জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো/পর্ব ১৪ /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো 
পর্ব ১৪
চিত্রা ভট্টাচার্য্য 

ব্রাইস ক্যানিয়ন 

 বিস্মৃত প্রায় অতীত থেকে স্বপ্নের বিচিত্র খেয়ালী জগৎ কে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমানের  সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালাম। ঘুম ভাঙা চোখ মেলে চেয়ে দেখি ঘোলা জলের ন্যারোস --ভার্জিন নদীর ধারের সেই  প্রাচীন যুগের আদি আমেরিকান নাভাহো পুয়েবলাদের মাটির ঘর নয় আমার রাত পোহালো হ্যারিগ্র্যান্ড' পার নব নির্মিত সুসজ্জিত সিলভার ইনের দোতলার ঘরে। রাত শেষ হয়ে পূব আকাশ রাঙিয়ে পাহাড়ে ভোর হয়ে আসছে। গত রাতের উৎসবের হৈচৈ এখন থেমে গেলে ও এখোনো কানে আলোড়ন তুলছে মিষ্টি সুরে ইয়মের মাউথর্গানের বাজনা। বিভিন্ন  দেশের নানা গানের সঙ্গে বন্ধুদের কোরাস  ''তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি ''.। এক অপরিসীম খুশিতে কাল জায়ন ন্যাশানাল   পার্কে সারা দিন কাটিয়েছি  তারপর রাত ও কাটিয়েছিলামসম্পূর্ণ  বিদেশি পরিবেশে নবীন প্রবীণদের সম্মিলিত আড্ডায় যোগ দিয়ে গান বাজনার আনন্দ সভায়  নীরব দর্শক হয়ে। 

 আকাশ জুড়ে কুসুম রাঙা সূর্যদেব স্বমহীমায় সদ্য আত্মপ্রকাশ করেছে ,প্রতিদিনের মত প্রথম আলোয়   সূর্য প্রণাম সেরে স্প্রিঙডেলের পাহাড় কে স্বাগত জানাতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে বাইরের লনে এলাম।
চারদিকে সাজানো বাহারী  Dumb Cane  পাতার ওপর জমা শিশিরকণা মুক্তোর মত টলমল করছে।   সূর্যালোকের ছটায় সাদা মতির মত চমকিত সে বিন্দু যেন অভিমানিনীর চোখের রুদ্ধ আবেগে স্থির হয়ে থাকা নীরব অশ্রু বারি।আমার দেশের  নিত্য পরিচিত দৃশ্য মাঠে ঘাটে অযত্নে লালিত কঁচুর পাতায় জমে থাকা টলটলে শিশির বিন্দু সুদূর আমেরিকার রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের বুকে শিশির   স্নাত ভোরে সেই একই দৃশ্য। অফুরন্ত এক ভালোলাগা পরিপূর্ণ হলাম।     
        

 জায়নে ঢোকবার মুখে  স্প্রিংডেল এক ভারী সুন্দর ছোট্ট শহর। সেদিন গভীর রাতে অল্প কিছু হোটেল, রেস্তোরাঁ দেখেছিলাম ,গ্যাস ষ্টেশনের সাথে দুই একটা শপিংমল।
  এখন সকালের আলোয়  রক্তাভ খাড়া পাহাড়ের দৃঢ় চেতা অনমনীয় কঠিন রূপ দেখে মনে    হলো প্রকৃতি সেজেছে বীরাঙ্গনার সাজে। মন অকারণ খুশির স্রোতে ভেসে পাল তুলে দিল অজানার   উজানে। ভোরের বাতাসে মাতাল হয়ে যত সব ঘর ছাড়ার দল আমরা ও খেয়াল খুশির রথে চড়ে নতুন পথ চলার আয়োজনে মত্ত হয়ে উঠেছি। 
 
 নিজের পরিচিত খোলস থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে ঘুরতে গিয়ে আজ পর্যন্ত যত সহৃদয়   মানুষের সন্ধান পেয়েছি নির্দ্বিধায় বলতে পারি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে অনাত্মীয় পরদেশী মিষ্টার হ্যারি   এবং সিড ,দাদু ও নাতির এমন সম্পর্কের মেলবন্ধন অবিস্মরণীয়। ওরা শুধুই আমাদের বন্ধু নয় যেন আত্মার আত্মীয়।সকালে তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্টের পর যখন বিদায়ী নিতে গিয়েছি দেখি বাস্কেট ভরে; হটপটে লাঞ্চের প্যাকেট সাজিয়ে গ্র্যান্ডপা গাড়িতে যত্ন করে খাবার তুলে দিচ্ছেন। বলেন বেশ অনেক দিন ধরে পথেই ঘুরছো ইন্ডিয়ান রান্না ডিশ খাওয়া হয়নি তো?  দেখো কেমন টুনা মাছের ঝাল ,চিকেন কষা ,পোলাউ এর সাথে পনির কোপ্তাকারী বানিয়ে দিয়েছি।  হে প্রিয়,কন্যে! তুমি  অবশ্যই টেস্ট করে এই বুড়োর  হাতের রান্নার তারিফ করবে। ''  বলেই বিখ্যাত  সেই  ভুবন ভোলানো   হা -হা - হাসি।   ভাবছি ম্যাজিক নাকি ? কখোন এতো সব রান্নার আয়োজন হলো ? 

  এই স্নেহ প্রবণ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ লোকটির আন্তরিকতায় আমার চোখ দুটো কালো চশমার আড়ালে ভিজে উঠলো আজকাল যেখানে পারিবারিক সম্পর্ক গুলো একেবারে নিঃশেষিত হয়ে তলানীতে গিয়ে    ঠেকেছে। সেই স্বার্থপরের দুনিয়ায় এমন মহৎ হৃদয়ের মানুষ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে   দুই একজন এমন গ্র্যান্ড পা ও তাঁর নাতিরা আছে বলেই পৃথিবীটা এমন মায়াময় অপরূপ। বললাম আগামী সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ায় লস্গাটসের বাড়িতে দেখা হবে। ব্রতীন অতনুরা ওদের আদরের গ্র্যান্ডপা আর  সিড কে জড়িয়ে ধরে বলে তখন সহজে ছুটি নেই। 
  মিষ্টার হ্যারি বললেন yes all right ,,, I will be there .. তাকিয়ে দেখি গ্র্যান্ডপা শুধুই লাঞ্চের ব্যবস্থা নয় ,কিছু স্নাক্স ও কুকিজের সাথে  মিনারেল ওয়াটারের বটল , কোল্ড ড্রিঙ্ক ফ্রুট জুস্  সব ঠিক মত দেওয়া  
 হয়েছে কি না ? তদারকি করে দেখে তবে রেহাই দিলেন। বললেন এই যে '' কন্যে তুমি  সহ  চারটে হার্মাদ
 কে একটু কাছে পেলাম তাতেই আমার ভুবন আলোয় মাতলো। ''ভারাক্রান্ত মনে আমরা বেরিয়ে এলাম। আবার আমাদের চরৈবেতির পালা শুরু হলো।      
 
    চলেছি ব্রাইস ক্যানিয়নে। রোড ম্যাপে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি জায়গা জায়নের আশেপাশেই    রয়েছে।  যা কাল দেখা হয় নি। জায়ন থেকে ৮০ মাইল দূরে উত্তর পূর্বের ব্রাইস ক্যানিয়ন। ইউটা মোয়াবের উত্তর পশ্চিমে  সিডার সিটির টুকূপিট পয়েন্ট এবং বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘ্যতম প্রাকৃতিক খিলান গুলোর মধ্যে যেখানে একটি অতীব সুন্দর কোলোব আর্চ আছে। তাই জায়ন পার্ক কোলোব আর্চ নামেও পরিচিত। এবং কাছেই আছে বিখ্যাত গ্র্যান্ড স্টেয়ার কেস এস্কাল্যান্ট ন্যাশানাল মনুমেন্ট, ও  গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশানাল পার্ক। জায়নের চেয়ে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে কলোরাডোর প্লেটোর থেকে এই পশ্চিম প্রান্তে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে ব্রাইস ক্যানিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর শিলা স্তরের একটা বিশাল অংশ ক্ষয় কার্য উর্দ্ধ চাপ এবং রূপান্তরের ফলে যে বহুবর্ণের পাহাড় এবং উপত্যকা র সৃষ্টি হয়েছে তাই গ্র্যান্ড স্টেয়ার কেস। ব্রাইস ক্যানিয়ন থেকে জায়ন হয়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে। আমাদের  সব দেখার সময় হবে না , কিন্তু ব্রাইস ন্যাশানাল পার্ক দেখবই।       
হুডুজ

এমন যদি হতো গতকাল জায়ন পার্কেই পাহাড়ের ওপর  খোলা প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে চার ধারে আগুন জ্বালিয়ে মুক্ত নির্মল মখমলি আকাশের বুকে ঝিলিমিলি তারাদের মিছিল দেখে  রাত কাটিয়ে দিতাম। তাহলে আবার নতুন করে এপথে আসতে হতোনা। কিন্তু  হ্যারি গ্র্যান্ডপার নিউ সিলভার ইন  উদ্ভোধনের আমন্ত্রণে এসেছি তার গুরুত্ব সর্বাধিক। আমাদের স্প্রিংডেলে  ফিরতেই হতো।  গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগিয়ে চলতেই দেখি ওপর থেকে উদার নীল আকাশ অপার বিস্ময়ে লাল পাহাড়ের দেশ টির দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে।

  অনুপম এই লালের সৌন্দর্য যা কয়েকদিন ধরে ইউটা আরিজোনা মোয়াবের এই অঞ্চল গুলোতে ঘুরে বারে বারে দেখছি তবু মনে হয় যেন এই বুঝি প্রথম দেখলাম।  কিছুটা পথ এগোতেই এতো রং বেরঙের পাহাড় একদিকে তাকিয়ে দেখতে গেলে আরেক দিক দেখা হয় না। গতকাল জায়ন থেকে বেরোনোর মুখে দিনের বেলায় ও এক ঘুটঘুটে অন্ধকার ট্যানেল পার হয়েছিলাম। পাহাড়ের পেটের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে বানানো এ  রাস্তা।  এমন  লম্বা সুড়ঙ্গ পথ গুলো পার হওয়ার সময় দেখেছি কোথাও এক ফোঁটা আলো থাকে না ,গাড়ির হেড লাইটের আলো পথ দেখায়। আজ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথেই এগিয়ে চলেছি পার্কের বাইরের রাস্তা ধরে।    

অতনু ওর সাবেকী কায়দায় হাতের মুঠো টাকে চোঙের মত করে বলে ওঠে বন্ধু গন মন দিয়ে  শোনো ,আমার চলেছি জায়ন থেকে ৮০ মাইল দূরে র ব্রাইস ক্যানিয়নে। জায়নের চেয়ে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে এই ব্রাইস ক্যানিয়ন ,এবার যথাক্রমে  আসবে গ্র্যান্ড স্টেয়ার কেস। ব্রাইস ক্যানিয়ন থেকে জায়ন হয়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন ধাপে ধাপে নেমে যাবে। সিনিক রাস্তা ধরে এগোলে প্রাকৃতিক  সৌন্দর্যে ভরপুর রুট-৬৬, রেড ক্যানিয়ন, ডিক্সি ন্যাশনাল ফরেস্ট, ব্রাইস ক্যানিয়ন, ক্যাপিটাল রিফ, গ্র্যান্ড স্টাইল কেস এসকালান্তে ক্রমশ দেখতে পাবো । তোমরা ধৈর্য্য ধরে পথের দিকে তাকিয়ে  থাকো।একে একে এই পৃথিবীর কত রহস্যের দ্বার  তোমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।  ইয়াম বলে কেউ ডিস্টার্ব করোনা অতনু এখন রীতিমত পাক্কা গাইড সাহেব আলভারোর ভূমিকায় আমাদের পথের দিশারী ।  

আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম গতকালের দেখা ন্যারোস ভার্জিন নদীর অত্যাশ্চর্য্য ক্ষমতা। সাগরে মিলিত হবার জন্য এই নদী গুলো খরস্রোতা হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে পাহাড় কে উথাল পাথাল স্রোতে ধাক্কা মেরে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। ফলত ধীরে ধীরে এই গিরিখাত গুলোর উৎপত্তি হয়। ভার্জিন নদীর উত্তর শাখায় ও হাজার হাজার ফুট পাথরের স্তর কে ক্ষয় করে এমনি গভীর গিরিখাতের সৃষ্টি করে চলেছে। ভাঙা ও  গড়ার কাজে অবিরাম ব্যস্ত এই মরুর অঞ্চল। কলোরাডোর প্লেটোর থেকে পশ্চিম প্রান্তে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে ব্রাইস ক্যানিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর শিলাস্তরের একটা বিশাল অংশ ক্ষয় কার্যের সাথে উর্দ্ধ চাপ এবং রূপান্তরের ফলে বহু বর্ণের কত পাহাড় এবং উপত্যকার সৃষ্টি করে চলেছে। প্রকৃতির কারিকুরি খেলায়  দিনেরাতে কখোনো তার বিরাম নেই.।   

হ্যারি সাহেব গতকাল ব্রাইসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিল,  ব্রাইস ক্যানিয়ন এই  জাতীয় উদ্যান টি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ক্যানিয়ন নাম হলেও অথচ কোনো গিরিখাত নেই। ১৮০০ এর দশকে ইউরোপীয় আমেরিকানরা আসার আগে স্থানীয় আমেরিকানরা হাজার হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে শিকার করে বেড়াতো। ১৮৭৫সালে এবেঞ্জার ব্রাইস নামে একজন মরমন জাতি আদিবাসী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেন ও  রাস্তা  তৈরী করে একটি পাথুরে প্রদর্শনীর কাছে শেষ করেছিলেন। সেই ব্রাইস সাহেবের  নামানুসারে এই স্থান টি ব্রাইস ক্যানিয়ন নামে পরিচিত হয়েছিলো। ১৯০০সালে শুরুতে পর্যটকরা এখানে পাথরের গঠন দেখতে আসে।এবং ১৯২৩সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন জি হার্ডি ব্রাইস ক্যানিয়ন কে একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসাবে ঘোষণা করেন।অবশেষে   ১৯২৮সালে পার্ক টিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত করা হয় ।
🍂

   জায়ন থেকে পঞ্চাশ মাইল মত যাওয়ার পর ব্রাইস ক্যানিয়নে  ঢোকার মুখে দুটো বড়ো রেড আর্চ থাকায় এই জায়গাটির নাম হয়েছে রেড ক্যানিয়ন। যদিও এই স্থান টি  কোনো ন্যাশানাল পার্কের আওতায় পরে না। আমার মনে হলো  ভারতবর্ষে কেল্লায় সমৃদ্ধ রাজস্থানের বিশাল তোরণ দ্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি । অতনু ও ব্রতীন বলে বাঁকুড়ার টেরাকোটার মন্দির গুলোর সাথে ও সাদৃশ্য  থাকলেও  সে টেরাকোটার কাজ মানুষের হাতে সূক্ষ্ণ শিল্প সম্ভারে গড়ে উঠেছিল। আর এই নিপুন কারুকার্য্য-- রক্তিম প্রাসাদ খিলান দেউলটির  নির্মাতা  প্রকৃতিদেবী স্বয়ং। যেন  এই তোরণ দ্বার গুলো পার হলেই আসল রাজ প্রাসাদের আঙিনায় পৌঁছবো। উন্মত্ত নদীর বিধ্বংসী লীলায় সৃষ্টি অসংখ্য লাল রঙের পাথরের নানা কারুকার্য্য দেখেই চলেছি  একটু ও  ক্লান্ত লাগছে  না। এতো পাথরের স্ট্যাচু ঘুরে বেড়িয়ে সব দেখা সম্ভব নয়। কিছুটা সময় এই রেডপার্কে বেড়িয়ে  চলেছি আরো প্রায় ত্রিশ মাইল দূরের ব্রাইস ক্যানিয়নে ।পথের বিস্তর চড়াই উৎরাই পার হয়ে আরো কিছুটা গড়িয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ালো ব্রাইস ক্যানিয়নে। পার্কিং লটে গাড়ি রেখে এবার এগিয়ে চলেছি ভিজিটর সেন্টারের দিকে। প্রবল   ঠান্ডা হাওয়ার গতির  তীব্র দংশন মনে হচ্ছে  ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে কোথায় কত দূরে?   
আরও পড়ুন 

 চলতে চলতে তাকিয়ে দেখি পাইন এবং জুনিপার গাছ পার্কের নীচের অংশ জুড়ে ঘিরে রয়েছে।            আমরা সানরাইজ পয়েন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি তবু হাঁটতে থাকলে ঠান্ডা অতো কাবু করে না।  ৩৬ হাজার একর জায়গা জুড়ে এই পুরো পার্কটি তে পাথরের সারি লালচে গোলাপী বাদামী বিচিত্র    রঙের পাহাড়ি স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন। অতনু বলে ব্রাইসের রিম 8,000 থেকে 9,000 ফুট (2,400 থেকে 2,700 মিটার) পর্যন্ত উঁচু।  পৌনসাগুন্ট মালভূমির পূর্ব প্রান্তে প্রকৃতির নিপুন হাতের দক্ষতায় তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশাল প্রাকৃতিক  Amphitheater গুলো যেন একটি সংগ্রহ শালার নিদর্শন। আমার মনে হলো রোমের কলোসিয়ামের মত।    এই এম্পিথিয়েটার গুলো খুব খাড়া দেওয়াল সহ পাথরের গোলাকার উপত্যকা।  হিম শীতল আবহাওয়া এবং নদী ও হ্রদের সর্ব নিম্ন তলদেশের পাললিক শিলাগুলোর স্রোতের ক্ষয়ের ফলে গঠিত হুডুজ নামক সারি সারি লাল পাথরের স্তম্ভ গুলো দেখে  বিস্ময়ে অভিভূত হলাম।   
অপরূপা ব্রাইস ক্যানিয়ন।

এখানে যে হুডুজ দের দেখলাম,তারা পাথরের স্তম্ভ হলে কী হবে যেন একেবারে মানব দেহধারী 
পুতুলের মত ।  Navajo বা Paiute Indian  শ্রেণীর আদি আমেরিকান দের বিশ্বাস ও  লোককথা  অনুযায়ী , হুডুজ আসলে পাপিষ্ঠ মানুষ। ঈশ্বরের অভিশাপে ওরা প্রাণ হীন পাথরের রূপে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। জনগণ মনে করে ব্রাইস ক্যানিয়নের দ্বাররক্ষি বা পাহারাদার ও এখন ওরাই।  ইয়াম বলে লাল পোশাকে সজ্জিত সৈন্য সামন্তের দল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধের দামামা বাজলেই বা  ওপর মহলের সংকেত  পেলেই যুদ্ধ শুরু করবে। এমন লাল পাথরের জঙ্গলে ব্রাইস ক্যানিয়ন বিখ্যাত ও স্বতন্ত্ৰ রূপ পেয়েছে । এই স্তম্ভগুলির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮ হাজার ফুট উঁচুতে। হুডুজের চার পাশ দিয়ে চলেছে নাভাহো লুপের হাইকিং পথ। ঐ পথের ট্রেল  ধরে হাইকারের দল হেঁটে চলেছে। কিছুটা দূরে দেখি এখনো ট্রেলের ওপর বরফের পুরু আস্তরণ জমে আছে।  অনেক ক্ষণ ধরে চুপ করে থেকে একাকী পাথরের স্তরে পর্যবেক্ষণে মন দিয়েছিল পারভীন। এবার সে স্বগতোক্তি করে বলে কী অদ্ভুত ! আমরা প্রথমে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখেছি। তারপর জায়ন দেখলাম এখন ব্রাইস দেখছি। 

ভূতাত্ত্বিক দের মতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একেবারে সম্পূর্ণ নীচের শিলাস্তর গুলো প্রায় দেড়শ কোটি বছরের ও পুরোনো আর সবচেয়ে ওপরের স্তর গুলো ১৮ কোটি বছরের পুরোনো বলে চিহ্নিত করা হয় । ব্রতীন বলে গতকাল আলভারো সাহেব বলেছিলেন,এই শিলাস্তরের বয়স কে age of reptiles হিসেবে ধরা হয় সেই তুলনায় অনুমান করা হয় ব্রাইসের বয়স অনেক কম ছয় কোটি বছর। এই যুগ কে স্তন্যপায়ীর যুগ বা  age of  Mammals বলে।  আলভারো সাহেব বলেছিলেন ব্রাইসে এখোনো প্রাকৃতিক নিয়মে রীতিমত ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। কোথাও সে ক্ষয় প্রাপ্ত হলে কোথাও আবার নতুন ভাবে গড়ে উঠছে। 
    ব্রাইসের পথে। ট্যাকোমা পিক আপ ট্রাক।

রাস্তার দুই দিকে অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । সময় এখানে স্থির নিশ্চল যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই এসে দাঁড়িয়ে আছি। পাথুরে এই স্ট্যাচু গুলো বেশীর ভাগই চুনা পাথর আর বেলে পাথর দিয়ে তৈরী। কত  যে স্থাপত্য প্রকৃতি এখানেও বানিয়ে রেখেছে তার হিসেব নেই। পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে চাই  কিন্তু সে তো মোটেই সম্ভব নয়. গাড়ি তাই খুব ধীর গতিতে চলছে। চলার পথে চোখে পড়লো গ্র্যান্ড স্টেয়ার কেসে এসকালান্তে। প্রকৃতির স্বনির্মিত পাথুরে সিঁড়ি কোথাও ঘাসের সবুজ তো কোথাও চুনা পাথরের সাদা কোথাও ধূসর বা ছাই রাঙা পাথর, কোথাও বা বেলে পাথরের লাল।  সে অনেক যত্নে রঙের পর কত রঙ মিশিয়ে নীরব তুলিতে ছবি এঁকে চলেছে। অপরূপ সৌন্দর্য কে দুচোখ ভরে উপভোগ করার জন্য ব্যস্ত সব ভ্রমণার্থীরাই। দিগন্ত বিস্তৃত নয়নাভিরাম সৃষ্টি শীলতাকে স্মৃতি তে জীবন্ত রাখতে ক্যামেরায় ছবি তুলে চলেছি। ব্রাইসের দূরের পাহাড়ের স্তর গুলো তখন তুষারাবৃত হয়ে এক অনন্য সাধারণ রূপ নিয়ে সাদা লাল গোলাপীর সাথে ধূসর ম্রু মিশে  নীরবে দাঁড়িয়ে আছে আগামীর    প্রতীক্ষায়।  
 দ্বিপ্রহরের সূর্য দেব মধ্য গগনে। এখন লাঞ্চ টাইম ,  পর্বত শ্রেণীর এই সুউচ্চ দন্ডায়মান পৃথীবীর অধীশ্বর রক্তিম মহারাজ কে সশ্রদ্ধ নত মস্তকে প্রণাম জানিয়ে তারই আঁকাবাঁকা পথ ধরে আসতে আসতে নেমে চলেছি নীচের দিকে। পথে কোনো এক বসার জায়গা নিরিবিলি গাছের ছায়া খুঁজে নিয়ে হ্যারি গ্র্যান্ডপা 'র দেওয়া লাঞ্চবক্স খুলে সানন্দে ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাবো। তারপর এগিয়ে যাবো স্প্রিংডেল রকভিল হ্যারিকেন হয়ে সেন্ট জর্জের দিকে। আগামী  গন্তব্য স্থল শুনেছি হুভার ড্যাম হয়ে লাসভেগাসের দিকে  । সে গল্প বলবো আমি ---কালকে আবার।                                                                                                 ক্রমশঃ
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments