মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব --৬৪
লক্ষ্মণ কর্মকার (পত্রিকা সম্পাদক, সাহিত্যিক, ঘাটাল)
ভাস্করব্রত পতি
"যে কোনও সৎ কবি সমাজ তথা জীবনের দায়বোধে ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারেনা। অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে জীবনের যে পরম্পরা, তার সামগ্রিক শিল্পরূপ ভাষায়িত করতে অনিবার্য ভাবেই তাঁকে ঐতিহ্যমুখী হতে হয়।" এই দর্শন নিয়েই তাঁর পথচলা। তাঁর সাহিত্যসেবা। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা।
অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার। বাংলা ভাষাকে নিয়ে তথাকথিত চর্বিতচর্বন করেন পেশাগত কারণে। কিন্তু সেই ঘেরাটোপ ছিঁড়ে এবং ছেড়ে তিনি নিয়মিত বেরিয়ে পড়েন অন্য সাহিত্যের দোরগোড়ায়। যেখানে রয়েছে জীবন। মনন, চিন্তন আর হৃদয়ের পরিস্ফুরণ। কলেজে অধ্যাপনা যদি তাঁর পেশাগত পরিচয় হয়, তবে লক্ষ্মণবাবুর আসল পরিচয় অবশ্যই সাহিত্যসেবা। বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করা। এখানেই তাঁর অনন্য ভূমিকা। বাংলা ভাষা ও নিবিড় সাহিত্য পরিচর্যার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁর সদর্থক পথচলা। বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্দরমহলে উঁকি দিয়ে দৃশ্যমান করে তুলছেন সাহিত্যচর্চার অলিগলি।
১৯৫০ এর ১৩ ই জানুয়ারি জন্ম হুগলির কনুইবাঁকা গ্রামে। বাবা গোবিন্দ চন্দ্র কর্মকার এবং মা তারকবালা দেবী। প্যারিমোহন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স (১৯৭০) করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে দুবছরের ডিপ্লোমা করেছেন কবিগুরুকে নিয়ে। প্রথমে সুন্দরবন মহাবিদ্যালয়ে (১৯৭৫), তারপর হাওড়ার পি কে এইচ এন মহাবিদ্যালয়ে (১৯৭৭) এবং সবশেষে ঘাটালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ে (১৯৭৯, নভেম্বর) অধ্যাপনা করেছেন প্রাঞ্জলভাবে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত হয়েও কাজে ছেদ নাই। তাঁর জীবনের চলার পথে সর্বদা স্মরিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনরসের ক্ষরণে বয়ে আসে রবি কবির অদৃশ্য উপস্থিতি। তাঁকে শক্তি দেয়দেয় রবীন্দ্রনাথ। প্রাণচঞ্চলতা বইয়ে দ্যায় প্রাণে।
১৯৯৩ থেকে প্রকাশ করছেন সাহিত্য পত্রিকা 'সৃজন'। সেসময় সহযোগী ছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গল্পকার শিক্ষক অশোক পাল। আজ তিরিশ পেরিয়ে একত্রিশে পা। দুই মেদিনীপুরের লিটল ম্যাগাজিনগুলির তালিকায় গুনগত মানে ওপরের দিকেই। শুধু পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে -- এ দৃষ্টিভঙ্গি নয়। যথার্থ সাহিত্যপ্রেমী মানুষজনের কাছে 'সৃজন' হয়ে উঠেছে সৃজনীশক্তির প্রকাশের আধার। জেলা ও জেলার বাইরের কবি সাহিত্যিকদের কাছে তাই বিগত ৩০ বছর ধরে সৃজনশীল ভাবনা নিয়ে 'সৃজন' হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়।
অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকারের সম্পাদিত প্রবন্ধগুলি আজ রাজ্যের বাংলা ভাষাপ্রেমী সাহিত্যসেবীদের দিতে পেরেছে মনের খোরাক। সাহিত্যের খোরাক। চিরাচরিত ট্র্যাক ছেড়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন পাঠকদের কুতুহল মেটাতে। তাই তাঁর স্পর্শে দুই মলাটে স্থান পেয়েছে অসংখ্য অমূল্য রতন। বই প্রকাশ করেন নিখাদ সাহিত্যপ্রেম থেকে। বাজার চলতি প্রকাশকের দলে তিনি পড়েননা। মুখোশের আড়ালে থেকে নয়, মুখোমুখি কাজ করতে ভালোবাসেন কুশপাতার সম্পাদক অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার।
'সৃজন প্রকাশনী' থেকে এ পর্যন্ত ১৩১ টি কাব্য সংকলন, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নিজে সম্পাদনা করেছেন ৩০ টি গ্রন্থ। লিখেছেন 'অনায়ত্ব রবীন্দ্রনাথ : প্রসঙ্গ রবীন্দ্র নাটকের অভিনয়' এবং 'কবির কাছে কবিতার কাছে' নামে দুটি গ্রন্থ। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে চলেছেন অসংখ্য তরুণ প্রাজ্ঞ কবিদের কাব্য সংকলন। শেখ মনিরুল ইসলাম, শেখ ইসরায়েল, সূর্য নন্দী, মানবেন্দ্র চৌধুরী, দিলীপ কুমার বাগ, নিমাই করণ, তুষারকান্তি ঘোষ, প্রবীর চক্রবর্তী, কেশব মেট্যা, বঙ্কিম মাজী, সুশান্ত আদকদের কবিতা সংকলন আজ পাঠক সমাজে সমাদৃত সৃজন প্রকাশনীর মাধ্যমে।
তাঁর সম্পাদিত বইগুলির মধ্যে রোকেয়া ভাবনা, বাবরের প্রার্থনা ফিরে পড়া (এপ্রিল, ২০১৮), মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি (২০১৯), সময়ের স্বর : সময়ের ভাষা উল্লেখযোগ্য। আজাহারউদ্দিন খানের 'বঙ্কিমচন্দ্র : অন্য ভাবনা', 'মনের কোনের বাইরে', শেখ ইসরায়েলের 'আমরা বেঁচে আছি', রোহিনীনাথ মঙ্গলের 'জাড়া গোলোক বৃন্দাবন', প্রভাত মিশ্রের 'দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ', 'কবি বিতশোক', কামরুজ্জামানের 'বনলতা সেন ৭৫', অশোক পালের 'সাহিত্য সাধক আজাহারউদ্দিন খান', অধ্যাপক লায়েক আলি খানের 'রবীন্দ্র প্রবন্ধ সমীক্ষা', তরুণ মুখোপাধ্যায়ের 'সুভাষ মুখোপাধ্যায় : ভুবনডাঙার বাউল', স্বয়ং লক্ষ্মণ কর্মকারের 'মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি', 'বিদ্যাসাগর : অন্য ভাবনায়' বইগুলি উল্লেখযোগ্য।
বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে যাঁদের নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে সৃজনের বিশেষ সংখ্যা, তাঁরা হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২০০২, ২০০৪, ২০১২), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বেগম রোকেয়া, নলিনী বেরা, অনিল ঘড়াই, শামসুর রহমান প্রমুখ। কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ কবিতা সংখ্যা 'এই সময়ের কবিতা'। এতে ভারত বাংলাদেশের কবিদের কবিতা ঠাঁই দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তিনবার বিশেষ ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছে। প্রবীণ থেকে নবীন -- সকল গল্পকারদের গল্পের মননশীল আলোচনায় ঋদ্ধ। প্রকাশ করেছেন তিনটি লোকসংস্কৃতি সংখ্যা। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ সৃজনের শারদীয়া সংখ্যাগুলি। অসাধারণ লেখনীতে ভরপুর। একজন যোগ্য সম্পাদকের কৃতিত্ব এরকম সুপাঠ্য এবং সুনিয়ন্ত্রিত শারদ সংখ্যার জন্ম দেওয়া। প্রত্যেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলা ছোটপত্রিকা তথা লিটল ম্যাগাজিনের সেরা দশ জন সম্পাদকের তালিকা যদি তৈরি করা হয়, তবে সৃজন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকারের নাম সেখানে অগ্রাধিকার পাবে।
শুধুমাত্র ঘাটাল মহকুমার সাহিত্যচর্চাকে গতিশীল করতে নয়, সমগ্র মেদিনীপুর জেলার সাহিত্যচর্চার গতিশীলতা বজায় রাখতে ত্রৈমাসিক 'সৃজন' প্রকাশিত হয়ে চলেছে নিয়মিত। মূলত তরুণ লেখকদের অনুপ্রাণিত করতেই তাঁর অদম্য পথচলা। এজন্য সম্মাননা বা পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁকে লালায়িত করেনা। উৎসাহিত হলেও পুরস্কার প্রাপ্তিতেও মাটিতেই পা রেখে চলতে পছন্দ করেন। তবুও ১৯৯৩ এ 'সৃজন' পত্রিকার আত্মপ্রকাশের পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন থেকে বহুবার 'সৃজন' ও সৃজন সম্পাদক হিসেবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্মাননা হল -- ১) পশ্চিমবঙ্গ বংলা আকাদেমি কর্তৃক ‘শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন' স্বীকৃতি, ২০১১ ২) ‘মহাদিগন্ত’ পুরস্কার, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, ৩) কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক 'লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার' ২০১৬, ৪) দশম বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে (হলদিয়া), ‘আপনজন স্মারক সম্মাননা' প্ৰাপ্তি (২০১৮), ৫) ‘কবিতার আড্ডা’ কর্তৃক সাহিত্য সম্মাননা (১৯৯৮), সুলতাননগর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬) ‘বালিচক সাহিত্য সংসদ' কর্তৃক সম্মাননা, ৭) ‘মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন অ্যাকাডেমি' কর্তৃক সম্মাননা, ৮) ‘ঘাটাল মহকুমা লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় সমিতি'র সম্মাননা, ৯) ‘লোককৃতি সাহিত্য সম্মান', মহিষাদল, ১০) 'সংলাপ সাহিত্য সম্মান, হলদিয়া, ২০১৫, ১১) 'ছোট পত্রিকা সমন্বয় সমিতি'র (কলকাতা) পর পর তিন বছর প্রথম পুরস্কার, ১২) 'তিস্তা তোর্সা সাহিত্য সম্মান', উত্তরবঙ্গ, ১৩) কোরাস সাহিত্য সম্মান' - সুরতপুর, হরিরামপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০১৩, ১৪) ‘কবিতার কাগজ' কর্তৃক ‘নিত্যানন্দ পুরস্কার' (কাঁথি), ১৫) ‘দেশবন্দনা' পত্রিকা কর্তৃক সৃজন সম্পাদকের সম্মাননা, ১৬) ‘হাউর পাঠচক্র’ কর্তৃক সৃজন সম্পাদকের সম্মাননা, ১৭) ‘অনন্যে অভিধা' পত্রিকা কর্তৃক ‘ঋষি বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার' (কাঁথি), ১৮) 'মেচেদা সাহিত্য অ্যাকাডেমি' কর্তৃক সৃজন সম্পাদকের সম্মাননা, ১৯) কে. টি. পি. পি. মেলা (কোলাঘাট) কর্তৃক ‘সৃজন' সম্পাদককে সম্মাননা, ২০) 'ছন্দম মিউজিক অ্যাকাডেমি' কর্তৃক সৃজন সম্পাদকের সম্মাননা, ২০২০ ইত্যাদি। কেবলমাত্র এইসব সম্মাননা অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকারের কাজের মাপকাঠি হতে পারেনা। তাঁর কাজ সুদূরপ্রসারী। আরও নিভৃত চর্চা প্রয়োজন তাঁকে ঘিরে। তিনি তাঁর কলমকে দিয়ে লিখিয়ে নেন একাকী থাকার সৌন্দর্য। সেখানে ফুলের গন্ধের মৌতাত মাখিয়ে তিনি উপভোগ করেন একলা মনের গোধূলি ---
"আমি চলে যেতে চাই
দূরে বাস স্টপ ছাড়িয়ে
পিয়ারডোবার আদিম শাল
শালের অরণ্যময় মায়া পার হয়ে
একা, কেবলই একা।"
0 Comments