফ-হেল্প গ্রুপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি।
এ হেন ভেষজ ভাণ্ডারের প্রর্দশনী ক্ষেত্রটির উদ্বোধন করেছিলেন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা IAS অফিসারদের মধ্যে তামিলনাড়ুর একজন অফিসার। সবাই ড. মণ্ডলের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জ্ঞাপন করেন। আদতে APCEL একটি সৎ, আদর্শগত, নৈতিক, কর্মনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজীর ভাবধারায় ও আদর্শে পরিচালিত। দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার বহু আধিকারিক নিরন্তর আসা যাওয়া করে, শান্তির বাতাবরণে মানসিক টেনশন কমিয়ে মালিক কর্মচারীর ছোট-বড় সংঘাত মেটাতে।
মোরাল রি-আর্মামেন্ট সেন্টার (Moral Re-armament Centre বা MRA)-এ থাকা খাওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার কিছু অর্থ ব্যয় হলেও যাঁরা আসেন, তাঁদের মানবতা-সৎ-নৈতিক জীবনের পরামর্শ এবং সেল্ফ-হেল্পের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রতিদিন কমবেশি একশো জনের রান্না একই রন্ধনশালায়, পরিবেশন থেকে শুরু করে এঁটো থালাবাসন ধোওয়া মোছা নিজেদের রুটিন মাফিক করতে হয়। সবাই আনন্দে কাজ করে। কোনও হই-হল্লা নেই। প্রাকৃতিক পাহাড়ী এলাকায় বনানী ঘেরা নির্জন শান্ত পরিবেশে মাত্র কয়েকদিনের অবস্থানের বন্ধুত্ব কি যে ভালো লাগে, তা বলে বোঝানো যাবে না। অনুভব করে নিতে হয়। শুধু নৈতিকতার কথা চিন্তা করে রামচন্দ্র বাবু শুধু যাতায়াতের খরচ ছাড়া কোনও পারিশ্রমিক দিতে চাইলেও নেননি। এখানে এত কিছু আকর্ষণ আর সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও কৃষি বিষয়ক উন্নয়নে তাঁর পরিকল্পনা মাফিক সহযোগিতা বা সংস্থায় ততটা গুরুত্ব না থাকায় ফিরে আসতে একপ্রকার বাধ্য হলেন তিনি। নিজ জন্মভূমির টানে। আপন শেকড়ের সন্ধানে।
(২)
১৯৯৮ সাল থেকে পরিচয়। পরিচয় থেকে অন্তরঙ্গতা বাড়ে। ধীরে ধীরে রামচন্দ্র বাবুর অত্যন্ত কাছের একজন সঙ্গী হয়ে ওঠেন প্রবালবাবু ওরফে ড. প্রবালকান্তি হাজরা। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। কৃষ্ণনগর মণীন্দ্রনাথ হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। খেজুরী দর্পণ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। খেজুরী কলেজ গড়ার সময় থেকে রামচন্দ্র বাবুর সঙ্গে তাঁর আলাপ ও যোগাযোগ। ইতিমধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে রামবাবু খেজুরীর বিধায়ক। এলাকার শুভাশুভ চিন্তায় মশগুল সারাক্ষণ। এ হেন কাজ পাগল মানুষটির দারুণ ব্যক্তিত্বে উদ্বুদ্ধ আট থেকে আশি সবাই। এর ব্যতিক্রম নয় প্রবালবাবু।
বিজ্ঞানীর একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে প্রবাল বাবুর বর্ণনায়। তিনি বলেন —
'কোনোকালে তিনি রাজনীতি করেননি। রাজনীতির লোকও তিনি নন। তবু রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করলেন একটি মাত্র কারণে। খেজুরীর গঠনমূলক উন্নয়ন করবেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল, বিধায়ক হলে যে ক্ষমতা এবং আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাবেন, তাতে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি অধ্যুষিত এলাকার নানাবিধ উন্নয়ন করবেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল না লাল ফিতার বাঁধনের শক্তি ও বামফ্রন্টীয় রাজনীতিতে মার্কসবাদীদের একাধিপত্যের দৌরাত্ম্য শক্তি বিষয়ে। ফলে অল্প দিনেই তাঁর শুধু মোহভঙ্গ হল না, ওদের সঙ্গে পদে পদে আদর্শের সংঘাতে বিপর্যস্তও হতে লাগলেন।'
কিছু ক্ষণ থেমে তাঁর আরও বক্তব্য — 'মোহভঙ্গ ঘটার পর খেজুরী ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতিকে কেন্দ্র করে তাঁর ভাবনা নতুন পথে চালিত হয়। তিনি হলেন সমিতির প্রধান উপদেষ্টা। সমিতির জন্মলগ্ন থেকে এর শুভাশুভ চিন্তার মধ্য দিয়ে খেজুরীর উন্নয়নে তিনি সবাইকে উদ্দীপিত করে রেখেছেন। এই সংস্থা থেকে কয়েকটি বই প্রকাশের পর সংস্থার কাজকর্ম ঝিমিয়ে পড়লে তিনি মিটিংয়ে সবাইকে নতুন কাজে নামার উৎসাহ দিয়েছেন। মনে পড়ে, সমিতির আলোচনায় স্থির হল খেজুরী ভেষজ ভাণ্ডার সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করা হবে।'
ভেষজ গাছগাছড়ার বই প্রকাশ করতে সবার প্রথম প্রয়োজন তথ্যের ভাণ্ডার। কিন্তু ভেষজ গাছগাছালির তথ্য কোথায়? তথ্য সংগ্রহের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রামচন্দ্র বাবু। সঙ্গী দুজন - প্রবালবাবু আর পার্থবাবু ওরফে খেজুরী ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতির সম্পাদক পার্থসারথি দাস। এক একটি এলাকা ধরে শুরু হল সার্ভের কাজ। পুরাতন খেজুরীর বন বিভাগের একটি অঞ্চলে ছিল গোরস্থান। এই গোরস্থান এলাকায় শুরু হল সার্ভের খুঁটিনাটি কাজ। যে সব ভেষজ গাছ রয়েছে গোরস্থানে, সেগুলো চিহ্নিত করে ছবি তোলা হয় প্রথমে। সার্ভের কাজে বেরিয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনজনে। প্রায় দিন একেকটা অঞ্চল ধরে চলল তথ্য সংগ্রহের প্রয়াস। পেটের ক্ষুধা ভুলে একটানা কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ সময়। কোনও কোনও দিন খাবার প্লেটে জুটেছে চিঁড়ে ভাজা আর বাতাসা। তা দিয়ে উদরপূর্তি করতে হয়েছে। ওদিকে, প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক আবার চা পর্যন্ত মুখে তোলেন না। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ষোলআনা। পরনের সাজ পোশাক দেখে তাঁকে বিচার করা মূর্খামি। মাটির কাছাকাছি পল্লীগ্রামে তাঁর বাস। আধুনিকতার চাকচিক্য, স্মার্টনেস তাঁর জীবন যাপনের অঙ্গ নয়। থাকেন অতি সাধারণ ভাবে। দেখনদারিত্বের বিন্দুমাত্র বালাই নেই।
একদিনের ঘটনা। আমন্ত্রিত দুজন। পার্থবাবু আর প্রবালবাবু। মধ্যাহ্নের আহার রামবাবুর বাড়িতে হবে। গ্রামের বাড়িতে বৈজ্ঞানিক একলা থাকেন। স্বপাক আহার গ্রহণ করেন। যা-হোক ভাতে ভাত খাওয়া তাঁর অভ্যেস। সেদিন দুজন অতিথি এবং তিনি তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে দুপুরে নিজের বাড়িতে খাবেন। তথ্য সংগ্রহের কাজে নিজে ব্যস্ত। তাঁর পক্ষে রান্না করা সম্ভব নয়। দরকার বিকল্প ব্যবস্থা। তাঁর বাড়ির কাছে একজন দিদি থাকেন। রান্না বান্নার জন্য সেই দিদির ডাক পড়ল। বাজার থেকে কিনে এনেছেন লোনা মাছ। সেই মাছ রান্না করা হবে। দুপুরবেলা দুজন অতিথির খাবার বন্দোবস্ত সারা।
কশাড়িয়া গ্রামের আশেপাশে ভেষজগুণ সম্পন্ন যত গাছগাছালি রয়েছে, দুপুরের মধ্যে অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদ চিহ্নিত করা হয়ে গেছে। প্রত্যেক গাছের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নোট করা কমপ্লিট। ক্যামেরায় সেগুলোর ছবি ধরে রাখার সমস্ত কৌশল সারা। এ হেন তথ্য সংগ্রহ বেশ সময় সাপেক্ষ আর ধৈর্যের কাজ। তাড়াহুড়ো করলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। এলাকার সঠিক ভেষজ তথ্য উত্তর পুরুষের কাছে তুলে ধরার নেশায় মশগুল তিনজন। সামান্য বিকৃত বা বিচ্যুত তথ্য তাঁদের লক্ষ্যে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য তাঁদের জহুরী চোখ সর্বদা সজাগ। তথ্য সংগ্রহ করতে করতে কখন যে বেলা দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গেছে, সে খেয়াল নেই! সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হয়েছিল সার্ভের কাজ। এখন বেলা সাড়ে বারোটা! মধ্যাহ্ন সূর্যের তেজ খাড়া মাথায় পড়ছে। ততক্ষণে ক্ষিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সাময়িক মুলতবি রইল কাজ। রামচন্দ্র বাবুর বাড়িতে ফিরলেন তিনজনে। লোনা মাছ সহযোগে লাঞ্চ সারা হল। অত্যন্ত যত্ন সহকারে খাবার পরিবেশন করা হল। আতিথেয়তায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। আন্তরিকতা অতুলনীয়। এভাবে দিনের পর দিন বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, রাতবিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন খেজুরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। একসময় বিজ্ঞানীর মনে খটকা লাগল। যে সকল ভেষজ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেল, ছবি তোলা হল; সেগুলোর আরও বিস্তারিত তথ্য জানা দরকার। কিন্তু উপায় কী? একমাত্র উপায় এ বিষয়ে ছোট্ট একটি কোর্স করে নেওয়া। কারণ, কৃষিবিদ্যায় গাছগাছালির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন হয়েছে ঠিকই; ভেষজ গাছের অন্তর্নিহিত শক্তির সন্ধান হেতু পণ্ডিতের চোখের ঘুম উড়ে গেল। প্রাচীন ভারতের উন্নত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ও প্রাচীন যুগে মুনি ঋষিরা চারদিকের গাছপালা লতাপাতা থেকে যে নির্যাস সংগ্রহ করত, তার অন্তর্নিহিত শক্তি থেকে জীবজগতের সকল শারীরিক শক্তি ও রোগব্যাধির আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির সন্ধান মিলেছে। স্বভাবতই তাঁরা শতাধিক বছর সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছেন কেবলমাত্র আয়ুর্বেদ ওষুধের উপর ভরসা রেখে। এই অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস সন্ধানে কোমর বেঁধে নামলেন পণ্ডিত। অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার তাঁর অদম্য কৌতুহল। এক্ষেত্রে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা ভীষণ কাজে দিয়েছে।
২০১০ সালের জুন মাসের ঘটনা। রামচন্দ্র বাবুর বয়েস একাশি ছুঁই ছুঁই। নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির একটি আঞ্চলিক শাখা রয়েছে কল্যানীর ঘোষপাড়ায়। সেখানে ছয় মাসের একটি সার্টিফিকেট কোর্স চালু রয়েছে ভেষজ উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে। ট্রেনিং কোর্সটি মূলত ভেষজ উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও ভার্মি কম্পোস্টিং (মেডিসিনাল প্ল্যান্ট কনজারভেশন এবং ভার্মি-কম্পোস্টিং)-এর উপর। কল্যানী রিজিওনাল সেন্টারের ট্রেনিং কোর্সে প্রশিক্ষণ নিতে রামচন্দ্র বাবু যোগ দিলেন জুন মাসে। কলকাতায় গড়িয়া স্টেশনের পাশে বিজ্ঞানীর বাড়ি। রোজ সকালে ট্রেনে চেপে তিনি পৌঁছতেন শিয়ালদা স্টেশন। শিয়ালদা থেকে রেলগাড়ি পরিবর্তন করে কল্যানী ঘোষপাড়া পৌঁছতে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা সময় কাবার হয়ে যেত। ভিড়ে ঠাসা ট্রেন। প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক চলেছেন। ইউনিভার্সিটি চত্বর কিংবা ক্লাসের মধ্যে শিক্ষিত বেকার যুবকদের ভীড়ে প্রৌঢ় কৃষি বিশেষজ্ঞ মানুষটিকে একঝলক দেখে সবার ঈষৎ ভ্রূ কুঁচকে যায়। তাঁর শিক্ষালাভের অদম্য ইচ্ছা দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ যারপরনাই বিস্মিত। ওদিকে, পণ্ডিত মানুষটির কোনো হেলদোল নেই। তিনি আছেন নিজের কাজে। বইমেলা কিংবা অন্যান্য সূত্র মারফৎ ভেষজ গাছ-মূল-শেকড়-পাতার গুণাগুণ সংবলিত বই সংগ্রহে খামতি নেই। এমন সময় তাঁর হাতে এল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী শিবকালী ভট্টাচার্যের এগারো খণ্ডের ভেষজ উদ্ভিদের মহাভারত। ইতিমধ্যে ছয় মাসের কোর্স শেষ হয়েছে। সংগৃহীত হয়েছে প্রচুর তথ্য। এবার লেখালেখির পালা। সমস্ত তথ্য এককাট্টা করে শুরু হল লেখা। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
২০১৩ সাল। লেখালেখির পাশাপাশি তাঁর আদর্শে একটি ছোট্ট 'ভেষজ উদ্ভিদ প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র' গড়ে তোলা হয়েছিল। খেজুরী আদর্শ বিদ্যাপীঠ স্কুলের গেটের উল্টো দিকে ধানজমিতে গড়ে উঠেছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। সেখানে প্রায় সত্তর জাতের রকমারি ওষধি গাছ, গুল্ম, লতাপাতা লাগানো হয়েছিল। উৎপাদিত ভেষজ গাছগাছড়াগুলি শিশু-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য রক্ষায় একান্ত প্রয়োজন। (ক্রমশঃ)
তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক
ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব
মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি
0 Comments