মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬৯
অচিন্ত মারিক (সম্পাদক, প্রকাশক, গবেষক, প্রবন্ধকার, মেদিনীপুর শহর)
ভাস্করব্রত পতি
"আসলে আমরা সমস্ত পক্ষীপ্রেমীদের সমষ্টিকেই বিচারক সাজিয়েছিলাম। বিচারকরা কেউ আমাদের শাস্তি দেননি। দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় সকলে আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে এখন প্রায়শ্চিত্ত করছি। বিচারক ক্ষমা করলেও চড়াইকূল আমাদের ক্ষমা করেনি। তারা আমাদের সংসর্গ ত্যাগ করেছে। আমরাই তাদের কাছে ত্যাজ্য"--
এভাবেই স্বীকার করে নিয়েছেন নিজেদের দুর্বলতা। নিজেদের অপরিনামদর্শিতার দরুন পরিবেশ থেকে দুর্মূল্য হয়ে যাওয়ার পথে ছোট্ট চড়াইয়ের কাছে নতযানু হয়ে সজল নেত্রে তিনি উপহার দিতে পারেন তাঁর পত্রিকার বিশেষ 'চড়াই' সংখ্যা। ছোট্ট চড়াই কোনও দিনই জানতে পারবেনা আপামর মনুষ্য সমাজের পিঠে বেত্রাঘাত দেওয়া এবং 'চোখে আঙুল দাদা' গোছের এই সুপাঠ্য পত্রিকাটির প্রকাশনার কথা। কিন্তু তথাকথিত 'ভ্যাগাবণ্ড' মানুষজন হয়তো আত্মোপলব্ধির সুযোগ পাবে এটা পড়ে যে -- তাঁদের অশুভ অঙ্গুলিহেলনে বিপন্ন হয়েছে চড়াই।
এই চড়াই সংখ্যা পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন মেদিনীপুরের অচিন্ত মারিক। একাধারে প্রকাশক, গবেষক, প্রবন্ধকার। অন্যদিকে তিনি পত্রিকা সম্পাদক। ১৯৬২ সালে ব্রজকিশোর মারিক প্রকাশ করতেন 'অমিত্রাক্ষর' নামে একটি সাময়িকী। পরবর্তীতে অচিন্ত মারিক নিজের হাতে তুলে নেন পত্রিকার অবয়বের দেখাশোনা। সেই পেলব দেহের প্রতিটি পাঁজরে সাহিত্যরসিকদের জন্য প্রোথিত করেছেন অনাবিল আনন্দের রক্ত মাংস এবং মজ্জা।
২০১২ থেকে নবপর্যায়ে প্রকাশ শুরু করেন অমিত্রাক্ষরের। প্রথম থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে থাকে তা। কলকাতা থেকে অনেক দূরে মেদিনীপুর শহরে বসে অত্যন্ত উচ্চমানের পত্রিকা প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। সেইসাথে এই পত্রিকার মাধ্যমে কলকাতার বোদ্ধা সমাজের সমীহ আদায় করে নেওয়াটাও প্রমাণ করে পত্রিকার উন্নত গুণগত মান সম্পর্কে। অমিত্রাক্ষর পত্রিকার বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা।
একসময় কলকাতার ইন্ডিয়ান কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ড্রাফ্টসম্যানশিপের ফাইন আর্টস ডিগ্রি কোর্সের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক দৈন্যতার দরুন তা শেষ করতে পারেননি। কিন্তু সেসময় মেদিনীপুর ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত বহু শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। একসময় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ যোগেন চৌধুরীদের মতো স্বনামধন্য মানুষদের। তাঁর এই আঁকাঝোঁকার প্রতি দুর্বলতা অবশ্য অনেক ছোট থেকেই ছিল। সপ্তম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থাতেই মেদিনীপুরের আকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে আঁকা শেখা শুরু করেন। সেই অচিন্ত মারিক মেদিনীপুর শহরের বুকে বসে একটার পর একটা মহা মূল্যবান প্রকাশনার শরিক হয়ে গর্বিত করে তুলছেন মেদিনীপুরকে। হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।
১৯৫৮ সালের ৬ ই ডিসেম্বর মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত ব্রজকিশোর মারিক এবং মা ছিলেন প্রয়াত সুরধনী মারিক। তিনি ১৯৭৪ সালে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৩ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় কেরানি হিসাবে কাজ করেছিলেন। ২০০৬ সালে, তিনি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পৌর এলাকার অধীন দরিদ্রতম লোকজনদের স্যানিটেশন এবং জীবিকা নির্বাহের জরিপের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। এখন তিনি পুরো দস্তুর প্রকাশক।
পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে ঘরের চড়ুই হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার সিদ্ধান্ত নেন ২০১২ তে। সেই মোতাবেক তিনি অমিত্রাক্ষর পত্রিকার "চড়াই" (দ্য স্প্যারো) সংখ্যা সম্পাদনা করেন। এই বিশেষ সংখ্যাটির সম্পাদনা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে। অসাধারণ একটি সংখ্যা পেয়েছে পাঠক সমাজ। এতে তুলে ধরা হয়েছে পরিবেশ থেকে ঘরের চড়ুই হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ। তাছাড়া চড়াইয়ের সাতসতেরো উল্লেখ করা হয়েছে নানা ভাবে। শুধু তাই নয়, চড়াই সংখ্যা প্রকাশের (২ রা মার্চ) পর তিনি ২০ শে মার্চ ২০১২ তে, এলাকায় 'বিশ্ব চড়ুই দিবস' পালনের ব্যবস্থা করেন এবং বিশ্বব্যাপী চড়ুইয়ের একটি সচিত্র অ্যালবাম প্রকাশ করেন। এটি বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়ে ওঠে পরিবেশপ্রেমী জনসাধারণের কাছে। খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই 'অমিত্রাক্ষর' পত্রিকার চড়াই সংখ্যা দেখে এবং পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, "রচনাগুণে এই পত্রিকাটি বিশেষ সমৃদ্ধ তো বটেই, তা ছাড়াও আমি মুগ্ধ হয়েছি এই সংখ্যাটির নির্মাণকুশলতা দেখে। অনেক রকমের ছবি, প্রতিটি পৃষ্ঠার লে আউটও অনবদ্য। শহরের অনেক বড় পত্রিকাকেও অঙ্গসজ্জায় হার মানিয়ে দেবে। অমিত্রাক্ষর পত্রিকা ও তার সম্পাদককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই"।
মেদিনীপুর শহরের পদ্মাবতী শ্মশান ঘাটে "শ্মশান" নিয়ে একটি বক্তৃতা সেমিনারের আয়োজন করেন ২০১২ এর ১৫ ই অক্টোবর। এই সেমিনারের লক্ষ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মৃতদেহ দাহের সময় প্রচলিত কাঠ পোড়ানোর পরিবর্তে বৈদ্যুতিক শ্মশানের সুবিধা গ্রহণের জন্য মানুষকে আকৃষ্ট করা। এভাবেই অভিনব উপায়ে বন সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য অচিন্ত্য মারিক যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এদিনই অমিত্রাক্ষর পত্রিকার বিশেষ 'শ্মশান' সংখ্যাটি প্রকাশ করেন মেদিনীপুরের পদ্মাবতী জ্বলন্ত ঘাটের সবচেয়ে বয়স্ক 'চন্ডাল' তথা শ্মশানবন্ধু। এটি ছিল বই প্রকাশের ইতিহাসে একটি বিরল উপলক্ষ। শ্মশান ও তার সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে অচিন্ত মারিকের মনোভাব স্পষ্ট তাঁর ভাবনায় - "মৃত্যু ও শ্মশান সমার্থক নয়, শ্মশান জীবনের অঙ্গ। দেহজীবনের শেষ অনুষ্ঠান ভূমি শ্মশান। তাই ভীতি, ছুঁতমার্গ না থাকাই শ্রেয়"। তিনি শুধু সাহিত্যসেবা করেননি, এর সাথে পরিবেশ রক্ষা এবং আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা মানুষজনকেও সম্মান দিতে চেয়েছেন আন্তরিকভাবে।
অচিন্ত মারিক যেসব বই লিখেছেন সেগুলি হল - ভাষাবিতান (Esseys on Language - 2008); Temple's of Paschim Medinipur (Heritage - 2009); বাল্মীকির ধ্যানমঞ্চে ঊর্বশী (One Act Play 2012); SMS - Made for each other (New generation messages - 2013); পোস্টকার্ড : নির্বিকার মরুপথযাত্রী (Postcard a Journey to Desert - 2014); হে সৌম্য বিষাদ - (Last days of Rabindranath Tagore, 2015); ইতর ভাষা (On Slang and LGBT - 2016); পর্দা পরিকথা (Carten around the World, 2016) ইত্যাদি।
তবে তাঁর মূল পরিচিতি লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে। তাঁর সম্পাদিত 'অমিত্রাক্ষর' পত্রিকার আরও কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা যেমন ছদ্মবেশ, আড্ডা, পোষ্টকার্ড, বিতশোক ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা, যাত্রাপালা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ - মেদিনীপুর ইত্যাদি এই সময়ের অনেক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। অনেক সমালোচক তাঁকে চড়ুই, শ্মশান, পোস্টকার্ড, পর্দা, আড্ডা ইত্যাদির মতো অসাধারণ বিষয়গুলিতে নতুন ধরনের সাহিত্যকর্মের জন্য আজও কৃতিত্ব দেন। কলকাতা থেকে ১৩০ কিমি দূরে থেকেও যে কি উচ্চমানের কাজ করা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন প্রাঞ্জলভাবে।
সম্প্রতি, সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজেস, ডিপার্টমেন্ট অফ হায়ার এডুকেশন, ভারত সরকার থেকে তাঁর গবেষণা কাজ "POSTCARD : A JOURNEY TO DESERT" কে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেইসাথে বইটি প্রকাশের জন্য আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছে। তাঁর কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তবে সেগুলি অবশ্যই তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। ২০১৩ তে তিনি পেয়েছেন কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার। ৪ ঠা নভেম্বর ২০১৭ তে তিনি কলকাতার রবীন্দ্র সদনে ও সি এল দ্বারা তাঁর অসামান্য শিল্প ধারণার জন্য সংবর্ধিত হন। এছাড়াও ২০১৭ তে পেয়েছেন বাজে মুরাজা মুরলি সম্মাননা, ২০১৮ তে সৃজন সম্মাননা ইত্যাদি। তিনি মেদিনীপুরে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং সেভ ডেমোক্রেসি পশ্চিমবঙ্গের সক্রিয় সদস্য। তিনি প্যারিসের আন্তর্জাতিক আর্কাইভস কাউন্সিলের সদস্য এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ - মেদিনীপুর শাখার আজীবন সদস্য।
মুখময় সাদা চুলের সমারোহ। মাথাতেও তাই। চেহারার ভারিক্কি অবশ্য আত্মিক বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়না তাঁর। নিজের স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের জেলার লেখকদের চূড়ান্ত গুরুত্ব দিয়ে লিখিয়ে নিতে পেরেছেন প্রতিটি সংখ্যার তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধ। কোনও ভাবেই এই কাজে কলকাতার লেখকদের সুযোগ দেননি তিনি। তাঁর মতে, মেদিনীপুর জেলার মানুষের দক্ষতা কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই। সেটা আগেও ছিলনা, এখনও নেই। ভবিষ্যতেও থাকবেনা। আর এভাবেই আরও একবার মেদিনীপুরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যুক্তিতে তিনি অবিচল কলমধরা সৈনিক।
0 Comments