সুমিত্রা ঘোষ
প্রতিভাময়ী রানি বড়লোকের বাড়ির বৌ হয়ে এসে স্বীয়গুণে সকলকে আপন করেছিলেন। পরম কৃষ্ণভক্ত পরিবারের কন্যা এলেন পরম শিবভক্ত জানবাজারের জমিদার বাড়িতে। বিয়ের পর রানি জমিদারবাড়ির বউ হয়ে এসেও নিজেকে পূর্বের জীবনে ধরে রাখলেন কেবলমাত্র কর্তব্যপরায়ণতা ও পূজাআচ্চায় কিছুটা পরিবর্তন আনলেন। বিয়ের আগে সংসারে সদস্য বলতে পিতা হরেকৃষ্ণ দাস, দুই দাদা এবং এক পিসিমা ছাড়া আর কেউ ছিল না। মাত্র ১১ বৎসর বয়সে জমিদার- বাড়িতে এসে রানি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি বরং তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অফুরন্ত গুণাবলীর জনই আপামর মানুষের হৃদযে যথার্থ রানি হয়ে উঠেছিলেন। রানি রাসমনি সংসারের সব কাজই করতেন। শ্বশ্রূমাতা বারণ করলেও শুনতেন না তখন প্রীতরাম দাসের পরিবারে সদস্যসংখ্যা কম নয়। প্রীতরাম দাসের-স্ত্রী-মায়ার মা-বাবাও ঐ জমিদার বাড়িতে বসবাস করতেন। দিদিমার (রাজচন্দ্রের) যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল সকলকে বশীভূত করে রাখার চেষ্টা করতেন।
🍂জমিদার বাড়ির বউ হয়ে আসার পর তাঁর ধর্মজীবনের উন্মেষ হল। নিয়মিত পূজা, আহ্নিক শুরু করলেন রানি রাসমণি। সেই সময় থেকে ধর্মপরায়ণতার পাশাপাশি তাঁর ভিতরে ছিল দুঃস্থ ও আর্তের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস। রানির বিয়ের পর এই সমস্ত সদগুণের উন্মেষ ঘটতে লাগল। পরবর্তীকালে এই সমস্ত গুণের দ্বারা তিনি স্বহস্তে জমিদারি চালিয়েছেন এবং প্রজাদের স্বার্থরক্ষায় সর্বদা তৎপর থেকেছেন। প্রজাদের সন্তানসম ভালবাসতেন রানি রাসমণি।
রাজচন্দ্র দাস ও রানীর বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমা যাপনের ঘটনা উল্লেখ করে পরবর্তী পর্যায়ে যাব। রাজচন্দ্র দাস বিয়ের পর পরিবারের সংস্কার না মেনে রাসমণিকে নিয়ে মোকিম তালুকে গেলেন মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য। প্রীতরাম দাসের অনেক তালুকের মধ্যে মোকিম একটা নামকরা তালুক। রাজচন্দ্রের মা মায়া দেবীর এ ব্যাপারে কোনো সায় ছিল না কারণ তখনকার দিনে ঘরের বৌ পরিবারের সান্নিধ্য ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে তালুকে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবেন এমনচিন্তা করাও ঘোর অন্যায় ছিল। পরিবারের বয়স্ক মহিলারাও তালুকে রাত কাটানো মেনে নিতে পরেননি। যদিও তারা বিরূপ মন্তব্য করেননি। রানিকে প্রীতরাম অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই স্ত্রী মায়া দেবীকে বলেন যে সে বড়বৌমার মত ছোটবৌমাকে আপন করে কাছে টেনে নিলে বৌমা স্বামীর সঙ্গে মোকিম তালুকে যেতেন না। রাজচন্দ্রের বিয়ের পর থেকে প্রীতরামের বাঁশ ও নুনের ব্যবসা অবনতি হতে শুরু করে। তখন মায়াদেবী স্বামীকে বলেন যে এর মূল কারণ ছোট বৌমা কোনো সংস্কার মানে না। মোকিম তালুকে মধুচন্দ্রিমা যাপন করা মায়াদেবীর কাছে সংস্কার না মানা মনে হয়েছিল। তখন প্রীতরাম স্ত্রীর কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন বাঁশ ও নুনের কারবারে তিনি যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। এরপর দুএকবার ব্যবসায় অবনতি হতেই পারে একে লাভ বা ক্ষতির হিসেবে ধরা ঠিক নয়। তাছাড়া রানি সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ ছিলেন।
তখনকার দিনে চারিদিক বনজঙ্গলে ভরা ছিল। তারই মধ্যে ছিল সব ডাকাতদের আস্তানা। রঘু ডাকাত ও ভৈরব ডাকাতের নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। এইসব ডাকাতদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য জমিদারদের সঙ্গে লেঠেল থাকত। বিয়ের পর রাজচন্দ্র মোকিমপুর তালুকে মধুচন্দ্রিমায় গেলেন কিন্তু সঙ্গে কোনো লেঠেল রাখলেন না। তবু একজন লেঠেল রাজচন্দ্রের কথা না মেনে ওই তালুকে থেকে যায়। ওই তালুকে সে সময় ভৈরব ডাকাতের প্রবল প্রতাপ ছিল। মা কালীর কাছে নরবলি দিয়ে ও লোকজনদের সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে চারিদিকে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।
ক্রমশ
0 Comments