জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান -১৯/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান                                  

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
উনবিংশতি পর্ব    

পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ   

জারোয়ারা মধুর চাককে যেভাবে সংরক্ষিত করে রাখে সেই পদ্ধতি খুবই বৈজ্ঞানিক। মধুর পাত্রে মধুর চাককে রেখে পাত্রের মুখ লম্বাপাতি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে আলো-বাতাসের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। তারপর মাটিতে বড় মাপের গর্ত খুঁড়ে নিচে লম্বা পাতি বিছিয়ে মধুর চাক ভরা পাত্র গুলিকে তার উপরে সাজিয়ে বসিয়ে দেয়। তার উপরে আবার লম্বাপাতি পেতে সবশেষে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। প্রয়োজনে মধুর চাক বের করে মধু খায়। প্রাপ্ত মধু একটু ঝাঁঝালো প্রকৃতির হয়। এছাড়াও বেশকিছু মৌসুমী ফলের বীজ পাতলা গোল করে কেটে জালের মধ্যে রাখে। জালসহ বীজকে কুটির সংলগ্ন লোনা অথবা মিষ্টি জলে কয়েকদিন ডুবিয়ে রাখে। তারপরে বীজগুলিকে পানীয় জলের উৎসে নিয়ে যেয়ে ধুয়ে জালসহ কুটিরে ঝুলিয়ে রাখে এবং সেগুলি শুকনো হয়ে যায়। অভাবের দিনে এই বীজগুলি সেদ্ধ করে জারোয়ারা ক্ষুধানিবৃত্তি করে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি জারোয়ারা আমিষ খাদ্য তালিকার মধ্যে জঙ্গলের পশু পক্ষী, সমুদ্রের মাছ, বিভিন্ন রকমের সিপি, কচ্ছপ ও পোকামাকড় খায়। এছাড়াও তারা গাছের ফল মূল খায়। বৎসরের বিভিন্ন সময়ে জঙ্গলে যেয়ে যে ফল বা বীজগুলি সংগ্রহ করে তাদের খাদ্যতালিকায় রাখে সেগুলি উল্লেখ করছি। 
কামফল, লালফল, লাটকাফল, কাঁটাফল, জংলী কাজু, জংলী হলদি, জংলী সুপারি, মারিপাতি (এই গাছের নরম ডগার পাতাগুলি জারোয়ারা বছরের সব সময়ই খায়), টংপেনে, আরগুনা, কাঁটাআলু, তেন্দু, জংলীআম, খাঁড়ি মহুয়া, কেলা, ধানিপাতি, কেউড়ি, থিটকান্দু, বাদাম প্রভৃতি। এই নিরামিষ খাদ্য তালিকায় তিন ধরনের গাছের শিকড় বা আলু যেমন চিকি, চেয়ো ও নাদিয়েতা, জংলী কাঁঠাল, জংলী আম, বেত ফল, জংলী আতা, গাছ থেকে আহরণ করা মধু এবং কেউড়ি ফল তাদের প্রিয় খাদ্য। আমিষ খাদ্যের মধ্যে তাদের আকর্ষণ বেশি জংলী শুকর এবং সমুদ্রের মাছ। জারোয়া অধ্যুষিত অরণ্যে নিরামিষ খাদ্যের অভাব নেই এখন শুধুমাত্র আমিষ খাদ্যের সমস্যা হয়েছে, কারণ চোরা শিকারিদের উপদ্রবের ফলে এবং সমুদ্রে অধিক মাত্রায় যন্ত্রচালিত যানের চলাচলের ফলে।   
🍂

জারোয়াদের পোশাক-পরিচ্ছদ রূপচর্চা ও প্রসাধন-                     
জারোয়ারা অরণ্যচারী হলে কি হবে তারা তাদের রূপ সম্বন্ধে খুবই সচেতন। উলঙ্গ জারোয়ারা রঙিন সুতো বা লতাপাতার ব্যান্ড বানিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে বাঁধে। গলা বা কোমরের জন্য যে সমস্ত ব্যান্ড বানায় তার সামনের দিক থেকে ঝুরির মত ঝুলতে থাকে বিশেষতঃ মেয়েদের। এই ঝুরিগুলি তাদের উর্ধাঙ্গ এবং নিম্নাঙ্গ স্বল্প আবরণে ঢাকতে সাহায্য করে যদিও তাতে লজ্জা নিবারণ করে সামান্য মাত্র। মহিলাদের যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত থাকলেও আমাদের মত এত লজ্জা অনুভূতি তাদের নেই। হয়তো অরণ্যচারী বলে এবং সভ্য মানুষের সংস্পর্শে আসেনি বলে। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসার পরে জারোয়া পুরুষ, নারী ও শিশুরা পোশাক-পরিচ্ছদ করতে শুরু করেছে। মেয়েরা ম্যাক্সি পরতে পছন্দ করে, সালোয়ার-কামিজও তারা ভালোবাসে তবে শাড়ির প্রতি তাদের কোন মোহ নেই। মহিলারা লোকালয়ের হিন্দু মহিলাদের মত সিঁদুরের টিপ কপালে লাগাতে ভালোবাসে। জারোয়া পুরুষেরা লাল রঙের প্যান্ট ও গেঞ্জি বেশি পছন্দ করে। তবে সভ্য জগৎ থেকে তাদের কুটিরে ফিরে যাবার পরে পোশাকগুলো তারা রেখে দেয়। অরণ্যে যেয়ে তারা পুনরায় দিগম্বর হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের প্রসাধন বা রূপচর্চা বর্ণনার আগে তাদের দৈহিক বিবরণ আমাদের জানা দরকার। জারোয়াদের মাঝারি থেকে লম্বাটে চেহারা। পুরুষেরা দীর্ঘদেহী - উচ্চতা ছ' ফুটের কাছাকাছি আবার কেউবা ছ' ফুটেরও বেশি। তাদের গায়ের রং কালো কুচকুচে, চুল কোঁকড়ানো এবং চোখ সপ্রতিভ। নারী-পুরুষ সবাই উলঙ্গ। নাক চ্যাপ্টা থেকে উন্নত ধরনের। পুরুষদের গালে কোনরকম দাড়ি দেখা যায় না শুধুমাত্র থুতনিতে অল্প কয়েকটি চুল থাকে তাও তারা কেটে ফেলে। মাথার চুলগুলি বড় হওয়ার সাথে সাথে ছুরি দিয়ে কেটে ছোট করে আধ ইঞ্চির বেশি বড় রাখেনা। নারী-পুরুষ সবাই এই ভাবেই চুল রাখে। আজকাল সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে নারীরা চুল একটু বড় রাখে এবং লোকালয়ে এলে পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করে। তাদের প্রিয় রং লাল। লাল রঙের কাপড় জারোয়াদের খুব প্রিয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাল কাপড় থেকে তারা সূতো বের করে নেয় এবং সেই সূতো দিয়ে সুন্দর ডিজাইনের ব্যান্ড বানায়। এই ব্যান্ড গুলি মাথা, গলা, হাত ও কোমরে পরে নিজেদের সম্প্রদায় ও বহিরাগত মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বনফুলের মালা এবং সমুদ্রের সিপি বা কড়ি গেঁথে হার বানিয়ে সেগুলি পরে জারোয়া নারীরা তাদের আমোদ-প্রমোদের সময় নাচ করে। সভ্য মানুষদের গলার সোনার হার ও হাতের আঙ্গুলের সোনার আংটির উপরে তাদের প্রচুর লোভ বা আকর্ষণ। জারোয়ারা সাজগোজ করতে খুব ভালোবাসে। সমুদ্রতট থেকে পাওয়া এক রকমের ধূসর থেকে সাদা রঙের মাটি দিয়ে বিশেষ ধরনের পেণ্ট বানায় যাকে তারা বলে 'পেলাব'।এই প্রেলাব দিয়ে মুখ ও হাতের বিভিন্ন অংশে তারা নকশা ও ছবি আঁকে। মানুষের হাড়ের অলংকার তাদের খুব প্রিয়। মৃত পূর্বপুরুষদের শরীরের ছোট ছোট হাড় দিয়ে মালা বানিয়ে সেগুলি তারা গলায় ও কোমরে বাঁধে। গ্রেট আন্দামানিজদের মতো জারোয়ারাও শরীরে কোন উল্কি আঁকে না। অপরাহ্ন বেলায় প্রসাধনে লিপ্ত হয়ে জারোয়া নারীরা যেমন নিজেরা সাজে তেমনি তাদের সন্তানদেরও সাজিয়ে তাদের শিল্পী মনের পরিচয় দেয়। জারোয়া পুরুষ ও তরুণেরা তাদের ব্যবহৃত বুকের বর্মকে একরকমের লতার লাল রস অথবা শূকরের রক্ত দিয়ে বিভিন্ন রকমের নকশা এঁকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলে। এছাড়াও সভ্য জগত থেকে পাওয়া লাল সুতো বা নীল সুতোর ব্যান্ড বানিয়ে বর্মের উপরে সেলাই করে লাগিয়ে নেয়। তাদের ব্যবহৃত তীর-ধনুক এবং মধু রাখার পাত্রকেও এইভাবে বিভিন্ন নকশা করে সাজায়। সভ্য লাল রংয়ের জিনিসের প্রতি তাদের মোহ চিরদিনের।  
খেলাধুলা ও অবসর বিনোদন -              
জারোয়ারা অবসর সময়ে নাচেও গানে মেতে উঠে। যেদিন ভালো শিকার হয় সেদিন তারা একসাথে ভোজন করে খুশিতে গান গাইতে থাকে, বিশেষত জংলি শুকর শিকার হলে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়। তাদের প্রিয় কোরাসগান 'ওলে লে লে লে ওলে লো'। আজকাল লোকালয়ের সংস্পর্শে আসার পরে জারোয়া শিশুরা হিন্দি ফিল্মের গান ও নাচ শিখেছে। তাদের শরীর নমনীয় যার ফলে নাচতে কোনো অসুবিধা হয় না। জারোয়া শিশুরা জঙ্গলের গাছে বেতের দড়ি বেঁধে দোল খেয়ে কুটিরে সময় কাটায়। জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলে। নবদম্পতির লুকোচুরি খেলা দেখতে খুবই সুন্দর। সাঁতার কাটাও তাদের কাছে এক রকমের খেলা এবং এতে তারা আনন্দ লাভ করে। একসঙ্গে অনেক জারোয়া শিশু সমুদ্রের অল্প জলে সাঁতার দেয়। ডুবসাঁতার তাদের খুব প্রিয়। জারোয়া তরুণেরা শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গিমা দেখিয়ে নানা রকমের খেলা দেখায়,অনেকটা সার্কাসের মতো, যা তাদের কাছে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। উপরে হাত দিয়ে হাঁটে, মাঝে মাঝে এই অবস্থায় নাচতে থাকে। এই নাচকে বলে থিপ-থিপ। আবার পা ওপরে রেখে মাটিতে মাথা রেখে হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে তারা আসন করে অথবা একটা হাতের উপর ভর দিয়ে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। একজনের কাঁধের উপর আরেকজন, তার কাঁধের উপর আর একজন দাঁড়িয়ে জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখায়। এছাড়াও জারোয়া যুবকেরা কাঁধে-পিঠে কোমরের দুই পাশ থেকে দুজনকে ধরে তারা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বাহাদুরি দেখায়। লোকালয়ের মানুষের কাছে তারা এখন ফুটবল-ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলা শিখেছে। আদিম জনজাতি জারোয়াদের কণ্ঠস্বর খুবই মিষ্টি, কোন কর্কশতা নেই যা তাদের কাছে প্রকৃতির দান। গান করার সময় তারা তালের দিকে নজর রাখে। গানের তালে তালে নাচ করে। তাদের লোকনৃত্য দুচোখ ভরে দেখার মত। জারোয়া তরুণ-তরুণীরা বনফুলের মালা ও লতাপাতা দিয়ে সেজে আরণ্যক জীবনের সম্পৃক্ত নানা রকমের লোকনৃত্য করে। হাতে হাত ধরে যখন সকলে নাচে তখন দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পুরুষেরাও সাজগোজ করে নাচ করে। স্বামী স্ত্রী একসাথে গানের তালে তালে নাচ করে খুশির মেজাজে মত্ত হয়।  
                                                    
পরবর্তী অংশ বিংশতি পর্বে

Post a Comment

0 Comments