জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ১০ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ১০

বিজন সাহা 

কিম্রি 

তভের থেকে রওনা হয়ে আমরা চললাম কিম্রির দিকে। বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। এখানকার বনগুলো দুবনার পাশের বনের মতই দেখতে। তাই খুবই আপন মনে হয়। অনেক আগে ২০১১ সালে দুবনা থেকে এ রাস্তা দিয়েই তরঝক গেছিলাম। তাই কিছু কিছু জায়গা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছিল। তাছাড়া তভের পর্যন্ত না হলেও এই রাস্তায় অনেকটা পথ এসেছি মেদ্ভেদিৎসা নদীর তীরে ছবি তুলতে। একবার নয়। একাধিক বার। যখন দেখতে দেখতে ইলিন নামক শহরের কাছে চলে এলাম মনে হল যেন ঘরে ফিরছি। মাত্র কিছুদিন আগে দেমিদের সাথেই তথাগত আর নীতাকে নিয়ে এদিকে এসেছিলাম। এই এলাকায় বিখ্যাত কনস্ট্রাক্টর তুপলভের জন্ম। সোভিয়েত বিমান তু এই তুপলভের নামের আদ্যাক্ষর থেকেই। পথে পড়েছে একাধিক পরিত্যাক্ত গির্জা। তাদের বেশ কিছু নতুন করে গড়া হচ্ছে। সোভিয়েত আমলে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ঈশ্বর একটু একটু করে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।    

কিম্রি – ভোলগা তীরের শহর, দুবনা থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে। ভাটিতে। এটাই মনে হয় দুবনার সবচেয়ে কাছের শহর আর তভের অঞ্চলের শহরগুলোর মধ্যে মস্কোর সবচেয়ে কাছের। নিজে বিভিন্ন সময়ে এখানে এসেছি। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল এখানে আসত থিয়েটার দেখতে। যেহেতু এখানে বাজারে তুলনামূলক কম দামে ফ্রেস মাংস পাওয়া যেত সে সময় আমার স্ত্রী গুলিয়া কখনও সখনও আসত মাংস কিনতে। আর আসত লিনেনের তৈরি পোশাক কিনতে। এখানে নিজস্ব কারখানায় এসব জামাকাপড় তৈরি হত, তাই দাম একটু কম ছিল। দুবনার মত এই শহরও ভোলগার দুই পাশে অবস্থিত। ভোলগার বাঁ দিকের অংশের নাম কিম্রি আর ডান দিকের সাভেলিওভ। সাভেলিওভে আছে ট্রেন স্টেশন যেখান থেকে থেকে নিয়মিত মস্কো ট্রেন যায় আর দিনে একবার যায় কালিয়াজিন। এই শহর সেই জার আমল থেকেই বিখ্যাত ছিল জুতা শিল্পের জন্য। সোভিয়েত আমলে এখানে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কারখানা ছিল। ছিল কাঠর মিল। আমি যখন দুবনা আসি সেই ১৯৯৪ সালে কিম্রি পরিণত হয় ভুতুরে শহরে। সেই সময় সারা রাশিয়াতেই ভাঙ্গনের সুর। বিশেষ করে নব্বুইয়ের দশকে। পরে কিছু কিছু জায়গায় পরিবর্তন এলেও কিম্রিতে সেটা এত দ্রুত হয়নি। এর মূল কারণ তখন এখানে জিপসিদের বসবাস আর সাথে নারকোটিক্স। তবে বিগত দশকে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জিপসিরা চলে গেছে। মস্কোর সাথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আর কিম্রিতে বাড়িঘরের দাম এক কম বলে রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এখানে এসে বাস করতে শুরু করেছে। অনেকেই নিয়মিত মস্কো গিয়ে  কাজ করে, অনেকে কাজ করে দুবনায়। ফলে এখানে নতুন করে জীবন ফিরে আসছে, অনেক কিছুই বদলাচ্ছে, যদিও পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।   

🍂

যেখানে কিমরকা নদী ভোলগায় পড়ছে সেখানে এই শহর। যদিও শহরের নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ভার্সন আছে তবে ধারণা করা হয় এটা কোন ফিনো-ইউগ্রিক উপজাতির নামের থেকে এসেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে অস্তাশকভেও এক সময় ফিনো-ইউগ্রিক উপজাতির লোকেরা বাস করত।  ১৯৩৬ সালের খননকার্য থেকে জানা যায় যে দশম-একাদশ শতাব্দীতে এখানে ভোলগা তীরে ক্রিভেচি নামে প্রোট স্লাভিয়ানদের এক জাতি বাস করত। প্রথম কিম্রির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫৪৬ সালে চতুর্থ ইভানের সনদে। দিনপঞ্জি থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় ১৬৩৫ সালে কিম্রিতে ১০৪ পরিবার বাস করত, যদিও সে সময় অধিকাংশ গ্রামে ১০-১৫ ঘরের বেশি বাস করত না। ১৭০৮ সালে এই জনপদের কিছু কৃষক জার পিটার দ্য গ্রেটের খাজাঞ্চির সাথে প্রতি বছর সেনাবাহিনীর জন্য কয়েক হাজার জোড়া জুতা, চামড়ার পোশাক ও ঘোড়ার জিন সরবরাহ করার চুক্তি সাক্ষর করে। ১৭১০ সালে সুইডিশ যুদ্ধবন্দী অফিসার স্টারলেনবারগ কিম্রি সম্পর্কে লেখেন রুশ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ দর্জি ও জুতা প্রস্তুতকারীরা কিম্রি নামক জনপদে বাস করে। ১৭৮৮ সালে কিম্রি অগ্নিকান্ডে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়, প্রায় ২০০ বাড়ি এই অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কিম্রি রুশ সাম্রাজ্যের জুতা শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়। সে সময় এখানে গম বিক্রিও শুরু হয়। ১৮৩৭ সালে যুবরাজ আলেক্সান্দর নিকোলায়েভিচ ও ভাবী জার দ্বিতীয় নিকোলাই কিম্রি সফর করেন। সে সময় এখানে বিভিন্ন রকমের বানিজ্য মেলার আয়োজন করা হত। ১৮৫৯ সালে এখানে আবার বিশাল অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। ১৮৭৫ সালে এখানে ইয়োয়ান প্রেদচাতি গির্জা স্থাপিত হয়। এর সাত বছর করে প্রতিষ্ঠিত হয় স্করবিয়াশেনস্কায়া গির্জা। ১৮৯০ সালে কিম্রিতে প্রায় ৬০০০ লোক বাস করত। সে সময় এখানে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ জোড়া জুতা তৈরি হত। ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি সাবোর। ১৯০০ থেকে ১৯০২ সালে এখানে রেললাইন তৈরি হয় যা কিম্রির সাথে মস্কোর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে। রেল স্টেশন তৈরি হয় ভলগার ডান তীরে সাভেলিওভ নামক গ্রামে যা বর্তমানে কিম্রির অংশ। এই সাভেলিওভের নামে মস্কোয় রেলওয়ে জংশন এবং মেট্রো স্টেশন আছে। তাই বর্তমানে প্রায় পরিত্যাক্ত হলেও কিম্রির আছে গৌরবময় অতীত। 

সোভিয়েত আমলেও কিম্রি তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শুরু হয় নতুন করে শিল্পায়ন। যুদ্ধের সময়ে এখানে টেক্সটাইল শিল্প সক্রিয় ভাবে কাজ করে। গোরকি টেক্সটাইল মিল  সম্প্রসারণ করা হয়। ক্রাস্নায়া জভেজদা বা রেড স্টার জুতার কোম্পানি পুরাদমে কাজ শুরু করে। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় টেকনিকুম বা ভোকাশনারি কলেজ। ১৯৬৬ সালে মেশিন-টুল প্ল্যান্ট সম্প্রসারিত করা হয়। সে সময় এখানে কাঠ শিল্পের বিকাশ ঘটে। তৈরি হয় ভোলঝস্কি এক্সপেরিমেন্টাল কম্বাইন। ১৯৭৮ সালে ভোলগার উপর তৈরি হয় সেতু। ১৯৮৩ সালে সেতু তৈরি হয় কিমরকার উপরে।           

আমি আর দেমিদ এসব কথা দিলীপকে বলেছিলাম। তাই ও আগ্রহ প্রকাশ করে এসব কোম্পানিতে গিয়ে কথা বলতে। আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি। জারের আমলে যেখানে জুতার বিশাল কারখানা ছিল সেখানে গিয়ে জানলাম ওটা অনেক আগেই পাত্তারি গুটিয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে গেলাম নতুন কোম্পানিতে। প্রথমে তারা ভেবেছিল আমরা হয়তো বায়ার, কিন্তু যখন জানল আমরা শুধুমাত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছি তখন আর কোন আগ্রহ দেখাল না। সেখান থেকে আমরা গেলাম টেক্সটাইল শিল্পের কারখানায়। অনেকক্ষণ বসে থেকে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হল, কিন্তু তেমন কিছু জানা গেল না। ছোট্ট একটা এক্সারশন তাদের প্রডাকশন সাইকেল দেখার জন্য। পরে  নীচে তাদের শো রুমে। দু একজন শ্রমিকের সাথেও কথা হল, তবে দিলীপের প্রশ্নের উত্তর সেখানে ছিল না। তারা নিজেদের বর্তমান নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী, দিলীপ জানতে চায় অতীত কাহিনী। জানা গেল এখন সেখানে শুধু স্থানীয় মালিকানায়ই নয় তুরস্ক ও ভিয়েতনামের মালিকানায় আলাদা কোম্পানি আছে। ওদের শো রুমগুলোর পণ্য সম্ভার অনেক বেশি বলে মনে হল। 

সেদিন আমরা দুপুরের খাবার খেলাম স্থানীয় স্তালোভায়ায়। স্তালোভায়া – এটা আমাদের দেশের হোটেলের মত যেখানে বিভিন্ন রকমের খাবার পাওয়া যায়। সেলফ সার্ভিস। তাই দাম তুলনামূলক ভাবে কম। আমার মনে পড়ে গেল ছাত্রজীবনের কথা। বেশ ভালো ছিল খাবার। দিলীপ ইন্ডিয়া থেকে জ্যাকেট নিয়ে এলেও সেটা মস্কোয় ভুলে ফেলে এসেছিল। তাই স্থানীয় সুপার মার্কেটে একটা জ্যাকেট কিনল। এরপর গেলাম শহর দেখতে। স্টিমার ঘাঁটে। লেনিনের স্ট্যাচুর পেছনে সুন্দর বুল্ভারড – সেটা চলে গেছে নদীর তীরে। সেখানে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মদানকারী সেনাদের উদ্দেশ্যে মনুমেন্ট। কাছেই তুপলভের আবক্ষ মূর্তি। যথেষ্ট পটেনশিয়াল আছে কিম্রিকে ট্যুরিস্ট সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার। সোভিয়েত আমলে প্রতিটি জনপদেই লেনিনের স্ট্যাচু ছিল। কোন কোন শহরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। আমি ঠাট্টা করে বলতাম শিবলিঙ্গ। এখানে লেনিন দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছেন। সামনে ধ্বংসপ্রায় এক বিল্ডিং। এ নিয়ে হাসলাম দিলীপের সাথে। আরও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে রওনা আবার পথে নামলাম। আমরা যাব নদীর অন্য তীরে। দেমিদ গাড়িতে করেই ওপারে কিছুটা দেখাল আমাদের। ব্রীজের অদূরে একটা বিমান দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় এটা তু-১৫৪ এবং সেটাও তুপলভের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই। সেখানে নেমে বেশ কিছু ছবি তুললাম আমরা। যদিও দিলীপ অনেক প্রশ্নের উত্তর পায়নি, তবে ওর কারণে আমাদের অনেক কিছুই জানা ও দেখা হল। অন্তত এটা ঠিক যে দিলীপের জন্যই আমরা এখানকার জুতা তৈরির কারখানা ও টেক্সটাইল মিলে ঘুরতে গেছি, সেখানকার শ্রমিকদের সাথে কথা বলেছি। 

কিম্রির কিছু ছবি পাওয়া যাবে এখানে 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=243

আর ভিডিও এখানে

https://www.youtube.com/watch?v=hpqUls7_LsY      

   

Post a Comment

0 Comments