জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১২ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১২ / সালেহা খাতুন 

অন্তরের কথা অন্দরের কথা মন খুলে বলা চাট্টিখানি কথা নয়। ভিতরের বাধা বাইরের বাধা চেপে ধরে প্রায়শ। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে ক্রমশ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো আছেন। একটি বড়ো আশ্রয় তিনি। 
সহজ পাঠেই প্রথম মেলাতে শুরু করি তাঁকে। “ছোটো খোকা বলে অ আ/ শেখে নি সে কথা কওয়া” - তে যে শিশুটির ছবি ছিল সে তো আমার তুলতুলে ভাই ওবাই। বড্ড আপন ছিল সে চিত্র। ক্ষীর খই খেতাম মণি টুকু দুইবোনে। ঘেউ ঘেউ করে ডাক ছাড়ত আমাদের প্রিয় অ্যালশেসিয়ান। বর্ষায় বন্দি দিনে বিশ্রী তো লাগতই। যে বড়ো বউকে ভাত আনার হুকুম দেওয়া হতো তিনি আমার বড়ো মা। চরে বসে রান্না করতেন যে ঙ তিনি তো আমার মা। বর্ষায় ভিজে যাওয়া উনুনে কী কষ্টে যে ধোঁয়া সামলাতেন!ঢাক ঢোল বাজতো শারদোৎসবে ঘোষ বাড়ি পান বাড়ি রায় বাড়িতে। যাব না তো কক্ষনোর চিত্রের গরু আমাদেরই। কাস্তে দিয়ে সারাদিন ধান কাটতেন বড়ো বাবু। 
আম পাড়ি চলো যাই পড়ে কী বিপত্তি যে ঘটিয়েছিলাম মামার বাড়িতে সে এক বড়ো গল্প। দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে আছেন। আটাত্তরের বন্যায় পড়ে যাওয়া ঘরগুলি বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় নতুন করে যে ঘরগুলি দ্রুত বানানো হয় তার দালান বাঁশের বাঁখারি দিয়ে পেরেক সহযোগে সুন্দর নকশা করে আবৃত করা হয়। আম পাড়ছি আম পাড়ছি করে উঠে পড়লাম সেই বেড়ায়। অনেকটা ওঠার পর হাতের দুই তালুতে গেঁথে গেল পেরেক। ছাড়াতে পারছি না। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। দিদা মা মাসি ছুটে এলেন। জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলেন। রক্তের স্রোত বয়ে গেল। বোরোলীন দিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার পর বিকালে ছোটোমামা সাইকেলের পেছনে বসিয়ে টিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে পা গলে গেল সাইকেলের চাকায়। ভয়ে, মামা কাঠবেড়ালী মামা কাঠবেড়ালী করে চেঁচাতে লাগলাম। মামা বুঝতে পারলেন না। যখন পায়ের বেলী জুতোটা ছিটকে রাস্তার ধারে চলে গেল তখন বুঝলেন। পায়ের গোড়ালির ছাল চামড়া উঠে সাদা দগদগে হয়ে গেল। এক চিকিৎসার জন্য গিয়ে আর এক চিকিৎসা।

“বনে থাকে বাঘ / গাছে থাকে পাখি”র পুরোটা মানস চক্ষে ঘোষেদের বাঁশবাগানে প্রত্যক্ষ করতাম।  “খুদিরাম / পাড়ে জাম” পড়ে বন্ধু খুদিরামকে খ্যাপাতাম।“পুবদিকে ঘুম-ভাঙা / হাসে উষা চোখ-রাঙা” পড়ে বাড়ির দালানে বসেই উষাকে চোখ রাঙাতে দেখতাম। বড়ো বৌ মেজো বৌ মিলে কেমন করে ঘুঁটে দেয় দেখার জন্য আমাদের খিড়কি পুকুরের চারপাশের পাঁচিলে মা আর বড়ো মার পিছনে প্রায় দিনই ঘুরেছি। পুরো সহজ পাঠ মিলে যেতো শৈশবের দিন যাপনের সঙ্গে।
🍂

হাইস্কুলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন প্রতিদিনের চর্চার বিষয়। রক্ষণশীল পরিবারে বাড়িতে নাচ গানের চর্চা করতে না পারলেও স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দিদিমণি যখন শিক্ষার্থীদের রিহার্সাল দিতেন তখন সেখান থেকে অনেক নাচ শিখি। 

প্রথম নাচ ছিল “ সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান / সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ” গানের সঙ্গে।
স্কুলের পাশেই ছিল বন্ধু রমার বাড়ি। ও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতো আর নাচও শিখতো। টিফিনের সময় ওর বাড়িতে গিয়ে চর্চা চলতো। ও একবার নেচেছিল “সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ / তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু তোমার আশীর্বাদ” গানে। সেটাও শিখে নিলাম। মাহমুদাদি আর রাফেয়াদি নেচেছিল “এ দিন আজি কোন ঘরে গো/ খুলে দিল দ্বার।/আজি প্রাতের সূর্য ওঠা/ সফল হলো কার”। রাস্তা ঘাটে স্কুলে যাওয়ার পথে এ গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে যেতাম। আর সবচেয়ে প্রিয় ছিল “খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে,/ ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো”। স্কুলে জুনিয়র রিঙ্কু এই নাচটি করে ছিল। ওটি আমি খুব সুন্দর তুলেছিলাম। পুকুরের মাঝখানে গিয়েও এই গান আর নাচ করতাম।তখন ক্লাস এইট।
পরে রবীন্দ্রনাথ আরো গভীর হন জীবনে। ছোটোবেলার একটি কীর্তি আজীবন সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সে গল্প বলে এ পর্বে বিদায় নেবো। বাবা মা তাঁদের বিয়েতে একটি বই উপহার পেয়েছিলেন। সেটি সঞ্চয়িতা। একদম ছোটো বয়সে দাদিমার সঙ্গে পাড়ার দোকানে মশলাপাতি কিনতে যেতাম। দোকানে বই খাতার পাতা ছিঁড়ে দোকানদার জিনিসপত্তর দিতেন। আমি ঘরে ফিরে নকল করে দোকান খুললাম। ইঁট গুঁড়ো মাটি গুঁড়ো বিক্রি শুরু করলাম আর সঞ্চয়িতার পাতা ছিঁড়ে ব্যবহার করতে লাগলাম। সূচিপত্র খানা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেল।উচ্চমাধ্যমিকের পর আঁকড়ে ধরলাম সেই ছিন্ন সঞ্চয়িতা। সকল শোকের সান্ত্বনারূপে। এম.এ. পড়ার সময় বই খানা বাঁধিয়ে নিলাম। নিজের হাতে পুরো বইয়ের সূচিপত্র লিখে জুড়ে দিলাম। আর এখন রবীন্দ্রনাথ ভাঙিয়েই চলছে খাদ্য বস্ত্রের সংস্থান। কেউ ভীষণ বকে দিলে আশ্রয় নিই রবীন্দ্রনাথে। শোকে-দুঃখে-রাগে-অনুরাগে আমার আছেন তিনি শুধু তিনি।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments