জ্বলদর্চি

পাতখালি /সুমিত্রা মাহাত

পাতখালি

সুমিত্রা মাহাত

বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি সকাল হলেই মেয়ে , বউ  দলে দলে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে । হাতে বড়ো বাঁশ ডগালি। বাঁশ ডগালির মাথায় শক্ত করে দা বাঁধা। তাদের উৎসাহ আর গতিবেগ লক্ষণীয়। ভোরখোরি রোদে , বড় বেলায় , অনেক সময় পাওয়া যায়। বহু , বিটি রা তারই কাঁচামাল সংগ্রহ করতে বনে যাচ্ছে। শিশুদের কাছে হাঁড়ির খবর থাকে। চোখ না বেঁধে ,গীতা তে হাত না দিয়েও তারা নির্ভেজাল সত্য কথা বলে। একজনের অকৃত্রিম উক্তি, ' এখঅন তঅ কনঅ কাজ নায় , বিলে জঅল নাই, ওরহা বঅন যাছে। পাত তুইলতেএ। খালিপাত টিপবেক। এখঅন তঅ একশঅ তিরিশ টাকা হাজার। উ টাকাটায় সদাপাতি, কাঁচা আনাইজ কিনবেএক।'

একটা ছোট শিশুও বোঝে জীবনের মানে। বিলে জল নেই তাই মায়ের কাজ নেই। দিনমজুর বাবার একার রোজগারে সংসার সচ্ছল হয় না। মাও বিলের কাজে যায়। গরুর , ছাগল , কাড়া বাগালি ,এর - তার বিলে তলা টানা , ধান লাগানো এখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রফেশন। ছোট বেলায় এর কোন একটা প্রফেশনের মধ্যে দিয়ে যায়নি এরকম কুড়মী ছানা বিরল। কিছু না হলে মা অন্তত মুরগী ছানাগুলোকে পাহারা দিতে বলে। না দেখলে চিলে নিয়ে যাবে। ' বিলএ ধান, গঅহাইলএ গোরু, ঘরে খুখড়া ',মা আর কত ঝামেলা পোহাবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল গরু,কাড়া বাগালি করতে গিয়ে কত যে শিল্পীর উদ্ভব হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যাওয়ার সময় ছেলেরা সঙ্গে নেয় কাঠ বাঁশী, গুলতি,মেয়েরা ঠ্যেঙ্গা , দা-বাঁধা ডগলী। গরু ছেড়ে দিয়ে মেয়েরা গরু-ছাগলের জন্য পাতা তোলে,ঘাস কাটে,বুনো ফল পাড়ে,কহনি - ভাঙ্গানি বলে। দাঁতনকাঠি ভাঙ্গে। ছাতু,বনমুরগীর ডিম কুড়ায়। বন খেজুর, পেঁয়াজ, রসুন,ঘি কাল্লা, বন পুঁই তোলে। তারপরেও সময় পেলে শাশুড়ি-ননদের গুষ্টি উদ্ধার করে। কহনি-ভাঙ্গানি,প্রবাদ প্রবচন ছাড়া এরা কিছুই বোঝে না।এর মাধ্যমেই শিক্ষা দান করে।ছেলেরা আপন মনে বাঁশী বাজায়,মেয়েদের নাগালের বাইরে থাকা বুনো ফল গাছের মগডালে উঠে সংগ্রহ করে,বিলে পাটা আড়া থাকলে তা ঝাড়ে, গুলতি দিয়ে শিকার করে আরো কতো কি....একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই প্রফেশন এখনও টিকে আছে ভাবা যায় ! কখনও কখনও এদের মধ্যে ভাব ভালোবাসাও জন্ম নেয়। তাই বাগালির প্রসঙ্গ উঠলেই উভয়ই এক পা বাড়িয়ে রাখে। কলকাতায় গঙ্গানদীর তলা দিয়ে পাতালরেল চালু হয়ে গেল তাও এদের গরুবাগালি আর ঘুচল না!
🍂

এবারে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘোরতর। আষাঢ় মাস , তবু ভালো বৃষ্টি নেই। চাষিদের মাথায় হাত। যাদের যেমন মিনি আছে জল তুলে জমি কাদা করছে। সারাদিন তপ্ত রোদ, বিলের কাজ নেই , মেলা সময়। বৃষ্টি পড়লেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে , কে আগে চাষ তুলতে পারে। রাস্তার দু-ধারে কুড়চী গাছ , ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। মিষ্টি গন্ধে আশপাশ ম ম করছে। আশ্চর্যের বিষয় পাতার কিনারা রোদে জ্বলে গেছে। এরকম দৃশ্য আগে দেখিনি। জল নেই বলে এবার রহইন পুটকা ওঠেই নি। পুটকা ছাতু সাধারণত দু- রকমের হয়। রহইন পুটকা আর সাঁচী পুটকা। রহইন পুটকার খোলাটা কালো,ভেতরে নরম সাদা অংশ। সাঁচী পুটকার খোলা ও ভেতরের অংশ উভয়ই নরম সাদা। রহইন পুটকা রহইন এর সময় ওঠে। সাঁচী পুটকা পাওয়া যায় মোটামুটি আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণের মাঝামাঝি পর্যন্ত। টুকটাক হেরফের হয়। শীত ও বসন্তে হলুদ শালপাতা ঝরে পড়ে। লাল,কাঁকুরে মাটি শুকনো শালপাতায় ঢেকে  যায় , গ্রীষ্মের চড়া রোদে , উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই মাটি যখন শীতল বারিধারার স্পর্শ পায় তখন শাল বুদার ফাঁকে ফাঁকে মাটির চাঙ্গর ফুলে ওঠে। মাটি সরালেই পাওয়া যায় পুটকা ছাতু। তখন আর তরিতরকারির অভাব থাকে না। ঘরে ঘরে প্রায় প্রতিদিনই রান্না হয় পুটকা ছাতু।
ভূগোল শিক্ষকের প্রবল প্রচেষ্টার পর যেটুকু বুঝেছি, ভারত মানচিত্রের অনেকটাই প্রাচীন গন্ডোয়ানার নাড়ী ছেঁড়া ধন। আফ্রিকার দিক থেকে ছিঁড়ে এসে ভারতমাতার রূপ দান করেছে। ভাগ্যিস এই খাঁড়াতে আছি বাবা! নাহলে পুটকা ছাতু,কাড়হানি ছাতু কপালে জুটত কি!

যাক এবার আসি খালিপাত টিপা প্রফেশন সম্পর্কে। শীত ও বসন্তে শাল গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়। তারপর ন্যাড়া গাছ পুনরায় নরম কচি পাতায় ভরে ওঠে। পাতা পরিণত হলে , তা খালিপাতা বানানোর উপযুক্ত হয়। বিলের কাজ না থাকলে , পাতা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তা সংগ্রহ করে খালিপাতা বানানো চলে। অতিরিক্ত বর্ষণ কিংবা শীত যত কাছে আসতে থাকে পাতার দম ফুরায়। তখন তা পূজা অর্চনা আর ছাগলের জন্য লাগে। যেকোন পূজায় শালপাতার খালা,খালি পবিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শাল, মহুল ডালা অত্যন্ত শুভ মানা হয় ও নানা অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। অত্যন্ত সুপ্রাচীন এই বৃক্ষ গুলি মানুষের আদিম বন্য জীবনযাত্রার দীর্ঘদিনের সাথী। যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবন জীবিকার নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে শাল,মহুল। 
পাতা ডাঁশা হলেই মেয়েদের মধ্যে বনে যাবার ধূম পড়ে যায়। রঙ্গ - রসিকতায় ভরা খুবই উপভোগ্য এই বনযাত্রা। নিপুণ হাতে,সজাগ দৃষ্টি তে বাছাই করে পাতা তোলে মেয়েরা। ভাগ্য ভালো থাকলে শিয়াড়চাঁদা,লাকড়া, হুঁড়ার এর দেখা পায় কখনও কখনও। অবশ্য মেয়েরা সবসময় দল বেঁধেই যায়। এতে বিপদের মোকাবিলা করতে সুবিধা। যে পেশাতে পরিশ্রম ও প্রচন্ড ধৈর্য্যের প্রয়োজন তাতে চিরকাল ই সফলতা দেখিয়েছে মেয়েরা। চা বাগানে তাই মহিলা শ্রমিক অগ্রগণ্য। এক্ষেত্রেও বন থেকে পাতা তুলে , বোঝা বেঁধে , বাড়ি আনার পর, একটার পর একটা পাতা জুড়ে মেয়েরা নির্মাণ করে খালিপাতার সুদৃশ্য অবয়ব। চোখের পলকে শ শ পাতা সেলাই হয়ে যায়। টিপার জন্য ব্যবহার করে নিমকাঠি অথবা খেজুর ডালার মিহি সুতো। অনেক সময় তা না পাওয়া গেলে বন থেকেই টিপার উপকরণ সংগ্রহ করে আনে। পাতা ঝরার সময় তারা নিমকাঠি সংগ্রহ করে রাখে। প্রায় দলবদ্ধ ভাবে কাজে নামে, ফলত হাসি মসকরার মাধ্যমে কষ্ট লাঘব হয় ও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে এই কাজ। এই প্রসঙ্গে মা,পিসিদের প্রচলিত গালি মনে পড়ে যায়। ছোট মেয়েরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে খালিপাতা সেলাই করলে গালি শুনতে হয় ' পড়হাশুনহা করিস না,পাত খালি করিঞ খাবিস।' অর্থাৎ এই পেশাতে যে কষ্ট ও ঝুঁকি রয়েছে তা ভবিষ্যতে তারা পারবে না,তার চেয়ে পড়াশোনা করা ভালো। কে শোনে কার কথা , এই বনযাত্রা র লোভ সামলানো যায় না। আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি তাদের সাথে ছুটেছি বন দর্শনে। আসলে মানুষ ও মানব সভ্যতা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। তাই  অরণ্যের অধিকার আমাদের আর থাকবে কিনা সন্দেহ।   হয়ত বন জঙ্গল মুছে গিয়ে গড়ে উঠবে দামী, উন্নত নগর সভ্যতা। তাই জংলীপনা ছেড়ে,পড়াশোনা শিখে , নগর সভ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়াই শ্রেয়। তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয় হোক না! আবার সব গোড়া থেকে শুরু হবে! নাও হতে পারে ! বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে মানব সভ্যতা ! তাতেই বা কি এসে যায়!
আগে যখন শুধু কুঁয়ো ছিল, কষ্ট করে জল তুলতে হোত,তখন মানুষ জল খরচ করত প্রয়োজনমতো। ভূগর্ভে বৃষ্টির জল প্রবেশের রাস্তাও ছিল কুঁয়ো। তারপর মেঘে মেঘে বেলা বয়ে গেছে। পুকুর, কুঁয়ো ভরাট হয়েছে। এখন মোটা পাইপের সাহায্যে জল শুধু ওপরে ওঠে। পৌরসভার মাথাবিহীন কলে অবিরাম জল পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা। গৃহস্থের ঘরে একবালতির জায়গায় খরচ হয় দশ বালতি। এভাবেই যতদিন চলে....

যাইহোক আবার খালি টিপা শুরু করি ....
পাতা সেলাই করার পর একদিন বা দুদিন রোদ খাওয়াতে হয়। তারপর একশ টা করে পাতা একসঙ্গে বোঝা বাঁধে। এরকম দশটা বোঝা তে হাজার। হাজারের বান্ডিল ১৩০ থেকে ২০০ টাকা দরে কিনে নিয়ে যায় মহাজন। এই টাকাতে অভাব মেটে না , দিন গুজরান হয়। এই পরিশ্রম যদি তারা অন্য কাজে দেয় তবে অনেক বেশি লাভবান হবে। আসলে খালিপাতা টিপা একটা নেশা। রোজগারের চেয়েও বেশি ভালোলাগা ও ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এই প্রফেশনে। তাই তো আজও ছাড়তে পারেনি মানুষ !


Post a Comment

0 Comments