জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( চতুর্বিংশ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (চতুর্বিংশ পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

বেলি কাকিমার কাছে মাধুর কথা শোনার পর থেকেই লোখা ছটপট করতে থাকে। একবার  যে করে হোক সে বেনাই যাবে। মাধুর শ্বশুর বাড়ি। কোন একটা অছিলায় সে দেখা করবেই মাধুর সাথে। সত্যিটা জানতে মরিয়া হয়ে লোখা। খগেন তার প্রাণের চেয়ে প্রিয বন্ধু। তাকে এভাবে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে দেখতে পারবে না। মাধু তার বন্ধুকে কাঁদিয়ে চলে গেছে। বন্ধু তাকে কাঁদিয়ে চলে গেছে হস্টেলে। একাকীত্ব তাকেও কষ্ট দেয়। আপন জনকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা লোখাও মর্মে মর্মে অনুভব করে। কিন্তু যাওয়া বললেই তো যাওয়া নয়। লোখার সামনে হাজারটা বাধা পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। বেনাই জায়গাটা তার অজানা। শুধু জানে রুপনারায়ণ নদীর ধারে একটা গ্রাম। বাবার কাছে লোখা রুপনারায়ন নদীর কথা শুনেছে বহুবার। সেই নদীর তীরে বসে বাক্সীর হাট। লোখার বাবা, জেঠা বাক্সীর হাট যেত। নদী পেরোলেই হাওড়া জেলা। সেইপারে ভাটোরা, পানশিউলি। এপারে দুধকোমরা হাট। তাদের শিলাই আর দ্বারকেশ্বর হুগলী জেলার  বন্দর খেয়াঘাটের কিছুটা আগে  মিলেমিশে গেছে। দুজনের মিলনে জন্ম নিয়েছে ওই নদী।  ভারী আশ্চর্য লাগে লোখার কাছে এই দুটি নদীর মিলন।  লোখা তো চিরদেনের মনপাগলা।  কোন একটা ছুঁত পেলেই হল। দিনমান তাকে নিয়েই পড়ে থাকবে। রূপনারায়ণের জন্মের কথাটা মাথায় আসতেই ভগীরথ খুড়ার কাছে সোজা একদিন  হাজির হয়।বলে,
—- আচ্ছা খুড়া লদীদেরও কী মিলন হয়। মানে ছেনা - মেইছেনার মত মিলন!
—ওই লে তোর মাথায় আবার ইসবের ভূত চেপে গেল কি করে, বল দিখি?
—- না, মানে, ওই মোদের শিলাই ত মেইছেনা। আর উদিকে ছেনা লদীটার নাম ত দারকেশ্বর। ত দুজনে যেই মিলমিশ হল, অম্নি তাদের একটা ছেনা জন্মাল। সেই ছেনাটার নামই ত রৃপনারান। আবার দেখ উদিকে কাঁসাই একটা মেইয়ামানুষ!সেও কুন্তুু ওই রুপনারানের টানেই ছুটে গেছে…! 
—- থামলু কেনে বলে যা,শুনিঠি।
—- ধুর্ তুমি নিশ্চই মনে মনে হাঁসঠ। বলঠ, লে, ই ছেনাটার মাথার দফা ফুরি গেছে। নাইলে হাওয়া- বাতাস লেগেছে। অকে অর দাদার কাছেই ঝাড়ফুঁক করাতে হবে। ইসবই ভাবঠ নাকি গ খুড়া।
— ধূর,হেউড়া! তরা ভাবু ভগী খুড়া সব জানে। সেটা ত ঠিক কথা লয়। মোর কতটুকু গ্যানগম্ম বল দিখি। এই যে তুই এমন করে ভেবেছু লদীকে লিয়ে, ই কি সহজ কথা! শিলাই - কাঁসাইয়ের আখ্যান আছে। মোদের গুরুদেবের কাছে শুনেছিলম। সেই কাহিনী আলাদা। কুন্তু তোর ভাবনাটাও লোতন। ভালোই ভেবেচু। জানু,ভাব সবার মধ্যে এসবেনি। ভাব কজন কত্তে পারে। ভাবের ঘোর সবাইকে লাগবেনি। তোখে লেগেছে। এবার লে ঠেলা সামলা। জানুনু ত ভাবের নেশা যেদি ঠিক মতো ধরে, ত মাগ -ছেনা লিয়ে সংসার করা উঠে যাবে। তখন কি আর করবি! ঘুরবি কোপনি এঁটে!
বলেই মিজমিজ করে হেসে উঠে ভগীরথ। হাবাগবার মতো মুখ করে লোখা চেয়ে থাকে তার দিকে। কোন অথৈ জলে ফেলল তাকে তা ঠাওর করতে পারে না সে। খানিকটা বিরক্তির ভাব করে সে বলে,
—- এগবার, এগবার তুমি যে কি বলে দও, খুড়া, মোর মাথায় সেঁদায় নি। ধূর, উসব ছাড় দিখি। আগে অই শিলাই - কাঁসাইয়ের গল্পটা বল। তারপর মোকে ভাবের নেশা লাগে,আর ঘোর লাগে,লাগু।
—উসব গল্প শুনেছিলম ঊমানাথ ঠাকুরের মুখে। কত বই পড়াা আছে জানু মানুষটার। যখন বিতান্ত শুনায় মোহিত করে দেয়। সে- ই এগবার বলেছিল কাহিনীটা। শিলাবতী নাকি কুন এক জয়পন্ডা ঠাকুরের মেইছেনা।তবে পন্ডা ঠাকুরের নিজের নয়। কুথা থিকে পেয়ে তাকে মানুষ কচ্ছিল। সেই মেইছেনার নখ চুল কাটা হলে তাকে শালপাতায় মুড়ে চালের বাতায় গুঁজে রাখত। জয়পন্ডা যখন গঙ্গাস্নান কত্তে যায় তখন মেইছেনাটি নাকি ওই শালপাতার পুঁটলিটা গঙ্গায় ফেলি দিতে দেয়।
—- ই যে দারুণ গল্প গ খুড়া। তারপরে?
—- তারপরে আর কি!  গঙ্গায় ফেলি দিবার সময় গঙ্গাদেবী নাকি জয়পন্ডাকে দর্শন দেয়। দেবীই তাকে বলে, তারা বাপে ঝিয়ে নাকি দেবদেবীর অংশ। অভিশাপ পেয়ে  মত্তে জন্মিছে। সেই কথা শুনে জয়পন্ডা ঘরের দিকে এসতে থাকে। ইদিকে বাপের এসতে দেরি দেখে মেইছেনা তার চিন্তায়  পড়ে মুচ্ছা জিয়ে লদী হই যায়। আর জয়পন্ডা ঘুরে এসে যখন এইসব কথা শুনে,সেও ঝিয়ের দুঃখে লদী হয়ে বইতে থাকে।
—-আহা গো মোদের শিলাই থাইলে এতই বাপ সুহাগী ছিল। মেইছেনার লরম মনটার ভিতরে বাপের জন্নে এত আকুলিবিকুলি। বড্ড মায়া পড়ে গেল গো। আজ থিকে মোদের শিলাইয়ের উবরে আর রাগবোনি । অকে আর রাক্কসী বোলবোনি কুনু দিন। আর কাঁসাইকে লিয়ে কি কুনু গল্প নাই?
— নাই কেনে, তাও আছে। পুরাণ পুঁথিয়ে কাঁসাই লদীর নাম ছিল নাকি কপিশা। এই লদীর উপর হাতির পোল তৈরী করে রাজা পার হইছিল।
— হাতির পোল! সে কিরকম গো খুড়া? বাপের জম্মেও শুনিনি কুনুদিন!
— লদীর উবরে একটার পাশে আরেকটা হাতি দাঁড় করি দিয়ে তাদের পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে গেইল রাজা।
— আর এই লদীর আসল গল্পাটা ত বল!
— ইটাও ওই উমানাথ ঠাকুরই বলেছিল। কংসাবতী নাকি রূপবতী ছিল খুব। তার রুপে পাগল হোয়ে কৃষ্ণ দামোদর লদীর রূপ ধরে  জড়ি ধত্তে ছুটে আসে। কাঁসাই ত মেইছেনা। তখন ভয়ে  সুমুদ্দুরর দিকে ছুটে যায়। কেনে কি সুমুদ্দুরুকে কাঁসাই ভালবাসত।
—অরেব্বাস ইত থাইলে পেম ভালবাসার গল্প। থাইলে খুড়া! এই কিষ্ণ ঠাকুর কি সেই কিষ্ণ ঠাকুর?
— উ মোর মুরাদে বলা সম্ভব নয়। থাইলে ঊমা ঠাকুরকে জিগ্যাস কত্তে হবে। ত সে যেই কেষ্ট হোক তাতে কি?
— না মানে দেখিঠি, কিষ্ণ ঠাকুরটি মাইরি, বেশ! কারো  পঁদে লাগতে ছাড়েনি। হেবি লেলচামি দোষ ছিল কুন্তু ঠাকুরের।
🍂

 গল্প শুনলেও লোখার মাথা থেকে বেনাই যাওয়ার রোক যায় না। খোঁজ করে না হয় সে বেনাই চলে যাবে। বেলি কাকির পরিচয় দিয়ে না হয় মাধুর শ্বশুর ঘরকেও চলে গেল। কিন্তু লোখার ভয় অন্য জায়গায়।যদি মাধু তাকে না চেনার ভান করে। ভাবনাটা লোখার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। 
—- উ শালার মেইয়া জাতকে মোর বিশ্বাস নাই। হয়ত একটা রিক্স লিয়ে চলেই গেলম। আর যেদি এগবার বলে দেয় মোকে চিনেনি। থাইলে ত মোর গতরকে সেঁকে দিবে পাড়ার লোক। শালা,নিজের জাতকে ত  চিনি। কথা শুনা- বুঝার আগেই  বলে দিবে,বের কর শালা লেঙল দড়ি! বাঁধ শালাকে পিট মজড়া করে গাছের সঙে। নাইলে বাতা ফালির জাঁক দে, জেন গু বেরি যাই।
যতবার এসব ভাবে,ততবার লোখার গা হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। তবু লোখা জেদ ছাড়ে না। বন্ধুর জন্নে যেদি এটুকু না করতে পারল তাহলে কিসের বন্ধুত্ব। লোখা এরকমই ভাবতে ভালবাসে। তার কাছে সম্পর্কের দাম সব থেকে বেশি। পড়াশুনায় তার তেমন কোন আগ্রহ নাই। ঝুমঝুমির ভরত কালসারের কাছে আড় বাঁশি শিখতে যায় রোজ। পাড়ার জেঠা-খুড়াদের সাথে জন খাটতে যায়। অনেকেই তাকে বারণ করে,
— এই বয়েস থিকে তুই মজুর খাটবি? হাতের কাজ কিছু শিবকতেও ত পারু!
— কি কাজ শিকব বল দিখি। রুপার কাজে কদিন গেইলম। ধূর পা মুড়ে ঠায় বসে ঘাড় ঝুঁকিযে কাজ করা মোর দ্বারায হবে নি।
— কেনে কাঠের কাজও ত শিকতে পারু?
—-ধূর! উসব ঘুসঘুসানি কাজ! মোর পসাবেনি।
—- থাইলে আর কি করবি। জাতের ধম্ম গামছা কাঁদে দিয়ে লোকের বাগালি করা,তাই কর।
—- উটাই ভালো। নিজের কাছে নিজেই রাজা। আগের মত ত দিন নাই,যে উঠা সুজ্জু ডুবা সুজ্জু খাটাবে। হাত তুলা নাক তুলা খেতে দিবে। বাগদির এঁঠা বাসন ধুবে নি। নিজেকে ধুতে হবে। উনব ত কবেই ফুরি গেছে। এখন মশাই মশাই করে পা ধল্লেউ মজুর পাবে নি। পসায় যাব, নাইলে যাব নি। কারো ধার ধারবোনি। 
— কুন্তু এখন থিকে  কদান পাল্লে কদিনেই যে বুড়েটা মেরে যাবি সেটা জানু। বিয়া কল্লে তোকে মিয়া দিবে আর।
— না মিয়া পাই বোম্ভচারি থাকব। আর মেয়া পেলেও কি শান্তি। তখন ত খাটিনি আরো বেড়ে যাবে। কথায়ই ত আছে বউ পুষা না হাতি পুষা।
—যা ভাল বুজু – কর।
— আসলে কি জান কত্তে মন অনেক কিছুই চায়। কুন্তু যার মাথার উবরে কেউ নাই। তার জীবন এরকমই হবে গো খুড়া। 
লোখা সেই থেকেই জনমজুর খাটে। নিজের ও ভাগের জমিতে চাষ করে। আর মাঝে মাঝেই বেলি কাকির ঘর যায়। ঘুরিপেঁচিয়ে মাধুর কথা টেনে আনে কথার মাঝখানে।
—- কি গো কাকি তুসি আর বোনের ঘর যাউনি?
—- ও বুজতে পেচ্ছি! না যাইনি বোনের ঘর।  তবে বাপের ঘর গেইলম, বোনও মোর এসছিল, বোনের কাছেই শুনলম, মেইছেনাটা ত পইতি হইচে। দু'মাসের।
— এরই মদ্দে! বিয়ার কদিন যেতে না যেতেই…! এগবারে কি তর সয়নি! 
—- এতে আবার তর সওয়ার কি আছে? ছেনা লিতে হবে যখন লিইচে। সে কি বাঁজা থাকবে নাকি তমার বন্ধুর জন্নে ছেনার লাড়ি কেটে দিবে। 
—- না তা কি বোলিঠি। আসলে অর এমন কত বয়স! হাসপাতালের নাসেরা ত অকে দমে বেখান দিবে। কম বয়সে ছেনা লিলে ডাক্তাররা ত বকে শুনি
— ডাক্তারদের কি লিবে! তবে এর মদ্দে অন্য একটা ব্যাপার আছে! বোন অর জা-জাউলিদের কাছে শুনেচে। সত্তি- মিথ্যা বোলতে পারবোনি।
—- কি বেপার গ কাকি?
—- বেপার তমার বন্ধু। মেইছেনাটার বর নাকি কুনু ভাবে ওই হাত ধরে টানাটানির কথা জানতে পেরে যায়। এখন যত হোক পুরুষ মানুষের মন। সন্দেহ ত হবেই। কেনে মেইছেনার মন ঘুরে যাবে,তারচে ছেনা লিয়ে লিয়েচে। ছেনার টানে সংসার ছাড়তে মন চাইনি কুনু মেয়ার।
— বুজলুম! 
—- কিছুই বুজনি। ভাল করে বুজতে হলে মেইছেনাটার কাছ থিকেই বুজে লিবে খন।
—- সে ত হাতের কাছে পেলে,অকে ছাড়ব মনে করেচ! তবে কি জান মাধুর মা হবার কথাটা শুনে মনটা একটু ধসকে গেল। ছেনাটাকে এই খবরটা দুব নাকি ভাবচি। তবে ভালই হইচে। সে এখন পড়তে মেদনীপুর চলে গেছে। কলেজে পগে সেখিনে। 
—- কেনই এখনি বলতে যাবে বল দিখি। সময় ত পালি যাইনি। তার আগে বরঞ্চ মেইছেনাটার সাথে একবার কথা বলতে পার।
—- অকে পাব কুথায়। তমার কথা শুনে এগবার বেনাই যাব ভেবেছিলম। কুন্তু সেটা খুব রিক্স হই যেত।
— আরে উ ত এসবে এখিনে। বরটা ত বাইরে চলে গেছে। পরশু অর ঢোপি মায়ের সঙে দেখা হইছিল চেতলা বাজারে। ও রে বাপরে! ফেঁদির চটক দেকলে গা পিত্তি জ্বলে যাবে। একসঙে এসতে এসতে শুনলম মাধু এসবে বাপের ঘর। দিনা সাতেক থাকবে। এখন এইলাপইলা বলে বাপের ঘর একবার ঘুরে যাইঠে। জড়া মেইয়াকে পরে আর পাঠাবেনি।

Post a Comment

0 Comments