সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব - ২
গৌতম বাড়ই
গভীর রাতে বসন্তসেনা একাকিনী তাদের বাড়ির ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। এখানে দাঁড়ালে রাতের পশ্চিম আকাশ স্পষ্ট দেখা যায়। যদিও এ আঁধারের আকাশে কিছু অস্পষ্ট তারা উঁকিঝুঁকি মারছে। সারাটা আকাশ ভরা ঝিকিমিকি তারার রাত আজ কিন্তু নয়। তবুও সেই আকাশে একটি তারা, হ্যাঁ একটিমাত্র তারা যে, তার মাঝে বেশি স্পষ্ট, বেশি উজ্জ্বল , খুব ঝিকমিক করছে।শহরের আলো রাতের আকাশের অন্ধকারের গভীরতা অনেকটাই কেড়ে নেয়। তবে নগরের সুরম্য অট্টালিকার রাতবাতিগুলো এখন প্রায় নিভে আসাতে কিছুটা অন্ধকারের জন্ম দিয়েছে রাতের শূন্য গহ্বরে।মনে পড়ে এইসব দিনে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতিকথা। মায়ের কোলের কাছে শুয়ে দেশ-বিদেশের অনেক অজানা গল্প শোনা। বসন্তসেনার বাবা বাংলাভাষা বা সাহিত্যের শিক্ষক হলেও, ইতিহাসের পথেই তাঁর অবাধ বিচরণ। সুশোভনবাবুর প্রিয় বিষয় ইতিহাস। তিনি প্রায়শই বলেন-" ইতিহাস না জানলে, নিজেকে ঠিকমতন চেনা যায় না,জানা যায় না, নিজের কৃষ্টি সাহিত্য সংস্কৃতির পূর্ব পরিচয় আমরা হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে ফেলি নিজেকে।"
🍂তিনি ইতিহাসের সুদূর অতলে খুঁজে পেয়েছিলেন, এক রহস্যময়ী ও বীরাঙ্গনা বাঙালি নারী চরিত্রের নাম। শুনিয়েছিলেন বসন্তসেনার অল্প বয়সেই , তার নাম সুসীমা। দ্বীপবংশ ও মহাবংশ নামক প্রাচীন বৌদ্ধ পুরাণ গ্রন্থে পালি ভাষায় যে কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে তা যদি ঐতিহাসিকভাবে সত্য হয়, তাহলে বলতে হয় যে এ ইতিহাস বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস। সেখানেই তিনি পেয়েছিলেন এই সুসীমার কথা। মেয়েকে একদিন বড় হয়ে উঠতেই শুনিয়ে ছিলেন ঠিক মেয়ের বয়সের মতন করে ইতিহাসে স্বল্প বর্ণিত সেই রাজকন্যা সুসীমার কথা। এই ধরণের এক স্বাধীনচেতা নারী ছিল সুশোভনের মনের অন্দরে এক প্রিয় রহস্যময়ী নারী চরিত্র। খুব একটা বেশি আলোড়ন বা হইচই নেই ইতিহাসে তাকে নিয়ে। পৌরাণিক যুগ আর ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষণে এই চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছিল। খুব একটা কিছু তথ্য জানা নেই সেজন্য। ঐ রকম একটা সময়ে তার সংক্ষেপিত উপস্থিতি ইতিহাসের ইতিবৃত্তে ঝলক দেখে , সুশোভনবাবুর কাছে এক ব্যাতিক্রমী নারী চরিত্র মনে হয়েছে, সুসীমার গল্পকথা তাকে এক নতুন ভাবনা দেয়, ভীষণ পছন্দ করে ফেলেন সুসীমা চরিত্রটিকে। বসন্তসেনা গালে হাত দিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে এই ইতিহাসের কথা শুনতে শুনতে তাই কোনও এক গভীরে হারিয়ে যেত। বসন্তসেনা সাহিত্য আর ইতিহাস মগজের খোপে- খোপে কোষে- কোষে ধারণ করলেও বিজ্ঞানের প্রতি তার ছিল অগাধ ঝোঁক। নিজে কৃতী ছাত্রী হয়ে আই.টি. এবং কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং - এর গ্র্যাজুয়েট, সাথে ম্যানেজমেন্টের মাষ্টার ডিগ্রী নিয়ে সেক্টর- ফাইভে এখন এক কর্পোরেট সংস্থায় বর্তমানে চাকরি করছে। একটু বড় হতেই তার মননে নানা রকম গভীর চিন্তার ঢেউ উঠতে থাকে।
কত রাত হবে? হয়ত দুটো বা তিনটে বাজে। ব্যালকনির একটি কোণে বসে রাতের আকাশে সবচেয়ে স্পষ্ট ঝিকিমিকি করা তারাটিকে খুঁজে বেরায় বসন্তসেনা। জানে, ঐ অসীমে কত সহস্র জন্ম মৃত্যুর রহস্য লুকিয়ে আছে। যে তারাটি খসে পড়ল চোখের দৃষ্টিতে এই অনন্ত রহস্যময় ব্রহ্মাণ্ডে , তার মৃত্যু হয়েছে শত- সহস্র বছর আগে। কে তুমি ঐ ব্রহ্মলোকের অধীশ্বর? নাকি মহর্ষি কপিলের সাংখ্যদর্শনের মতন তিনি আছেন কী নেই? এইভেবে লাভ কী? আমরা তাঁর অস্তিত্বে সন্দিহান হয়ে বা না হয়ে কী করব? জীবের প্রয়োজন তো মুক্তি। সে মুক্তি আসে সম্যকজ্ঞান, বিবেকসম্পন্ন হলে। যে চিন্তার বীজ তার বাবা তাকে মনের মধ্যে রোপণ করে দিয়েছেন, যে কৃষ্টি সংস্কৃতি মায়ের কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তে পাওয়া সেই জল হাওয়ার বড় হয়ে ওঠা তাকে এক অন্য দিগন্তে ভাসিয়ে নিয়ে চলে সবসময়। অন্ধকারের ঐ রাত আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল তারা যেন তার দিকে মুখ চেয়ে হাসছে। সারাগায়ে এখন হালকা শীতল হাওয়া এসে লাগছে। সারাদিনের দুঃসহ গরমের পর তার চোখ শীতল হাওয়ার আরামে জুড়িয়ে এল। বসন্তসেনা তার ঘরের ভেতরে গেল। এরকম সময়ে তার সদ্যমৃতা মা কাছে এসে দাঁড়ায় যেন তার। মায়ের অস্পষ্ট শীতল উপস্থিতি টের পায় সে। বাবা পাশের ঘরে আলো জ্বেলে এখনও কোনো বই পড়ে চলেছেন। তার ঘরের দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে আলো গলে পড়ছে বাইরে।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও জানে, চট করে তার ঘুম আসবে না। রাতের গভীরতায় মায়ের সান্নিধ্য আর অভাববোধ বসন্তসেনার মধ্যে জেগে ওঠে প্রায়ই। মায়ের আকস্মিক মৃত্যু তাকে অনেকটা সঙ্গীহীন করে দিয়েছে। চোখের পাতা ভিজে আসছে এই অভাববোধে, টের পায় সে। ঘরের ভেতর মা একাকিনী দাঁড়িয়ে, অচেতন বা চেতনের কোনস্তরে উপলব্ধি হয়, প্রশ্ন জড়ো হয় অনেক? সে পরে এর বিশ্লেষণ করতে পারে না। টের পায় দিনের থেকেও, রাত যে হাজার রহস্যে মোড়া , সেই সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই। বিজ্ঞান তাকে যেমন জ্ঞান দিয়েছে, তেমন দিয়েছে অপার অনন্ত এক জিজ্ঞাসা সবসময়ে। সে হারিয়ে যায় গভীর থেকে গভীরে।
মা যেন তাকে এবারে প্রশ্ন করছে- " কী দেখলি মা ঐ দূরের রাতের আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে? সবচেয়ে উজ্জ্বল ঝিকমিক করা তারাটিকে? হ্যাঁ, ঐ-টি আমি। আমিও তোকে মিটিমিটি উজ্জ্বল চোখে বারবার দেখছিলাম । তোর সঙ্গে আমার এক নাড়ির সম্পর্ক আছে, আছে প্রবাহিত রক্তধারা। যে বন্ধন কোনদিনও ছিঁড়ে যায় না। চির অটুট। এই গর্ভেই তোর জন্ম, শুধু তাই নয়, প্রতিটি গর্ভেই সেই সীমিত বাসভূমি এক বিস্ময় মানুষের। এই দেখ কেমন নেমে এসেছি । কিন্তু তোর বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর আমার কোনো অধিকার নেই, অভিলাষও নেই। হয়তো তোর বাবার আমার প্রতি স্মরণ আছে তবে তার যুক্তিবাদী বিশ্লেষণে আমার আর অস্তিত্ব নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে।এই দেখ হাসনু সোনা-মা, পৃথিবীর মাটিতে নেমে আবার তোর সেই মা হয়ে গিয়েছি। তাকা, চোখ তুলে চেয়ে দেখ আমায়। "
বসন্তসেনা ডুকরে কেঁদে ওঠে। মাকে মুখ তুলে বলে - " না , আমি তোমায় দেখব না। তুমি আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছো। কী দরকার ছিল অতো সাত- তাড়াতাড়ি যাওয়ার, আমাকে আর বাবাকে ফেলে?"
তার মা, এবারে কাছে এগিয়ে আসে। বলে একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে - " বোকা মেয়ে কোথাকার! এই পৃথিবী আমাদের সবার ক্ষণিকের বাসভূমি। মেয়াদ শুধু কারো অল্প, কেউ তারচেয়ে বেশি, কেউ বা তারচেয়ে আরও একটু বেশি। তবে চিরস্থায়ী নয় কেউ। সম্পর্ক, সে রক্তের বা রক্তের বাইরে বা আত্মার হলেও, এ এক ক্ষণস্থায়ী বাঁধন। তা ছিঁড়ে একদিন বেরিয়ে যায় সবাই। তোর ছোটকাকা, সে তো কবেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। দেখিস নি! তবে ঐ রাতের তারার মতন সবাই আমরা আছি তোদের কাছাকাছি। "
বসন্তসেনা এবারে উঠে বসে মাকে ধরতে যায়। আর তার মা দীপশিখা সেই অন্ধকারে অন্যান্য সময়ের মতন মিলিয়ে যায় রাতের গভীরে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে বসন্তসেনা। মাথায় হাতের স্পর্শে সজাগ হয় আবার। সুশোভন , তার বাবা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে- " মা রাত তো ভোর হয়ে এলো। এবারে ঘুমিয়ে পড়। নইলে শরীর খারাপ করবে, এই এতটা করে প্রতিদিন রাত জাগলে। জানি এ শূন্যতা পূরণ করবার নয়। তবুও আমাদের শূন্যতা বহন করেই চলতে হয়। ব্যাথা তো এখানেও বাজে হাসনু মা , অভ্যাস করে নিতে হবে আমাদের। যে চলে গেছে সে তো গেছেই---- "
বসন্তসেনা বাবার কথায় নিশ্চূপ হয়ে রইলো আর স্থিরতা এলো তার চঞ্চল মনে। বাবা তাকে রাত জাগতে না করছে ! আর তিনি তো বইয়ের গভীরে ঢুকে সব ভুলে যেতে ক্রমাগত রাত জেগে চলেছেন। একেই বলে সন্তান স্নেহ। বাবাকে তার সবসময় এক ব্যাতিক্রমী চরিত্র মনে হয়। সৎ এবং সাহসী। শারীরিক প্রদর্শনে নয়, কথায় নয়, তার কাজে-কর্মে, অনুভবে, চেতনার বোধে। না হলে কেউ মৃচ্ছকটিকের গণিকা, নায়িকা বসন্তসেনার নামে মেয়ের নাম রাখে? বাবার ভেতরে সবসময় এরকম উজ্জ্বল নারী চরিত্ররা গুরুত্ব পায়। বসন্তসেনা ছিলেন গানে, নৃত্যে, কবিতা, দরবারে আর সৌন্দর্যের ঔজ্জ্বল্যে মৃচ্ছকটিকের এক প্রোটাগনিস্ট। বসন্তসেনা জেনেছে যত আর তত উজ্জ্বল হয়েছে বাবার প্রতি।
আজকের রাতে তার সেই কল্প জাগরণ আর ঘটেনি। সুসীমা আজ রাতে আর তার কাছে সঙ্গীনি হয়ে আসেনি । সেই বহু দূরের ইতিহাস বছর হয়ে রয়ে গেল। ইতিহাসের বদলে স্বপ্নময় ঘোরে এক সদ্যহারিয়ে যাওয়া তার মা। সেই মায়াবী জগতে ভেসে চলবার পর, তারপর কখন সকাল হয়ে আসে সে টের পায় না এরপর।
ক্রমশ
ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন 👇
হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments