জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ৯/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৯
গৌতম বাড়ই

তারপর সেদিন:

ভরতভৃগু যখন গোপনে রাজকন্যা সুসীমার ঘরের ভিতরে ঢুকে রয়েছিল, ভেবেছিল রাজকন্যার কিছু জেহাদী কথাবার্তা রাজার কানে তুলে দিতে পারবেন। কিন্তু তার বদলে, বলতে গেলে প্রায় নিশ্চূপ হয়ে রইলো মা ও মেয়ে দুজনেই ঘরের ভেতরে। শুধু একবার রাজকন্যার উঁচুগ্রামে বলা কিছু কথাবার্তা তার কানে গিয়েছিল। 

সুসীমা বলছে- " তুমি তো মৃতবৎসা মা, জানিনা কী কুক্ষণে আমি এই ধরাধামে এলাম। যার জন্যে হয়ত তোমার মৃতবৎসা শিরোপাটি ঘুচেছে, কিন্তু কাকবৎসা হয়ে রয়ে গিয়েছ। তুমি বঙ্গরাজের প্রতি সেইজন্য কৃতজ্ঞ , কারণ তিনি অন্য কোনো দার  গ্রহণ করেননি। আসলে বঙ্গরাজ এক ভীরু কাপুরুষ, তিনি প্রবল পরাক্রম আর প্রভূত ক্ষমতাশালী কলিঙ্গরাজের ভয়ে ঐ রকম সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেয়েছেন। নাহলে রাজরক্তে একের অধিক স্ত্রী থাকা তো গর্বের বিষয়বস্তু! না কি তিনি এ ব্যাপারে পারদর্শী নন? ঐ এক নপুংসক সখী-সখী স্বভাবের মেয়ে-পুরুষ ভরতভৃগু ওনার প্রিয়জন? তবে ভরতভৃগু চরগিরি করছেন মহারাজের হয়ে। এ ভারী অন্যায়! যে নিজের সন্তান-কে বিশ্বাস করে না , সে নিজেকে বিশ্বাস করেন কী? "- এই বলে থেমেছিল সুসীমা। 

এতে রাণীমা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে কন্যাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন- " তোমার বিবেক আর শ্রদ্ধাবোধ এখনও জাগ্রত হয়নি। আর তোমার মধ্যে বিন্দুমাত্র সংশোধন হয়নি এখনও। সেনাপতি অনুরের কঠোর নজরে রয়েছ, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। তোমার একদিন কঠিনতম শাস্তি হবেই। তুমি পাষাণ হলে, আমরাও পাষাণ হয়ে উঠতে পারি। দেয়ালেরও কান আছে, তাই আর বেশি কথা বলছি না। ঘরের কথা বাইরে যাবার আগে তোমায় আমিও সাবধান করে গেলাম। "

সুসীমা বললেন- " আমি মরতে প্রস্তুত মহারাণী, আমি তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই। আর শুনে রাখো,  অনুরের মতন এমন সুপুরুষ আর শক্তিশালী পুরুষ আমি এই রাজপ্রাসাদের ভিতরে বা এই বঙ্গদেশে  কাউকে কোথাও এখনও দেখিনি। ওনার হাতেই আমি মৃত্যু বরণ করতে চাই।" রাণীমা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এরপর।

ভরতভৃগু দেখল এগুলো সব পারিবারিক কথাবার্তা, রাজমহলের ভিতরেই থাকা উচিত। তবে তার চরবৃত্তির কথা রাজকন্যার মুখে শুনে, তার ভিতরে এক শঙ্কাও তৈরী করল।  রাজার কানে তুলে দিতে গেলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। আমি যে রাজার প্রিয়পাত্র তা জানলো কি করে? রাজপ্রাসাদের অন্দরে, ক্ষমতার বৃত্তায়নে কেউ কারো ঘনিষ্ঠ নয়। তবে সুসীমার মতিগতি তার ঐ দু- চারটি পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যেও কিন্তু বিপদের অশনিসংকেত লুকিয়ে ছিল। ভরতভৃগু ভেবে রেখেছে, আগামীদিনে এটুকু সাজিয়ে গুছিয়ে রাজার কানে তুলে দিলে হয়ত মন্দ হবে না। প্রতিশোধ একটা নিতেই হবে, তাকে রাজকন্যা নপুংসক বলেছে, এ তো নিজের কানে শোনা। তবে রাজকন্যার ঘরে ঢুকেছে, এ কথা রাজার কানে যদি যায়, তাহলে তারও ভয়ানক শাস্তি হবে। আপাতত সব কথা তাকে হজম করে নিতেই হবে। 

রাজকন্যার ঘরের দরজা খোলা, ভিতরে নারী- পুরুষের চাপা কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তার কালো পোষাকে ঢেকে রাখা শরীরে,আড়ালে, চুপিসারে, সাবধানে, মার্জারের মতন শব্দহীন পদে, যতটুকু কাছে যাওয়া যায়, যেতেই হবে তাকে। গুপ্তচরের চোখ অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে জ্বলে। অন্ধকারে ঐ ছায়ামূর্তি যে সেনাপতি অনুর ছাড়া আর কেউ নয়, ভরতভৃগুর এতে কোনও ভ্রান্তি নেই। আজ আড়ি পেতে শুনতেই হবে, তারপর এর কিয়দংশ যদি অনুমানে মিলে যায়, তাকে আর পায় কে? তবে বুক তার ঢিপঢিপ করছে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে সামনে, একটা জব্বর পদোন্নতি তার চাই-ই চাই, অনুরকে আমার হুকুম তামিল করতে হবেই। দরজার একদম নিকটে চলে এসেছে সে, দরজার মুখে থামের আড়ালে প্রথমে, তারপর এগিয়ে গেল বড় দরজার দিকে। অশ্বের গতি আর চিতার ক্ষিপ্রতা এই দুয়ের মিশ্রণ হল সেনাপতি অনুর। ভিতরে রাজকন্যার সাথে কী কথা চলছে অনুরের? আরও এগিয়ে যেতেই হবে ভরতভৃগুকে। বাক্যালাপে ফিসফিসানি, তারপর নিস্তব্ধ। এবারে আর তার তর সইলো না এক মুহূর্ত। বুকে আরও সাহস বল করে বড় দরজা দিয়ে মার্জারের মতন শব্দহীন ঘরের অন্দরে প্রবেশ করলেন। শব্দহীন একটা ছায়া মিশে যেতে চাইছিল ঘরের ভিতরে। কিন্তু অতিসাহস আর অতি চালাকি যে সর্বনাশও ডেকে আনে, এ কথাটি বোধহয় বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন ভরতভৃগু।

অন্ধকারে ভরতভৃগুর মুখ দিয়ে একটা ঢেঁকুর ওঠার মতন ওয়াও শব্দ হল শুধু। আর তারপর তার চোখের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে গেল, গাঢ় হতে হতে একসময় সে ঢুলে পড়ল মেঝের ওপরে, একটি বলিষ্ঠ হাত তাকে খাড়া করে ধরে রাখল। কান পেতে বুকের নিঃশ্বাস নিল অনুর, ধুকপুকে এক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে যেন! ভরতভৃগু এখন অচৈতন্য দেহে? নাকি এই শূন্যদেহে পড়ে আছে শুধু! অনুর খুব চাপা স্বরে বলল-" খুব গুপ্তচরগিরি চলছিল! মাশুল গুনতেই হবে তোকে। পাপের মাশুল মৃত্যু। কিছু কিছু বৃত্তির মাশুল প্রাণ দিয়েই চোকাতে হয়!"
রাজপ্রাসাদের সেই রাতের তৃতীয় প্রহরে সেনাপতি অনুর ঘোড়া ছুটিয়ে রাজমহলের বাইরে বের হলেন। সেদিন রাতের অন্ধকারে যে প্রহরীরা দেখেছিলেন, তাদের কাছে ছিল যেন  ঈশাণ কোণের ঘূর্ণি হাওয়া। বঙ্গদেশে জনশ্রুতি ছিল, পশ্চিমা দেশের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর ধূলিঝড় ছাড়া অনুরের অশ্বারোহণ অবস্থা কেউ দেখতে পায় না। অশ্বের গতি আর চিতার ক্ষিপ্রতা এই দুয়ে মিলেই তো সেনাপতি অনুর। অনুরের ঘোড়া চড়ে প্রস্থানের পরেই, রাজপ্রাসাদে ধীরে- ধীরে যে হই চই শুরু হল, তা ক্রমে বাড়তে লাগল। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। আলো ফোটবার সময় হয়ে এসেছে। 

সেই দ্রুতগামী ঘোড়া জীমূতনাদের পিঠে চড়ে রাজপ্রাসাদ থেকে ক্রোশ- ক্রোশ দূরত্ব রচনা করে ফেলল নবোদয় ঊষার আলোতে ঘোড়ার পিঠে বসা তিনজনে। বিশৃঙ্খলা নিয়ে ঘুম ভাঙলো বঙ্গেশ্বরের। রাজার কানে এ খবর এসে পৌঁছে গিয়েছিল, রাজকন্যা পালিয়ে গিয়েছেন এই রাজমহল ছেড়ে! ভরতভৃগু কোথায় গিয়েছেন? কেউ জানে না। তবে সেনাপতি অনুর তার প্রিয় অশ্বে আরোহণ করে অন্ধকার রাতে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজপথের অন্ধকারে দ্রুত বেগে কোথাও চলে গিয়েছেন। রাজবুদ্ধিতে কিছুই মাথাতে এলো না। তবে তিনজন যে প্রায় একই সময়ে এই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন , এ বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন জনের বিবরণ শুনে। রাজার হুঙ্কারে বারবার কাঁপতে লাগলো এ রাজসভা। ক্ষমতা যখন বিপদের গর্তে পরে, প্রথমে অমন তর্জন আর গর্জন চলে। তারপর সব স্তিমিত হয়ে আসে। সেনাপতি অনুর বিস্ময়জনকভাবে ঘোড়া চড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন, এই মুহূর্তে রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি নেই, শ'দেড়েক বাছাই সেনা উত্তর দিকে আর শ'দেড়েক সেনা পশ্চিমে গেল ঘোড়া ছুটিয়ে, রাজার হুকুমে। 

পশ্চিমে গেলেও শ্বাপদ শঙ্কুল জঙ্গল আর উত্তর দিকেও পাহাড় জঙ্গল আর বন্য পশুপাখি আদিম বন্য অধিবাসীদের বাস। যারা এখনও সভ্য হয়ে ওঠেনি। লতাপাতার পোশাক পরে জঙ্গলে জঙ্গলে নিজেদের খিদের তাড়নায় খাদ্যের সন্ধানে ঘোরে। সেই অশ্বারোহীগণ, সেই বাছাই করা সেনাদের দল ততটা দ্রুতগামী না হয়েও, খুব সন্তর্পনে চলেছে পথে, আশপাশে দৃষ্টি খোলা রেখে । কেউ বলছে সেনাপতি অনুর নয়, ভরতভৃগু রাজকন্যাকে নিয়ে পালিয়েছে মগধের দিকে, সেনাপতি অনুর তাদের সন্ধানেই বেরিয়েছে। আবার কেউ বলছে, ভরতভৃগুর আর যাই হোক, রাজকন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার বুকের পাটা অন্তত হবে না, যেহেতু প্রহরায় রয়েছে অমন দূর্ধর্ষ সেনাপতি অনুর। তবে কোথায় গেল তারা? এ প্রশ্ন তো সবার মুখে রাজপ্রাসাদে! তবে আগামীতে গোটা বঙ্গ- প্রদেশ এই প্রশ্ন করবে। বঙ্গেশ্বর বেলা আরও বাড়তে- বাড়তে প্রচণ্ড মুষড়ে পড়েছেন। 

সৈন্যদলও ফিরে আসছে না। বঙ্গের আকাশে আজ দূর্যোগপূর্ণ মেঘ। মাঝি- মাল্লারা দল বেঁধে সেই বড় নদীটি বেয়ে চলেছেন ভাটিতে, গান গাইছেন গলা ছেড়ে তারা। রাণীমা ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। দাস- দাসীরা মৌন। সারা রাজপ্রাসাদ জুড়ে যেন বিষাদের ছায়া। সর্বনাশ আঁকা রয়েছে যেন এখানে- ওখানে। শূন্য রাজকন্যার ঘর।
ক্রমশ
🍂

Post a Comment

0 Comments