মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬৩
সুচরিতা দাশ (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, নারী শিক্ষার প্রসারে সৈনিক, তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
নিতান্ত পল্লীগ্রাম ছিলো তখনকার তমলুক। ঝোপ জঙ্গলের সাথে সহবাস ছিলো শেয়াল আর শ্বাপদের। অসংখ্য ছায়াধারী তরুতল আর জল থই থই তড়াগের উপস্থিতি। সন্ধে হলেই তমলুকের কানে কানে শোনা যেতো ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। গুটিকয়েক স্থানে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে জ্বলে উঠতো কেরোসিনের ল্যাম্প। সেই মৃদুমন্দ আলো অপারগ ছিলো তমলুকের পরিবেশের জমাট অন্ধকার দূর করতে। এমতাবস্থায় সেখানে এসেছিলেন আলোকবার্তিকা সুচরিতা দাশ। ঘোমটা পরা সালঙ্করা অথচ পেটে অক্ষরহীন বালিকাদের জীবনের অন্ধকার দূর করার অভয়বাণী দেওয়া আদরের 'রীতাদি'।
তমলুকের বিখ্যাত রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন সুচরিতা দাশ। তখনও স্বাধীনতা পায়নি ভারত। ১৯৪০ এর ২৪ শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্যার জন আর্থার হার্বাট এর পত্নী লেডী মেরি হার্বাট ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বালিকাদের এই বিদ্যালয়টির। যদিও আগে বিদ্যালয়টির নাম ছিলো হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়। মহিষাদলের রাজকুমার দেবপ্রসাদ গর্গ এর প্রয়াতা বোন রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ীর নামেই হলো স্কুল। ঐ বছরেই ১ লা জানুয়ারি সুচরিতা দাশ মাত্র ৯০ টাকা বেতনে হলেন প্রধান শিক্ষয়িত্রী। শুরু হলো ঐতিহাসিক তমলুকের বুকে নারীশিক্ষা আন্দোলনের এক অনন্য ইতিহাস। ১৯৮০ এর ৩১ শে মার্চ অবসর গ্রহণ পর্যন্ত যে কাজ তিনি করে গিয়েছেন তমলুকের বুকে তা আজও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে তমলুকের মানুষ। মেদিনীপুরের মানুষ না হয়েও মেদিনীপুরের মাটিকে তিনি আত্মীকরণ করে নিয়েছেন হৃদয়ের প্রতিটি কোনায়।
তাঁর জন্ম মেদিনীপুরের বুকে হয়নি। কিন্তু আজীবন নিজের জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন মেদিনীপুরের অবলা মেয়েদের মূক মুখে ভাষা যোগানোর জন্য। মেদিনীপুরবাসী ভোলেনি এই মানুষ রতনটিকে। ১৯১৫ এর ১ লা এপ্রিল বাংলাদেশের বরিশালে জন্ম হয়েছিল সুচরিতা দাশের। বাবা সত্যানন্দ দাশ এবং মা কুসুমকুমারীর দুই পুত্র এবং এক কন্যার মধ্যে তিনি একজন। তিনি নাটোরের বনলতা সেনের স্রষ্টা দুই বাংলার ঘরের কবি জীবনানন্দ দাশের একমাত্র বোন।
তখনও পরাধীন দেশ। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিলো নিত্যনতুন সমস্যা। তথাপি দৃঢ় হাতে ধরলেন বিদ্যালয়ের রাশ। অতি নগন্য ছাত্রী সংখ্যা। কিভাবে জ্বলবে শিক্ষার আলোকবর্তিকা? ১৯৪৪ এ মাত্র ৭ জন দিলেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টি হয়ে উঠলো নারীর উন্নয়নের সম্পদক্ষেত্র।বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দানের মাধ্যমে ছাত্রীদের দেওয়া হতে লাগলো যথার্থ শিক্ষা।
১৯৫৭ সালে প্রথম এই বিদ্যালয়েরই এক ছাত্রী হলেন বিদ্যালয়েরই শিক্ষিকা। যা উন্মুক্ত করলো উচ্চশিক্ষার খিড়কি দুয়ার। আর তাকাতে হয়নি পেছনে। এবার শুধু সামনের দিকে পথচলা। তমলুকের মানুষ বুঝতে পারলেন বাড়ির মেয়েদের ঘরবন্দী করে রাখার দিন শেষ। আধুনিক মনস্কতা, বিজ্ঞানচেতনা আর উন্নত ভাবনার মিশেল ঘটিয়ে রক্ষণশীল তমলুকবাসীর হৃদয়ে পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন 'ভোরের পাখি'। তাঁর কলমের ডোগায় তখন বিষ্ফোরিত হয়েছিল কালির আঁচড়ে লেখা---
“ফুল হয়ে ফোট
সূর্যের সৌরভ আর শিশিরের স্বাদ
পেলব হৃদয় নিয়ে
ফুল হও,
গন্ধহারা শতাব্দীকে সুগন্ধ বিলাও”
যিনি তমলুকের বুকে থেকে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে নিঃশব্দে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। তিনিই সুচরিতা দাশ, তিনিই 'ভোরের পাখি'। যাঁর ডাকে ঘুম ভেঙেছিলো তমলুক তথা মেদিনীপুরের অসংখ্য অশিক্ষিত মহিলার। পুরুষশাসিত সমাজে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। তাঁর দেখানো পথে আজ জেলা তথা রাজ্যের মধ্যে নারী শিক্ষার নিরিখে রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী স্কুলের নাম জ্বলজ্বল করছে।
তখন তমলুকে শিক্ষিত মানুষজনের সংখ্যা কম ছিলো। দুর্বার স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান তমলুকে তখন অন্য চিত্র। শিক্ষার পরিবেশ তেমন ছিলনা। ফলে নারীশিক্ষা তো দূরঅস্ত। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের লোকজন অন্য চোখে দেখতে শুরু করে প্রধান শিক্ষিকাকে। কিন্তু নিজের আচরণ, দৃঢ়তা আর উন্মুক্তমনা কুসংস্কার বিরোধী সংস্কৃতিমনস্ক মানসিকতা দিয়ে জয় করলেন রক্ষণশীলতার বেড়া। হয়ে উঠলেন সবার আদরের 'রীতাদি'। সেসময়কার নিষ্প্রদীপ তমলুক তথা তাম্রলিপ্ত শহরে আজকের মতো ছিলনা। ড. উমা নাগের লেখা 'সামাজিক পটভূমিকায় তমলুকের স্ত্রী শিক্ষার গোড়ার কথা' বইতে সে বর্ণনা পাওয়া যায়।
আসলে প্রাথমিক শিক্ষাটুকু জুটলেও তখনকার দুর্ভাগা মেয়েদের কপালে জুটতোনা উচ্চশিক্ষার স্বাদ। শ্বাপদসঙ্কুল পথঘাট ঠেঙিয়ে সামাজিক রক্ষণশীলতা টপকে অন্দরমহলের মেয়েদের শিকে ছিঁড়তোনা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে পড়ার। এক ঝটকায় ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করলো সুচরিতার আগমনে। খড়গপুর হাইস্কুল থেকে প্রধান শিক্ষয়িত্রী রূপে যোগদান করলেন এখানে।
শিক্ষার অন্দরমহলে ঢুকে গিয়ে আর সংসারের অন্দরমহলে ঢোকা হয়ে ওঠেনি। বিয়েই করলেননা। আজীবন নারী প্রগতির সেবায় নিয়োজিত সুচরিতা দাশ ১৯৭৬ সালে পেলেন জাতীয় শিক্ষিকার সম্মান। তিনি মানতেন, পুঁথিগত বিদ্যাই একমাত্র নয়। মানসিক বিকাশে তা যথার্থ নয়। শিশুমনের সার্বিক বিকাশে চাই প্রাণের স্পন্দন। দুয়ার ছেড়ে আঙিনায় এসে দাঁড়ানোর রীতি চালু করা দরকার। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ ছেড়ে ঘোমটার আড়াল খুলে উপরে নীলাকাশ আর নিচে গাছপালা, মাটি, জলের প্রগাঢ় বেষ্টনীতেই দেওয়া যেতে পারে প্রকৃত শিক্ষা। নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটি এই মহানব্রতীকে নিয়ে প্রকাশ করেছিল স্মরণীয় গ্রন্থ 'ভোরের পাখি সুচরিতা দাশ'। সম্পাদনা করেছিলেন অশোক পাল।
তমলুকের রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা, ছাত্রীরা সহ এতদঞ্চলের সকল শিক্ষানুরাগী মানুষজন আজও স্মরণ করে তাঁদের আদরের রীতাদিকে। যিনি একসময় বলেছিলেন --
'ঊষার প্রথম স্নেহ, মৃত্তিকার সুধা নিয়ে
সরল সতেজ এক বৃক্ষ হও
ক্লান্ত এই শতাব্দীকে ছায়ার বিশ্রাম দাও
নদী হও।
তোমার জলের বেগে আবিলতা মুখে নিয়ে
করুণার নদী হয়ে বয়ে যাও,
কঠিন নিষ্ঠুর এই শতাব্দীর হৃদয় গলাও।
ফুল বৃক্ষ নদী হয়ে,
ক্ষুব্ধ এই শতাব্দীকে অমৃত যোগাও।"
0 Comments