কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-১২
সুমিত্রা মাহাত
বাসে উঠে অবাক হয়ে যাই। যে স্থানীয় মেয়েগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল , তারাও ফিরে যায়নি,আমাদের সহযাত্রী হয়েছে। বেশ কয়েকটি সীটে তারা জোড়ায় জোড়ায় বসেছে। নিজেদের সম্পূর্ণ একা মনে করে কিছুটা ভীত হয়েছিলাম, এখন মনে বল পাই। দেওরকে ঘন ঘন নক করি। আহার বিহারের ব্যবস্থা সে করবে।
জগৎ সংসারে কত রকমের মানুষ যে আছে তা বলে শেষ করা যায় না। কেউ বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে,কাউকে হাজার বোঝালেও বুঝতে চায় না,কাউকে কিছু বলারই প্রয়োজন হয় না,মুখ দেখলেই মন পড়তে পারে। বিশেষ পরিবেশে , বিশেষ আচরণ ই মানুষ কে অন্য মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়। মনে তার ছাপ পড়ে যায়। এমনই এক ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে আমার এক ঘোড়া রোগের কথা না বললেই নয়। দৈহিক সৌন্দর্য, ঠাট-বাট,অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়েও একজন মানুষের মানসিক ওঠা - পড়া আমি অনেক বেশি নজর করি। তাতে পথের ধুলায় যেমন হীরা-মাণিকের সন্ধান পেয়েছি,তেমনি অনেক সময় রাজপ্রাসাদেও শুকনো আঁটি ছাড়া আর কিছুই পাই নি। মানুষের আত্মা কেই নিরূপণ করার চেষ্টা করি,তা কতখানি উৎকৃষ্ট। শিশুকালে এই নিরূপণ অত্যন্ত জরুরী। বাবা মা সচেতন ভাবে যদি শিশুর জন্য উৎকৃষ্ট আত্মার সান্নিধ্য নির্ধারণ করে দেন,তবে শিশুর মনের গড়ন হয় আকর্ষণীয় সুন্দর। উচ্চতর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় সে। আমি তখন ছেলের চিন্তায় ডুবে রয়েছি । অত জন মেয়ে বাসে ওঠে, সকলেই ফর্মালিটি মেইনটেইন করে যে যার সীটে বসে পড়ে। মাত্র একজন তার ব্যতিক্রম হয়। চোখাচোখি হতেই প্রশ্ন করে বাবু কোথায়,একা সামনে বসতে পারবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি খুবই উপভোগ করি তার এই আকুলতা। অন্যের অবস্থা ফিল করার ক্ষমতা যার যত বেশি,সে জীবন যুদ্ধে তত এগিয়ে থাকে। অনেক কঠিন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকে তার। আমি তাকে ছেলের বিষয়ে আশ্বস্ত করি। অনেকের মাঝে তার মুখ আমার বিশেষ ভাবে মনে থাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি ছাড়ে। আমাদের সঙ্গে আসা সব পরিবার ই রয়ে গেছে। শুধু আমরাই কালিম্পং ছেড়ে নেমে আসি। জার্নি শুরুর প্রথম এক-দেড় ঘন্টা খুবই সুন্দর কাটে। পরিষ্কার আকাশ। মনোরম আবহাওয়া। বাসে চলছে রোমান্টিক হিন্দী গান। আহা! মন পালকের মতো ভেসে চলে যেতে চায় দূরে ...আরো দূরে। রাস্তার ধারে নানারকম গাছের নার্সারি আজ চোখে পড়ে। যখন চেয়েছি,তখন পাইনি। পাহাড়ি মেয়েগুলো একে একে সঙ্গীর কোলে ঢুলে পড়েছে। মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া,মৃদুমন্দ গানের ধারা,পাহাড়ি মেয়েদের স্নিগ্ধ প্রেম, সবই যেন একরাশ জলভরা নরম মেঘের মতো মনকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই। আমি আপ্লুত হই।
🍂 ধীরে ধীরে প্রেক্ষাপটের বদল ঘটতে থাকে। আজ একটি বিষয় লক্ষ্য করছি। আগের দিন পাহাড়ের কোল বেয়ে উঠেছি,তাই কিছু মনে হয় নি। আজ গাড়ি খাদের দিক দিয়ে যাচ্ছে। তাই কিছুটা ভয় ভয় করছে। যেন আমিই স্টিয়ারিং ধরে বসে আছি। হামেশাই মনে হচ্ছে এই গেল-গেল-গেল-গেল। দুহাত ঘুরিয়ে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় তাতে কাল্পনিক মোচড় দিচ্ছি। দুরু দুরু বুকে আমার হিতাকাঙ্খীর কথা স্মরণ করি আর আদি দেবতার নাম নিই। ক্রমশ পাইন বন জুড়ে নেমে আসে ঘন ঘোর অন্ধকার। তার সঙ্গে সঙ্গেই অপদেবতারা যেন ডালে ডালে লাফ দিয়ে অট্টহাস্য করতে থাকে। একটানা একটা ঝিঁ-ই-ই-ই শব্দ কান জুড়ে থাকে। বহুদূর ছাড়া ছাড়া দুএকটা বাড়িতে টিমটিমে আলো চোখে পড়ছে। বাকী সব ভুতুড়ে অন্ধকার। হঠাৎ কি একটা অজানা পাখি চিৎকার করে ওঠে। নীচ থেকে ওঠা গাড়ির আলোয় আঁকা-বাঁকা সর্পিল রাস্তা দেখে গা কেঁপে যায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি পাহাড়ি পথে,শেষ বাসে আর কোনদিনও নয়। বাম দিকে খাদ , আর নিকষ কালো অন্ধকার। তার মধ্যে তিস্তা নদী মস্তোবড়ো অজগর সাপের মতো এঁকে-বেঁকে চলে গেছে। গাড়ি পাইন বনের বুক চিরে বেঙ্গল সাফারি তে প্রবেশ করলে,পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। লম্বা পাইন গাছগুলো কালো কালো হাত বাড়িয়ে যেন ধরতে আসে। আমি রুদ্ধশ্বাসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকি , বাস কখন পৌঁছবে। একবার ঘন জঙ্গলের মাঝখানে হঠাৎ গাড়ির স্পীড কমে যায়। অন্ধকারে তাকিয়ে দেখার সাহস হয় না। ডানদিকে যারা বসেছিল তারা বলে , কিছুক্ষণ আগেই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। অনেকে আলোচনা করে , বাস বেঙ্গল সাফারি মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় , রাতের অন্ধকারে প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হয়। অ্যাকসিডেন্ট এখানকার স্বাভাবিক ঘটনা ! হাজব্যন্ডকে গুঁতো মেরে ঘন ঘন ছেলের কাছে পাঠাই। যাইহোক ছেলে সামনে একা বসলেও শেষ পর্যন্ত কোন সমস্যায় ফেলেনি। বিপজ্জনক পাহাড়ি বাঁক,খাড়া পিছল রাস্তা,ঘন অন্ধকার,উল্টোদিকের গভীর খাত সব মিলিয়ে গভীর আতঙ্ক বুকে চেপে বসে। শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়। এখানে বন্য জীবজন্তু মুক্ত জীবন যাপন করে। তার দু-একটা সম্মুখে চলে আসাও বিচিত্র কিছু নয়। কিছু একটা খস্ খস্ শব্দ করে বাসের জানালা ঘেঁষে উড়ে চলে যায়। খাদের দিকে তাকাতে গিয়ে , আমার জীবনের প্রতি মায়া চলে যায়। বিশ্বাস ই হয় না আমি বেঁচে ফিরব। রাস্তার ধারের সরু রেখা দিয়ে গাড়ি একবার মার্জিনে বাঁক নেয়। আমার শরীর হাল্কা হয়ে যায়। দিনের বেলা যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে,রাতের বেলা নির্দ্বিধায় তার মায়া ত্যাগ করি। তার ভয়ঙ্কর রূপ আমার সাহসের সীমারেখা টেনে দেয়।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ রাস্তা রুদ্ধশ্বাসে পার হয়ে অবশেষে জঙ্গল শেষ হয়। দূরে কয়েকটা বাড়ি - ঘরে আলো দেখা গেলে , ধড়ে প্রাণ আসে। বাস একটা স্টপেজে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। ড্রাইভার সহ সকলে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে নেয়। এরপর কিছুটা ছাড়া বাড়ি ঘর চোখে পড়ে। কিছুটা অন্তর , অন্তর পাহাড়ি মেয়েগুলো একেকজন নেমে যায়। তাড়াহুড়োতে একজনের কলম,জাপানী হাত পাখা , আরো নানা জিনিস , গোটা বাস পড়ে পড়ে যায়। পরের স্টপেজে যে নামবে , সে , সব কুড়িয়ে রাখে। পরে দিয়ে দেবে। ধীরে ধীরে গাড়ি সমতলের পথ বেয়ে শিলিগুড়ি শহরে প্রবেশ করে। অধিকাংশই নেমে যায়। অবশেষে , নদীর ওপর দিয়ে একটা বড়ো ওভার ব্রীজ পেরিয়ে , পেট্রোল পাম্পের কাছে আমরা নামি। দেওর কে আগেই ফোন করেছি,তার নির্দেশ মতোই এখানে নামি। আমাদের অবাক করে দিয়ে, ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে , তারা তিনজনেই নিতে আসে। অনেক দিন পর তাদের দেখে খুব ভালো লাগে। মৃত্যু ভয় কাটিয়ে ওঠার পর আপনজনের দেখা মিললে যা হয় আর কি ! বিদেশ বিভুঁই এ চেনা মুখ দেখলে কি যে আনন্দ হয়,বলে বোঝানো যায় না। উষ্ণ অভ্যর্থনা সহযোগে আমাদের গাড়িতে তোলে। দেওর এখানে চাকরি করে। সুন্দরভাবে ড্রাইভ করে নিয়ে যায় আমাদের। আগেই বলেছি শিলিগুড়ি যথেষ্ট ব্যস্ত শহর। যদিও এই রাস্তাঘাটে তারা অভ্যস্ত।
তাদের আন্তরিক ব্যবহারে আমাদের যাত্রা পথের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মেয়ের অসুস্থতা কিছুটা বাড়ে। টানা জার্নি ওর শরীর নিতে পারে না। বড়ো রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ক্যাম্পাসে ঢোকে। অনেক বড়ো জায়গা, খোলামেলা চারিদিক। দোতলার ওপর ওদের কোয়ার্টার। সুন্দর ছিমছাম, সাজানো গোছানো। বাচ্চারা সঙ্গী পেলে,আর কিছু চায় না। দুই ছেলে খেলাধূলায় মেতে ওঠে। রাত্রি যথেষ্ট ই হয়েছে। সবাই মিলে অনেক গল্প হয়। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুতেই ওঠানো যায় না। এদিকে ফেরার টিকিট কনফার্ম হয়নি। তা নিয়েও আলোচনা চলে কিছুক্ষণ। প্রায় দু-মাস আগে কাটা। কনফার্ম হয়ে যাবে, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, যদিও দেওর জানায় এই রূটে ওয়েটিং পাঁচ নম্বরে থাকলেও কনফার্ম হওয়া মুশকিল। আমাদের তা জানা ছিল না। কনফার্ম টিকিট ছাড়া অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কীভাবে যাবো তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত হই। তবুও সেসব ভুলে , অনেক দিন পর আমরা একত্রিত হয়েছি, সেই আনন্দ উপভোগ করি। শরীর আর সায় দেয় না। সারাদিনের ধকল। অনেক কথা-গল্প-স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা নিদ্রা দেবীর কোলে আশ্রয় নিয়ে নিই।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments