কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-১০
সুমিত্রা মাহাত
জীবন ও জীবিকার তাগিদে , পাহাড়ের এত উঁচুতে , মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জনের চেষ্টা করছে তা দেখে ভালো লাগে। নিকম্মার ঢেঁকি ছেলেগুলো যদি মায়ের কাজে সাহায্য করত তবে ফ্রেম টা আরও সুন্দর হতো। মা ভেবেছে ঘরে থাকলে দুষ্টুমি করবে, তার চেয়ে গেম খেলুক আর যাই করুক চোখের সামনে থাকবে। বেচারা হোটেল দিদি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রাইস কুকারে ভাত খানিকটা পুড়িয়ে ফেলল। সেগুলো বেছে আলাদা করে সাজিয়ে এনে দেয়। সঙ্গে টকপাতার ঝোল, বাঁধাকপির চচ্চড়ি , স্যালাড, আচার, ডাল, আলুভাজা আর লেবুর রসে সংরক্ষণ করে রাখা একটা গোল লাল লঙ্কা। বারে বারে সাবধান করে দেয় আমরা যেন চেরী ভেবে এই লঙ্কাতে কামড় না দিই । গাছ নাড়া ঘাঁটার অভ্যাস আছে আমার,বুঝলাম এতে কামড় দিলে বাপ-ঠাকুরদার নাম নিতে হবে। তাই ছুঁয়ে প্রসাদ করে রেখে দিই। যা পাই তাই পেটে পুরি। আজ ছুটির দিন। দোকান বাজার সব বন্ধ। ছুটির আস্বাদন নিতে এত মানুষ ডেলো পার্কে ভিড় করেছে, পাশের দোকানগুলোতে খাবার-দাবার প্রায় শেষ। অদৃষ্টে আর কিছু জুটবেনা। আজও নার্সারি কোথাও খোলা পেলাম না।
যেকথা বলতে চাই মোবাইল গেম এমন সর্বনাশা অন্ধকারের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ভবিষ্যত প্রজন্মকে। সেই গরল সাগরের দিকে বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো ছুটে চলেছে তারা। ছোট ছোট শিশুদের অন্তরের কথা শোনবার, বোঝবার মতো লোক লোক নেই। বাড়িতে বয়স্ক মানুষের অবাধ প্রশ্রয় নেই , খেলার মাঠ নেই। মা-বাবা তো কবেই টাকা,রাজনীতি আর সোশ্যাল মিডিয়ার নাগপাশে বন্দী। তা না হলে আছে পেটেরদায়,দায়িত্বহীন পিতার উদাসীনতা। যেমনটা এখানে। যতজন শিশুর সংস্পর্শে আসি তাদের এই সর্বগ্রাসী বিষক্রিয়া থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। হাজব্যন্ড এর তাগাদা খেয়ে ধান ভানার ইচ্ছা দমন করি। বৃষ্টি একটু ধরেছে। ডেলো পার্কে খোলা প্রকৃতির রসাস্বাদন করতে হলে দ্রুতগামী হতে হবে।
পার্কের বাইরে ও ভেতরে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের ভিড়। কাউন্টারে টিকিট কাটি। লোহার প্রবেশ পথে একজন বয়স্ক মহিলা লাঠি হাতে বসে আছেন। তিনিই বেপরোয়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমরা পার্কে প্রবেশ করি। এখানকার মূল আকর্ষণ হাইড্রেনজিয়া । গাঢ় সবুজ ঘন পাতার ফাঁকে ফাঁকে নীল,সাদা,গোলাপী রং এর গাছ ভর্তি ফুল। আমার কপাল ভালো। এমন সময় এসেছি,প্রকৃতি তার রং,রূপ, সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আমায় স্বাগত জানাচ্ছে সর্বত্র। হাইড্রেনজিয়ার সঙ্গে রূপ সৌন্দর্যে পাল্লা দিয়েছে অ্যাজেলিয়া। গাছের পাতাই চোখে পড়ছে না এত ফুল ফুটেছে। কি তাদের রং! গাছের পাতা বৃষ্টির জলে ধুয়ে,কুয়াশা ঘেরা মায়াময় পরিবেশে হাইড্রেনজিয়া গাছগুলো যেন কথা বলছে। পাতার সবুজ রং আর পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না। তা ধীরে ধীরে আমার শরীর ও মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলতে থাকি। সবুজ পাতা স্পর্শ করে তার ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। আমি সাধারণ মানুষ। অসীম অনন্তের মাঝে ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো। ঈশ্বর ও তাঁর আশ্চর্য সৃষ্টির গুণগান করাই আমার একমাত্র কাজ। ডানদিকে একফালি সবুজ উঠোন। কচি কচি নরম ঘাসের গালিচা পাতা। সেখানে বাচ্চাদের জন্য কিছু কারিগরী করা আছে। আমার ছেলে তার দ্বারা আকর্ষিত হয়ে চলে যায় , আবার কি ভেবে ফিরে আসে। যত উঠতে থাকি রাস্তার দুপাশে কোমর পর্যন্ত উঁচু ফুলসমেত হাইড্রেনজিয়ার ঝোপ দেখে বিস্মিত হই। ফাঁকে ফাঁকে অ্যাজেলিয়ার বাগান। আমাদের ওখানে অ্যাজেলিয়া বাঁচতেই চায় না,চড়া রোদে জ্বলে পুড়ে যায়। আর এখানে অ্যাজেলিয়ার রূপ সৌন্দর্যের তাপে আমি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি। যতদূর চোখ যায় শুধু ফুলের মেলা। একপাশ থেকে ঘোরা শুরু করি। পার্কের মাঝখানে বামদিক ঘেঁষে একটা সুন্দর বাংলো বাড়ি। অনলাইন বুকিং করে রাত্রি থাকা যায়। এই দুর্গম ভুতুড়ে জায়গায় সে ধরণের কোন ইচ্ছে নেই আমার। দিনের বেলা যে রূপ সৌন্দর্য্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে, জনমানবহীন রাত্রিবেলা সেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলোর ছাদের ব্যালকনি থেকে দু-একজন সগর্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। যেন পার্কের ভেতরে এসে আমরা আর কি এমন করেছি,তার চেয়ে এখানে রাত্রি যাপন করে ওনারা ঢের বীরত্ব অর্জন করেছেন। আমি মনে মনে হার স্বীকার করে নিই। বাংলো বাড়ির চারপাশে টুকটুকে লাল রং এর জিরেনিয়াম ফুল সারি দিয়ে ফুটে রয়েছে। এই সমস্ত বিদেশি ফুল ইংরেজরা এনেছে না আপনা আপনিই ফুটেছে বোঝা মুশকিল। কিছু ফুলের মাতৃভূমি এটা তা বোঝা যাচ্ছে। মালির হাত তাকে বাগে আনতে পারেনি। আমার কাছে তো এটাই আস্ত বিদেশ। মাটির গঠন,গাছপালার ধরন,মানুষ, প্রকৃতি সবই অনেক আলাদা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নেশাগ্রস্ত মানুষ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ এসবের কোন কিছুই আমার হাতুড়ে ইঞ্জিনিয়ার(আমার ছেলে)কে আকৃষ্ট করতে পারেনা। পার্কের মাঝখানে একটা ছোট চালা তে ইঞ্জিন সমেত একটি খেলনা রেলগাড়ি দেখতে পেয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। চালার গায়ে সাঁটানো বিজ্ঞাপন জোরে জোরে পড়তে থাকে 'এখানে স্কুটি ভাড়া পাওয়া যায়।' পাওয়া যায় যাক,এখানে চালানোর দুঃসাহস আমার একাশি গুষ্টির নেই। পাশে একজন ভদ্রলোক নামের লিস্ট আওড়াতে থাকেন কোন কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব এখানে পায়ের ধুলো রেখেছেন। এইসব অঞ্চলে অনেক সিনেমার স্যুটিং ও হয়েছে। বাসে গাড়িতে সেই সব সিনেমার গান বাজতে থাকে। বাড়িটির শেষ দিকে কোন গার্ডওয়াল দেওয়া নেই , শুধু গভীর খাদ আর ঘন পাইন বন। দেখলে গা শিউরে উঠে। সামান্য অন্যমনস্ক হলেই প্রকৃতির আলিঙ্গনে হারিয়ে যেতে হবে। ঘুরতে ঘুরতে হাঁপিয়ে পড়ি। যেন শেষ ই হতে চায় না। বিভিন্ন দিকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কংক্রিটের ছোট ছোট চালা বানানো রয়েছে। সেখানে দাঁড়ালে দিব্যি দেখা যায় কুয়াশার চাদরে মোড়া দূরের পাহাড় আর ঘন পাইন বন।
সমস্ত পার্কের খুঁটি নাটি পর্যবেক্ষণ করি। হাইড্রেনজিয়া আর অ্যাজেলিয়ার ঘনত্বে নিজেরা মিলে মিশে যাই। হাল্কা ঢেউ খেলানো ঘাসের গালিচায় মনোমতো ঘুরে বেড়াই। একজায়গাতে নীল রঙে লেখা আই , মাঝে লাল রঙ এর হৃদয়, তার পর আবার নীল রঙ দিয়ে লেখা কালিম্পং। সকলেই এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার পর এই কথা বলবে তা কেউ জেনে গেছে। গোলাকার একজায়গাতে এশিয়াটিক লিলি হলুদ হয়ে ফুটে আছে। সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে পাশের পাইন বনেও নেমে যাওয়া যায়। যদিও ধ্যান মগ্ন প্রকৃতির ধ্যান ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হয় না। সে তপস্যারতই থাক। প্রায় দু-ঘন্টা মতো ফুলের রাজ্যে সাঁতার কেটে, প্রাকৃতিক সুরার শেষ নির্যাসটুকু পান করে আমরা পার্ক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি।
ফেরার পথে হনুমান মন্দির ও তার পাশে দুর্গা মন্দির দর্শন করি। হনুমান মন্দিরে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে তবে উপরে ওঠা যায়। বুকে হাঁফ ধরে। এখানে কুয়াশা আরও ঘন হয়ে মেঘের মতো নামতে থাকে। সারা শরীর ভিজিয়ে দেয়। সদা পরিবর্তনশীল এই আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বেশ মুশকিল। একরকম বুঝে ওঠার আগেই আরেকরকম এসে হাজির হয়। পাহাড়ের ওপরে বিশাল হনুমানের মূর্তি বসানো রয়েছে। ফটো তোলার বিরাম নেই। অবশেষে ঠাকুর দেবতার কৃপা ভিক্ষা করে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হই ।
0 Comments