জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান/চতুর্দশ পর্ব/দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান
চতুর্দশ পর্ব

দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী


পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ

এক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চুনাপাথরের গুহায় পৌঁছালাম। বিভিন্ন পর্যটকদের মোবাইলের টর্চের আলোতে গুহার ভিতরে সবকিছু অপার্থিব লাগছে। মনে হয় যেন সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে কোন অতীতে। চুনাপাথরের উপরে জল পড়ে গুহার মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের রূপ যেমনটি দেখেছিলাম অন্ধ্রপ্রদেশের বোরাগুহাতে। মূর্তিগুলি স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাকমাইটের। ঝুলন্ত স্ট্যালাকটাইট, হেলিসাইট এবং মাটি থেকে ওপরে ওঠা স্ট্যালাগমাইট খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলি টর্চের আলোয় হীরক দ্যুতির ন্যায় ঝিকমিক করছে। স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট একসঙ্গে জোড়া লেগে এই ক্যালসাইটের স্তম্ভ গুলি তৈরি হয়েছে। ভেতরটা কোথাও চওড়া, কোথাও আবার সরু। প্রকৃতির আপন খেয়ালে গুহার দেওয়ালে সাদা ও গৈরিক রংয়ের চুনা পাথরের ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে গণেশের মূর্তি, হাতির শুঁড়, ঝুলে থাকা পদ্ম। মনে হয় যেন কোন এক অজানা ভাস্কর লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে থেকে একটির পর একটি ভাস্কর্য আমাদের উপহার দিয়ে চলেছেন। গুহার বাইরে স্থানীয় লোকদের দোকানে লেবু-জল আর নারকেলের প্রাচুর্য। এখানকার নারকেলে জলও যেমন প্রচুর, শাঁসও তেমনই মিষ্টি। আমরা নারকেলের জল ও শাঁস খেয়ে পুনরায় আমাদের নৌকার চালকের সমভিব্যাহারে মেঠোপথ, বাঁশের সাঁকো, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের ছোট নৌকাতে যেয়ে উঠলাম। চুনাপাথরের গুহা দেখে আমরা নীলাম্বর জেটিতে ফিরে আমাদের গাড়ি নিয়ে চললাম 'মাড ভলকানো' দেখতে। এখানে কয়েকটি মৃত মাটি ও কাদার আগ্নেয়গিরি আছে। তন্মধ্যে যেটি আকারে বড় সেখান থেকে ২০০৫ সালে শেষবারের মত কাদামাটি উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। এখানে দেখতে পেলাম সেই আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে মিথেন গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনের সাহায্যে মাঝেমাঝে কাদামাটি বুদবুদের আকারে বের হচ্ছে। সমস্ত ক্ষেত্রটি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা আছে যাতে অসতর্কভাবে কোন পর্যটক সেই আগ্নেয়গিরির দিকে যেতে না পারেন। এখান থেকে আমাদের পথ এবারে মধ্য আন্দামানের কদমতলা জেটি হয়ে রঙ্গত। দূরত্ব প্রায় ৬৩ কিলোমিটার। মাঝখানে আবার একবার সমুদ্রের খাড়ি পেরোতে হল। মহাত্মা গান্ধী জেটিতে যেয়ে পুনরায় যন্ত্রচালিত বড় স্টিমারের উপরে গাড়ি ও মানুষজন তুলে ওপারে উত্তরা জেটিতে যেয়ে পৌছালাম প্রায় আড়াইটার সময়ে। পথিমধ্যে কদমতলা, বকুলতলা পেরিয়ে রঙ্গতে যেয়ে পৌছালাম সন্ধ্যে প্রায় সাড়ে ছটার সময়। রঙ্গত বাজার পেরিয়ে আমাদের আজকের রাত্রি বাস আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের গেস্ট হাউস 'হকস্ বিল নেস্ট'-এ। রঙ্গত বাজারের পরে প্রায় সতেরো কিলোমিটার রাস্তা সমুদ্রের ধার দিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের রাত্রি নিবাসে। গেস্ট হাউসে আমাদের দেওয়া হল দোতলাতে একটি প্রশস্ত ঘর ও সংলগ্ন বাথরুম। ঘরের ব্যালকনি থেকে পূর্ব দিকে রাস্তার ওপারে ঝাউবন এবং তারপরে সমুদ্র। সমুদ্রের জলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে এবং সারাদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন আর কোথাও যাওয়া হলো না। 
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমাদের গন্তব্য স্থল দু কিলোমিটার দূরে ধনিয়া নালা। সমুদ্রের খাঁড়িতে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে প্রায় সাতশো মিটার যাওয়ার পরে সমুদ্রের দেখা পাওয়া গেল। পুরো রাস্তাটায় কাঠের পুল করা আছে। তলায় সমুদ্রের জল, দুপাশে ঘনসবুজ ম্যানগ্রোভ। বিভিন্ন ধরনের শ্বাসমূল, হাতিকান অর্কিড সহ নানা লবণ জলের উদ্ভিদ। গাছপালার ফাঁকে সকালের সূর্য রশ্মি পথটিকে মায়াময় করে তুলেছে। মাঝে মাঝে বসার জন্য ছোট ছোট বিশ্রামাগার আছে। ৭১৫ মিটার লম্বা কাঠের সেতু পেরোবার পরে কাটবার্ট বে সমুদ্র সৈকত। এখানের সমুদ্রসৈকত বিখ্যাত বিরল প্রজাতির অলিভ রিডলে কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে এই অলিভ রিডলে কচ্ছপগুলি এখানকার সমুদ্রের বেলাভূমিতে এসে ডিম পাড়ার পরে বন বিভাগের কর্মীরা এই ডিমগুলি সংগ্রহ করে প্রজনন কেন্দ্রে পালন করে পরে আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেন।
🍂

 কাটবার্ট বে বিচ রঙ্গত থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। এখনো এখানে খুব বেশি পর্যটকদের আনাগোনা হয়নি। এখানের সমুদ্রে স্নান করা হয়নি কারণ জলের তলায় ডুবন্ত পাথর আছে বলে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল আম্বকুঞ্জ সমুদ্র সৈকত। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা গ্রামের পথ ধরে যেতে হয়। তীর ভূমিতে যাবার পথে প্রচুর গাছের সমারোহ এবং সৈকতে ও প্রচুর গাছ। শুকনো গাছের গুঁড়ি কেটে পর্যটকদের বসার জায়গা করা আছে। বিনোদনের জন্য দোলনা আছে যেখানে বসে সমুদ্রের নীল জলের শোভা দেখা এক পরম পাওয়া। এখানে সমুদ্রের জলের তলায় পাথর থাকার জন্য স্নানের পক্ষে উপযোগী নয়। এখান থেকে সমুদ্রের ধার দিয়ে আমাদের গাড়ি আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটে চলল ৭২ কিলোমিটার দূরের মায়া বন্দরের দিকে। পথে বিলিং গ্রাউন্ড, নিম্বুদেরা পেরিয়ে মায়া বন্দর। আমাদের আজকের গন্তব্য স্থল মায়াবন্দর থেকে আশি কিলোমিটার দূরে দিগলিপুর। পানিঘাটে সমুদ্রের উপরে সেতু পেরিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের দু'পাশে গগন স্পর্শী গাছের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুপুর একটার সময় যেয়ে পৌছালাম দিগলিপুরে। এখানে আজকের রাত্রি যাপন স্যাডেল পিক পাহাড়ের পাদদেশে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালা 'টার্টল রিসর্ট'-এ। ঘরের সামনে থেকে দক্ষিনে স্যাডেল পিক পাহাড়ের চিরসবুজ গাছ দেখতে পাচ্ছি। দুপুরে এখানে বেশ গরম। একটু পরেই পাহাড়ের পিছনে সূর্যদেব ঢলে পড়তে গাছগুলির রং ধীরে ধীরে কাল হয়ে গেল। বিকেলে আমরা পাহাড়তলীর অতিথিশালা থেকে নিচে নেমে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম নীল সমুদ্রের স্নিগ্ধ পরশ পেতে। পশ্চিমে পাহাড় থাকার জন্য সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখার কোন সুযোগ নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে রস ও স্মিথ আইল্যান্ডকে। আন্দামানের একমাত্র নদী কালপং স্যাডল পীক পাহাড় থেকে বেরিয়ে ৩৫ কি.মি প্রবাহিত হয়ে এরিয়াল বে-তে যেয়ে সমুদ্রে মিশেছে। এই কালপং নদী থেকে যে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার দ্বারা সমগ্র দিগলিপুর তহশীলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এবং কালপং নদী থেকেই পাইপলাইনের সাহায্যে সমগ্র দিগলিপুর অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। সমগ্র দিগলিপুর তহশীল কমলালেবু এবং ধান চাষের জন্য বিখ্যাত। আন্দামানের একেবারে উত্তরে অবস্থিত হওয়ার জন্য মায়ানমার নিকটেই। জলপথে সীমান্ত রক্ষার জন্য নৌবাহিনীর একটি বিরাট ঘাঁটি আছে এরিয়াল বে-তে এবং শিবপুরে নৌবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের একটি কেন্দ্র আছে। 
পরের দিন আমাদের এখান থেকে ফেরার পালা। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমাদের গন্তব্য স্থল পোর্ট ব্লেয়ার। পাহাড়তলী থেকে নামার সময় ডানদিকে এরিয়াল বে এবং শিবপুরে নৌবাহিনীর ঘাঁটি দেখতে পাচ্ছি। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, তাই দূর থেকে দেখতে হল। এরিয়াল বে-তে দেখতে পাচ্ছি নৌবাহিনীর একটি বিরাট যুদ্ধজাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার পথে আর কালিপুর সমুদ্রসৈকতে গেলাম না কারণ গতকাল আসার সময় কাটবার্ট বে-তে অলিভ রিডলে কচ্ছপের প্রজনন কেন্দ্র দেখে এসেছিলাম। সময় স্বল্পতার জন্য রস ও স্মিথ আইল্যান্ডে যাওয়া হলো না। কারণ তাহলে ওই গুলি দেখে সঠিক সময়ে পোর্টব্লেয়ারে ফেরা যাবে না। নীলাম্বর জেটিতে বিকেল তিনটার পূর্বে পৌঁছিয়ে জারোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিকেল তিনটের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। বিগত দু'দিন ধরে গাড়িতে একটানা ভ্রমন করে বয়সজনিত কারণে আমার সঙ্গিনীও রস ও স্মিথ আইল্যান্ডে যেতে চাইলেন না। পথিমধ্যে বিলিংগ্রাউন্ডে সকালের জলখাবার খেয়ে পুনরায় গাড়িতে ওঠা। রঙ্গতে প্রবেশ করার পূর্বে বাঁদিকে পুনরায় নীলসমুদ্রকে দেখতে দেখতে প্রায় আঠারো কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা পেরোলাম। কদমতলা জেটিতে এসে দক্ষিণ ভারতীয় হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে সমুদ্রের খাঁড়ি পেরিয়ে পুনরায় গাড়ি করে মিডিল স্ট্রেট জেটিতে যেয়ে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে। তিনটের সময় পুনরায় গাড়ির কনভয় ছাড়লো। জারোয়া বনাঞ্চল পেরিয়ে যখন জিরাকাটাং পৌছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা সময় জানিয়ে দিল বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে। এখানে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে গরম চা ও বেগুনি খেয়ে নিশ্চিন্তে গাড়িতে চেপে রাত্রি সাড়ে সাতটায় পোর্টব্লেয়ারের এ্যাবারডিন বাজারের 'জয়মাথি' হোটেলে পৌছালাম।                         
                                                   পরবর্তী অংশ পঞ্চদশ পর্বে
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments