সুমিত্রা ঘোষ
সম্পত্তি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজচন্দ্র দাস দানধ্যানের মাত্রাও বাড়িয়ে দেন। সম্পত্তি এবং দানধ্যানের ব্যাপারে রাজচন্দ্রের স্ত্রী রানি রাসমণি স্বামীকে শক্তি যোগাতেন। কোন জটিল ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তিনি রানির পরামর্শ নিতেন।
রানির চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে পদ্মমণির বিয়ে হয়েছিল রামচন্দ্র আটা ও মেজোমেয়ে কুমারীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল প্যারীমোহন চৌধুরীর। তৃতীয় কন্যা করুণাময়ীর বিবাহ হয়েছিল মথুরামোহন বিশ্বাসের সঙ্গে। মথুরামোহন তৎকালীন হিন্দু কলেজের নামকরা ছাত্র ছিলেন, পরবর্তীকালে রানির ডান হাত স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন। কারণ মথুরামোহন বিশ্বাসী, কর্মকুশল, ইংরাজী ভাষায় অভিজ্ঞ, প্রতিভাবান ও সধর্মনিষ্ঠ। রানির তৃতীয় কন্যা করুণাময়ীর অকাল- মৃত্যু হওয়ায় মথুরামোহনের সঙ্গে তখন বিবাহ দিলেন ছোটমেয়ে জগদম্বার সঙ্গে। সময়টা ছিল ১৮৩১ সাল।
জানবাজারের জমিদারবাড়ি লোকজনের আনাগোনায় গমগম করত। এর মধ্যে রাজচন্দ্রদের পরিবার নেহাৎ ছোট ছিল না। মেয়েদের সময়মত বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। জামাইদের সন্তান স্নেহ দিতেন রানি রাসমণি এবং রাজচন্দ্র দাস। রাজচন্দ্র দাস তখনকার দিনে সমাজের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে মেয়েদের সাধ্যমত লেখাপড়াও শিখিয়েছিলেন।
বাংলার প্রায় সর্বত্রই রাজচন্দ্রের জমিদারি ছড়িয়ে ছিল। রাজচন্দ্র নিঃশব্দে কাজ করতেন। কোন হম্বিতম্বি বা অহংবোধ ছিল না। নিজের চেষ্টায় বিশাল বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। এত বিষয়সম্পত্তি,এত প্রতিপত্তি, এত সুখ, সর্বাঙ্গসুন্দরী ও গুণবতী স্ত্রী সব ছেড়ে রাজচন্দ্রকে অল্প বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল।
🍂
সময়টা ছিল ১২৪৩ বঙ্গাব্দ।ইংরাজির ১৮৩৬ সাল।গদাধর জন্ম নিলে কামারপুকুরে। রাজচন্দ্র দাস যখন ইহলোক ত্যাগ করলেন তখন তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল আনুমানিক আশি লক্ষ টাকা। প্রায় পুরোটাই রাজচন্দ্রের রোজগার। ১৮১৭ সালে প্রীতরাম দাস তখন ইহলোক ত্যাগ করেন তখন তাঁর সম্পক্তির মূল্য ছিল সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা ও প্রচুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। রাজচন্দ্র উনপঞ্চাশ বৎসর বয়সে সন্ন্যাস রোগে ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে রাজচন্দ্র দাসের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে কারন উনপঞ্চাশ বৎসর বয়সেই তার মেয়েদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়েছিল। ইংরাজী ১৮৩১ সালে হিন্দু কলেজের সেরা ছাত্র, কলকাতার উদীয়মান বড়লোক মথুরামোহনের সঙ্গে রাজচন্দ্র দাসের কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার বিবাহ হয়। জগদম্বার পূর্বে রাজচন্দ্রের তৃতীয় কন্যা করুণাময়ীকে বিবাহ করেন মথুরামোহন বিশ্বাস। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কিছু দিন পর করুণাময়ীর মৃত্যু হওয়ায় জগদম্বার সঙ্গে মথুরামোহনের বিবাহ দেওয়া হয়। করুণাময়ীর মৃত্যুকালীন সময়ে তাঁর একপুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জগদম্বা তাকে মাতৃস্নেহ দিয়ে মানুষ করে তোলে।১২৪৩ বঙ্গাব্দে রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর জানবাজারের বিশাল দায়দায়িত্বভার রানির উপর এসে পড়ে। স্বামী-স্ত্রীতে অগাধ ভালবাসা, বোঝাপড়া কোন বিষয়ে কমতি ছিল না। একে অপরের পরিপূরক হয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন। রাজচন্দ্র ও রানি রাসমণির অমলিন ভালবাসা,প্রেম সব শেষ হয়ে গেল রাজচন্দ্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। রানি শোকে পাথর হয়ে গেলেন। রানি রাসমণি তিনদিন, তিনরাত অনশনে কাটালেন। ভূমিশয্যা করলেন। স্বামীর শেষ কাজ তথা শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করলেন নিষ্ঠার সঙ্গে। খরচের কোন ঘাটতি রাখলেন না। স্বামী যতদিন ছিলেন ততদিন রানি রাসমণি ঘোমটা টানা সলজ্জ গৃহবধূ হয়ে দিন কাটাননি।
ক্রমশ
0 Comments