পর্ব ৮২
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
নরেন্দ্রনাথ-জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি-রবীন্দ্রনাথ
নরেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রেম ও তৎবিষয়ে দক্ষতা সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা হয়েছে, যদিও তা যৎসামান্য। কিন্তু এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন কলকাতা শহরের সুবিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গটিও ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়াসে দ্বিতীয়বারের জন্য অবতীর্ণ হওয়া। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ রচিত ‘সঙ্গীত প্রতিভায় বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ এইরকম -- “...শ্রদ্ধেয় ডক্টর কালিদাস নাগ ‘বসুমতী’ পত্রিকায় ( ১৩৫৮ সাল, ফাল্গুন, পৃষ্ঠা ৬৩৭ ) এই সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন: ‘১৮৭৯ থেকেই -- ১৬ বছরের নরেন্দ্র ব্রাহ্মসমাজাদি নানা ধর্মসম্প্রদায়ে যাতায়াত শুরু করেন।’ তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত ও মেলামেশা করার পূর্বেই বেণী উস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ হিন্দুস্থানী গানের মতো বাংলা গানও কিছু কিছু শিক্ষা করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে মেলামেশার জন্য শ্রদ্ধেয় কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, কৃষ্ণকুমার মিত্র, আনন্দমোহন বসু, চিরঞ্জীব শর্মা, সঙ্গীতশিল্পী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুঞ্জবিহারী দেব, উমানাথ গুপ্ত, গগনচন্দ্র হোম প্রভৃতির সঙ্গে বিবেকানন্দের পরিচয় ঘটে। ত্রৈলোক্যনাথ সান্ন্যাল তখন নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ‘গায়কাচার্য’-পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেজন্য তাঁকে বলা হত ‘The Singing Apostle of New Dispensation Church’। কুঞ্জবিহারী দেব ও উমানাথ গুপ্ত এঁরা দুজনেও ছিলেন নববিধানের গায়ক ও গানরচয়িতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বিবেকানন্দের কিছুটা পরিচয় ছিল এই সময়ে। রবীন্দ্রনাথের রচিত ও সুর-সংযোজিত গান বিবেকানন্দ গাইতেন এবং ইংরাজী ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসুর কন্যার বিবাহ-বাসরে তাঁর গানই একথা প্রমাণ করে। গানটি ছিল -- ‘দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি,/ বল দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়’-- প্রভৃতি। শোনা যায়, কবি রবীন্দ্রনাথ রচনা করে এ গানটিতে নিজেই সুর যোজনা করেছিলেন এবং কিভাবে গান করা উচিত তাও বিবেকানন্দকে ( তখন তিনি নরেন্দ্রনাথ ) তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ প্রায় সমবয়সী ছিলেন, তবে স্বামীজী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা এক বৎসর আট মাসের ছোট। ‘১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে দেখি, কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঙ্গে রাজনারায়ণ বসুর কন্যার সভায় রবীন্দ্রনাথ-রচিত দুই- হৃদয়ের নদীর একত্র মিলিল যদি -- গানটি গেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ।’ এই ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া গেছে কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের সহধর্মিণী-লিখিত দিনপঞ্জী থেকে। তাছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গে বিবেকানন্দের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তখনকার দিনে বাঙলাদেশে বিশুদ্ধ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রাণকেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী। উচ্চাঙ্গ-হিন্দুস্থানী-সঙ্গীতের অনুকরণে তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ বহু গান রচনা করেন। তাতে ব্রাহ্মসঙ্গীতের ভাণ্ডার হয়েছিল সমৃদ্ধ।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র দীপেন্দ্রনাথ ছিলেন বিবেকানন্দের সহপাঠী। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দলাল সেনও ছিলেন বিবেকানন্দের সতীর্থ। ঠাকুরবাড়ীতে বিবেকানন্দের মেলামেশার প্রসঙ্গে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-গ্রন্থে লিখেছেন: ‘বিবেকানন্দ দীপুদাদার ( দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুর ) class friend ( সহপাঠী ) ছিলেন। তখন দুজনেই পড়তেন স্কটিশচার্চ কলেজে। আমাদের বাড়ীতে এলে দীপুদাদা ‘কে হে, নরেন? বলে ছুটে এসে দেখা করতেন। এতই ছিল হৃদ্যতা ও ভালবাসা!’ বিবেকানন্দের পাঠদ্দশায় ব্রাহ্মসমাজের গান তাঁকে সর্বদাই উদ্বুদ্ধ করে রাখত। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘অনুপম মহিমপূর্ণ ব্রহ্ম কর ধ্যান,’ রবীন্দ্রনাথের ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিতা’, বিষ্ণুরাম চট্টোপাধ্যায়-রচিত ‘অচল ঘন গহন গুণ গাও তাঁহারি’, রবীন্দ্রনাথের ‘( তাঁরে ), আরতি করে চন্দ্র-তপন, দেব মানব বন্দে চরণ’ প্রভৃতি গান বিবেকানন্দ প্রায়ই গাইতেন।
🍂 ...স্বামী বিবেকানন্দ ‘সঙ্গীত কল্পতরু’র সুদীর্ঘ ভূমিকায় তদানীন্তন সঙ্গীতজ্ঞানী ও সঙ্গীত গুণগ্রাহী স্যর সৌরীন্দ্রমোহনের উদ্দেশ্যে তাই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় ‘সঙ্গীত সাধনায় বিবেকানন্দ ও সঙ্গীত কল্পতরু’-গ্রন্থে সৌরীন্দ্রমোহন সম্বন্ধে লিখেছেন: ‘স্বামীজী যে তখনো ( ২৩ বৎসর বয়সে ) সঙ্গীত-সাহিত্য এবং সাধারণভাবে সঙ্গীত সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ও ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা ( সৌরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ) এই শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে বেশ বোঝা যায়।’ স্বামীজী সৌরীন্দ্রমোহন-সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ সম্বন্ধে মহারাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সমস্ত হিন্দুজাতির অকপট কৃতজ্ঞতার পাত্র। তাঁহার যত্নে, তাঁহার অধ্যবসায়ে এবং তাঁহার বিপুল অর্থ-সাহায্যে এই মুমূর্ষু সঙ্গীতশাস্ত্রের পুনরুদ্ধার হইতেছে।’
স্বামী বিবেকানন্দ ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ যখন সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন, তখন সৌরীন্দ্রমোহনের বয়স ছিল ৪৫-৪৬। বিশেষ করে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে তখন উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের অনুশীলন পুরোমাত্রায়ই চলছে।”
নরেন্দ্রনাথের সঙ্গীত চেতনা জন্ম দিল শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা সঙ্গীতের, তিনি তখন বিবেকানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ণ-নরেন্দ্রনাথ দিব্য সম্পর্কের সেতুবন্ধনে মূল ভূমিকা ছিল সঙ্গীতের। সঙ্গীত ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে পৌঁছে দেয়, সুতরাং স্বয়ং ঈশ্বরপুরুষেরা যে এতে মগ্ন থাকবেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। উত্তরকালে নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দরূপে রচনা করলেন শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা সঙ্গীত -- শ্রীরামকৃষ্ণ-আরাত্রিক। মিশ্র-চৌতাল রাগে সেই আরাত্রিকের কথাগুলি অপূর্ব। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতি কেন্দ্রেই যা সন্ধ্যা আরতি রূপে গীত হয়। আরাত্রিকের কথাগুলি এইরকম -- খণ্ডন ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।।/ নিরঞ্জন নররূপ-ধর নির্গুণ গুণময়।।/ মোচন অঘদূষণ জগভূষণ চিদ্ঘনকায়।/ জ্ঞানাঞ্জন বিমল-নয়ন বীক্ষণে মোহ যায়।। ইত্যাদি।
আবার কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ‘যে রাম, সেই কৃষ্ণ, ইদানীং সেই রামকৃষ্ণ’, শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমুখনিঃসৃত এই কথাগুলি শ্রবণ করার পর তা স্মরণে রেখেছিলেন স্বামীজী। বিলেত থেকে কলকাতায় ফিরে বেলুড় মঠে একটি স্তব রচনা করেছিলেন। স্তবে বলেছেন -- যিনি আচণ্ডাল দীন-দরিদ্রের বন্ধু জানকীবল্লভ, জ্ঞান ভক্তির অবতার শ্রীরামচন্দ্র। যিনি আবার শ্রীকৃষ্ণ-রূপে কুরুক্ষেত্রে গীতারূপ গম্ভীর মধুর সিংহনাদ করেছিলেন, তিনিই ইদানীং প্রথিত পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো যস্য প্রেমপ্রবাহো/ লোকাতীতোহপ্যহহ ন জহৌ লোককল্যাণমার্গম।/ ত্রৈলোক্যেহপ্যপ্রতিমমহিমা জানকীপ্রাণবন্ধো/ ভক্ত্যা জ্ঞানং বৃতবরবপুঃ সীতয়া যো হি রামঃ।। ইত্যাদি।
আর একটি স্তোত্র সঙ্ঘের সকল কেন্দ্রেই আরতির সময় গীত হয়। এই স্তোত্রে স্বামীজী বলেছেন -- হে দীনবন্ধো, তুমি সগুণ আবার ত্রিগুণাতীত, তোমার পাদপদ্ম দিনরাত ভজন করছি না, তাই তোমার আমি শরণাগত। আমি মুখে ভজন করছি, জ্ঞানানুশীলন করছি, কিন্তু কিছুই ধারণা হচ্ছে না তাই তোমার শরণাগত। তোমার পাদপদ্ম চিন্তা করলে মৃত্যু জয় হয়, তাই আমি তোমার শরণাগত। হে দীনবন্ধো, তুমি জগতের একমাত্র প্রাপ্তব্য বস্তু, আমি তোমার শরণাগত। ত্বমেব শরণং মমো দীনবন্ধো!
ওঁ হ্রীং ঋতং ত্বমচলো গুণজিৎ গুণেড্যো।/ ন-ক্তন্দিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম।/ মো-হঙ্কষং বহুকৃতং ন ভজে যতোহহং/ তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ইত্যাদি। আরতির অন্তে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণাম শিখালেন স্বামীজী, যেখানে ঠাকুরকে অবতারশ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।/ অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ।।
0 Comments