বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিষ্ঠাবান, গবেষণাধর্মী ও ঐতিহাসিক ভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা তথা ভারতের একজন অগ্রগণ্য প্রাবন্ধিক।১৮৯১সালে ২১শে সেপ্টেম্বর বর্তমান হুগলির বালিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা উমেশচন্দ্র দরিদ্র ছিলেন। তাই সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। অভাব কখনোই পিছু ছাড়েনি। কাজের খোঁজে কলকাতায় চলে যান। বিভিন্ন অফিসে ১৮৮৮ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত পর্যন্ত বিভিন্ন অফিসে টাইপিস্ট পোস্ট ও স্টেনোগ্রাফারের কাজ করেন। উনিশ শতকের নব জাগ্রত বাঙালির ধর্ম কর্মশীল , সদাচার, আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি সাহিত্য , সংস্কৃতি সমাজ তাঁর প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।১৯৫২ সালে ৩ রা অক্টোবর মৃত্যুর আগের দিন অবধি রোগ শয্যায় থাকাকালীন বাংলা সাময়িক পত্র সংশোধন ও সংযোজন করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন প্রবন্ধ গুলি দেশ, মাসিক বসুমতি, সাহিত্য - পরিষদ, ভারতী, ভারতবর্ষ যমুনা, প্রবাসী, শাশ্বতী ,নব্যভারত , আর্যাবর্ত, জাহ্নবী প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় অনাড়ম্বর ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
সাহিত্যিক রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু প্রবন্ধ আজও প্রকাশিত হয়নি । যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,সেসব হলো:-"মোগল যুগে স্ত্রী শিক্ষা" ১৯৩১ , "বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ" ১৯৩১, "সংবাদপত্রে সেকালের কথা" প্রথম খন্ড ১৯৩২, দ্বিতীয় খন্ড ১৯৩৩, তৃতীয় খন্ড ১৯৩৫,"বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস" ১৯৩৩ , "বাংলা সাময়িক পত্র" প্রথম খন্ড ১৯৪০, দ্বিতীয় খন্ড ১৯৫২, "সাহিত্যসাধক চরিতমালা" প্রথম থেকে দশম খন্ড ১৯৪০-৫২,"শরৎ পরিচয়" ১৯৫১, "বঙ্গ সাহিত্যে নারী" ১৯৫১।এ ছাড়াও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকটি ইংরেজি গ্রন্থসহ রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ তেত্রিশটি। ২৫ টি কাব্যগ্রন্থ সজনীকান্ত দাসের সাথে যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত, উদাহরণস্বরূপ-
"দিল্লীশ্বর" ১৯২৩ , "বেগম সমরু", "কেল্লাফতে" "মোগল-বিদূষী", "অক্ষয় কুমার দত্ত", "বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ* "রাজা বাদশা", "রণ ডঙ্কা", " নূরজাহান" , " জহান- আরা"ইত্যাদি
সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি গ্রন্থ গুলি হল:-
"Begams of Bengal,1915, "Rajah Rammohun Roy's Mission to England",1826, "Dawn of New India" 1927 ।
প্রাবন্ধিক রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সুলভ ধৈর্য, নিষ্ঠা ও শ্রমশীতার জন্য মাসিক "প্রবাসী" ও "মর্ডান রিভিউ" পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। 'সংবাদপত্রে সেকালের কথা' গ্রন্থে ১৮১৮ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত "বঙ্গদূত", "সমাচার চন্দ্রিকা" ও "সমাচার দর্পণ" পত্রিকায় প্রকাশিত বাঙালি জীবনের ধর্ম , শিক্ষা ও সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে নানা উপকরণ সংগ্রহ করে বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়েছেন। এই গ্রন্থে উনবিংশ শতকের নব জাগ্রত বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপ প্রত্যক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সাহিত্যিক।
🍂
প্রাবন্ধিক বন্দোপাধ্যায়ের ১৯১২ সালে "জাহ্নবী"তে প্রথম রচনা "স্বপ্নভঙ্গ" প্রকাশিত হয়। পরে সুযশ সাহিত্যিক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ এর তত্ত্বাবধানে নবাবী আমলের ইতিহাস কে পাথেয় করে "বাংলার বেগম* রচনা করেন। শোভাবাজার রাজবাড়ীর "সমাচার দর্পণ" ও অন্যান্য সামাজিক পত্রিকা ঘেঁটে ঘুঁটে বিভিন্ন তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন। যদুনাথ সরকারের কাছে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস রচনার পদ্ধতির পাঠ নিয়েছিলেন।
সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় "বাংলা সাময়িক পত্র" গ্রন্থটিতে ১৮১৮ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রকাশিত বাংলা সাময়িক পত্রের বিবরণী সংক্ষিপ্ত টীকা সহ আলোচনা করে বাংলা সারস্বত সমাজকে উজ্জীবিত করেছেন। যেমন-- "দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত 'সোমপ্রকাশ" পত্রিকার আলোচনা নিয়ে প্রাবন্ধিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন---
"তিনি তৎকালীন বাংলা সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান ধর্ম - কুৎসিত দলাদলি ও পরস্পর করদ্দম নিরপেক্ষ কে বিষবৎ বর্জন করিয়াছিলেন। শুভ্র শুচিতামন্ডিত হইয়া তাঁহার 'সোমপ্রকাশ' অচিরাৎ বাংলাদেশে আদর্শ সংবাদপত্র রূপে পরিগণিত হইয়াছিল"।
প্রাবন্ধিক বন্দোপাধ্যায় মহোদয় এই সব গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য ক্যালকাটা হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য পদ লাভ করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে শশীশেখর রাজশেখর ন্দ্রশেখর বসুর উদ্যোগে উৎকর্ষ সমিতির উৎসাহী সদস্য হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা, 'সংবাদপত্রে সেকালের কথা', 'বাংলা সাময়িক পত্র', 'সাহিত্য সাধক চরিত্রমালা'র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ ভূষিত করেছেন। এছাড়াও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে "রামপ্রাণ গুপ্ত স্বর্ণপদ " প্রদান করেন। ১৩৫৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে "অক্ষয় কুমার বড়াল" রৌপ্যদক লাভ করেন।
সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে তথা নাট্য সাহিত্যের জগতে বিশাল ও বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও আলোচনা , চর্চা ও পাঠকের দরবারে পৌঁছানো খুব বেশি না হওয়ার ফলে বিস্মৃতপ্রায় থেকেই গেছেন।
প্রাবন্ধিক সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস" ১৭৯৫ থেকে ১৮৭৬ অবধি প্রায় ৮১ বছরব্যাপী নাট্যশালার ইতিবৃত্ত যা বাংলা নাট্য সাহিত্যে বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। হেরাসিম লেবেডেফ থেকে শুরু করে ন্যাশনাল থিয়েটার ও এই থিয়েটারের বিভাজন পর্যন্ত আলোচনা করেছেন এই গ্রন্থে। দুটি খন্ডের শেষ খন্ডে অমৃতলাল বসু'র স্মৃতি কথা সংযোজিত হয়েছে। নাটক নাট্যকার ও নাট্যালয়ের নানা তথ্য "বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস" গ্রন্থে আশ্চর্য কুশলতা উপস্থাপিত করে বাংলা নাট্য সাহিত্যে উজ্জ্বল আসন পাকা করেছেন। "সাহিত্য সাধক চরিত্রমালা" গ্রন্থটিতে ও বিভিন্ন সাহিত্যিকদের তথ্যপঞ্জি আলোচনা, তথ্যের সমাহারে বক্তব্য বিষয়ের উপস্থাপনে দেশ কালের পরিচয় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা সামগ্রী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে চিরন্তন ও শাশ্বত।
0 Comments