যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৮৪
রানী তানি আজ কলকাতা গেছে সল্টলেকে কী একটা কাজে। ওরা তো কিছু চেনেনা, বড়দির নাতনির শ্বশুরবাড়ি ওখানেই কোথাও। তার ছেলে হাওড়া ষ্টেশন থেকে নিয়ে গেছল।, কাজ শেষ হতে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। আগামিকাল ফিরবে।
দুপুরে রামকৃষ্ণ বাবু ফোন করে জানালেন, ১লা আগস্ট নারী পাচারের ওপরেই দূরদর্শনে একটি লাইভ প্রোগ্রাম করবেন, আমাকে যেতেই হবে। এটা জেনে আমার তো খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু পারছি না। ওনাকে কী বলব? গত সপ্তাহেই কলকাতা গেছলাম। এদিকে দূরদর্শনের প্রোগ্রাম ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। পরদিন দুপুরে ওনার খাওয়ার সময় অনেক সাহস সঞ্চয় করে কথাটা ওনাকে বললাম। কিছু বলেননি, রেগেও যাননি। অনুমতি দিয়েছেন। ওনার কোনও অসুবিধা না হয়, তার সব ব্যবস্থা করেই যাব, উনি আমি কাছে না থাকলে নিরাপত্যা হীনতায় ভোগেন। কারো ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। আমারও ওনাকে ছেড়ে যেতে খারাপও লাগে, কিন্তু কি করব? আমার কাজগুলো তো চালিয়ে যেতে হবেই।
তবে ঠিক করেছি ৫ সেপ্টেম্বরের পর এখন আর কলকাতার কোন অনুষ্ঠানে যাব না। তালাক বিল আজ(৩০/০৭/১৯) পাশ হয়ে গ্যাছে। তাই আগামীকাল ওসমানরা প্রেসক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্স রেখেছে। আমাকে যেতেই হবে, ওসমানের এটাই বক্তব্য। আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, কেন আমি যেতে পারব না। আজ কলকাতা দূরদর্শনে সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ শে প্রোগ্রাম শুরু হবে। একজন আয়া ঠিক করেছি ওনার জন্য। চন্দ্রিমা প্রতিবার অমার সঙ্গে যায় ,আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে যাই ফিরতে রাত হবে বলে। গতবারে সৌনককে নিয়ে গেছলাম, এর আর একটা কারণ সাধারণ মানুষকে অকারণে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না, আমার সঙ্গে গেলে ভেতকে ঢুকতে পারবে। এবার তাই সুদীপকে সঙ্গে নিয়েছি।৩ টের সময় রওনা হয়ে ৬টা ৩০ শে দূরদর্শন ভবনে পৌঁছালাম। কাগজপত্রে সই করে মেকআপে বসলাম। তারপর শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্লোরে গেলাম। আমার সঙ্গে চন্দ্রিমা সুদীপও এল। গতবারে চন্দ্রিমা ও সৌনককে কন্ট্রোল রুমে বসিয়ে ছিল। এবার ফ্লোরেই দূরে বসতে দিয়েছে।
আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। অঞ্জনা ভৌমিক নামে একজন পুলিশ অফিসার ও শুভশ্রী নামে একজন সমাজকর্মী। সঞ্চালনায় সঞ্জয় ব্যানারজিই ছিলেন। ওঁদের কথায় অনুষ্ঠান ভাল হয়েছে। স্টুডিও থেকে ৮টা ৪৫ মিনিটে রওনা দিয়ে বাড়ি পৌঁছালাম ১১টা ১০ মিনিটে। শুনলাম সৌনক ৯টার সময় এসেছিল ওনার খবর নিতে। ফোন খুলে দেখলাম অজস্র মেসেজ। আজ আর উত্তর দেওয়ার সময় নেই, ভীষণ ক্লান্ত। উনিও অনুষ্ঠান দেখাছেন, জেগেছিলেন আমার জন্য। এখন ঘুমচ্ছেন, ফ্রেস হয়ে আমিও শুলাম।
🍂
আজও অনেক মানুষ ফোন ও মেসেজ করেছেন। কিছু মানুষ আন্তরিক ভাবেই শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন, সবাই ঈর্ষাকাতর, বেইমান নন। আজ ডায়ালিসিস করাতে নিয়ে গিয়ে ইউরোলজিস্টের কাছে ওনার নাম লিখিয়ে এলাম। কয়কদিন ধরে ইউরিনের সমস্যা হচ্ছে। খড়গপুরের ডাক্তার, বিকেলে দ্যাখেন, নার্সিংহোম থেকে ফিরে রান্না খাওয়া করে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওনাকে নিয়ে ৫ টাতে পৌঁছে দেখি প্রচুর ভিড়। বসার জায়গা নেই। জানি উনি বেশিক্ষণ বসতে পারবেন না। আমি অন্যায়ভাবে কোনও সুযোগ নেওয়া পছন্দ করিনা। কিন্তু ওনার এই অবস্থাতে ডাক্তারকে আমার পরিচয় জানাতেই হল। অন্য কোন রোগীর এরকম অবস্থা হলে আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে আগে দেখানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকি। আজ ওনার এই অবস্থায় আমি ভিতরে বলে পাঠালাম যে, এফ আর খানের দিদি এসেছেন। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে ওনাকে দেখে কতকগুলো টেস্ট লিখে দিলেন। ওগুলো করিয়ে রিপোর্ট খরগপুরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে বললেন। এফ আর খান (আমার ভাই) ওনাকে বলে রেখেছিল। স্ক্যান সেন্টারে প্রচুর ভিড়, অনেক রিকোয়েস্ট করে তাড়াতাড়ি করিয়ে নিয়ে এলাম। রিপোর্ট কাল কখন পাব কে জানে? বেশি সময় নেয়নি। পরের দিনই রিপোর্ট পেয়ে গাড়ি নিয়ে খড়গপুর গেলাম। ডাক্তার বললেন, ক্রিয়েটিনিন বেড়েছে। ইউরিনের সেই কষ্টটা নেই, তবে পা-হাত ফোলা আছে। খেতে পারছেন না। বাবলি বলেছে, বাপি যা খেতে চাই, তাই খেতে দিও।
রানী এবার ইদুজ্জহাতে বাড়ি যায়নি, আমরা আমাদের মত করে ইদ কাটালাম। আজ স্বাধীনতা দিবস ও রাখিবন্ধন উৎসব। এসব আর আমার মনকে নাড়া দেয় না। আজ আমাদের বাবলি আসবে, তাই ভোর থেকে খুব ব্যস্ত। ড্রাইভারকে ঘুম থেকে তুলে এয়ারপোর্ট পাঠাব, এমন সময় বাবলির ফোন পেলাম, ওরা কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে পারবে না। এখানে একদিন থাকতে হবে। তাই ড্রাইভারকে নিষেধ করলাম। আবার কিছুক্ষণ পর বাবলি বলল, ‘মা, আমরা ফ্লাইট পেয়ে গেছি’। আবার ড্রাইভারকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে টাকাপয়সা, কাগজপত্র, ফ্লাক্সে চা-বিস্কুট, জল দিয়ে ওকে পাঠালাম।
এদিকে বাবলিরা বের হতে দেরি করছে। ফোন করতে জানাল, ওদের লাগেজ দুবাইয়ে রয়ে গেছে। আগামিকাল ওরা বাড়ি পৌঁছে দেবে। রানী জারার জন্য ড্রেস কিনে নিয়ে এল। না হলে পরবে কী? এদিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ওরা ১২টার দিকে এসে পৌঁছাল। তবুও আমার ‘চাঁদের হাট’ পূর্ণ হল না।
আজ দীপ অনেক বাজার করে এনেছিল। গতকাল সবই প্রায় রান্না করেছিলাম। বিকেল থেকে ওয়েদার আরও খারাপ। আজ খুব সকালেই ওনাকে নিয়ে নার্সিংহোম পৌঁছে গেছলাম। রানী আর বাবলি রান্না করেছে। গতকালের কিছু রান্না আছে। আমরা বাসি রান্না খাই না। খান সাহেব দুপুরের রান্না রাতে বাসি বলেন। বাবলিরা তো বাসি খেয়েই অভ্যস্থ। যখন সময় পায়, রান্না করে রেখে দেয়। রাজুটা আজকাল কথা রাখছে না। বিকেল ৪ টেতে দীপকে কাঁথি নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু এমন শুরু করল যে বাধ্য হয়ে অন্য ড্রাইভারকে ফোন করলাম। সে এসে ১৫ মিনিট আগেই রওনা দিল। সন্ধ্যায় শ্বাতীর(বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষিকা)সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল।
আমরা আজ সন্ধ্যায় সৌনকদের বাড়ি গেছলাম। জারা ওর ছেলের সঙ্গে বেশ মিশে গেছল। ওদের বাড়ির সবার ব্যবহার খুব আন্তরিকতাপূর্ণ। ৮টা ৩৫ এর দিকে বাড়ি ফিরে ওনাকে খেতে দিলাম। আমাদের ঘুমোতে যেতে প্রায় ১২টা বেজে গেল। আর তখুনি ওনার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। একেবারে অস্থির অবস্থা। হাত-পাও বেশ ফোলা। ফোন করে রাজুকে ডেকে মা মেয়ে ওনাকে স্পন্দনে নিয়ে গেলাম। অক্সিজেন দিয়ে আই সিইউ তে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করল। আমাকে দিয়ে বন্ড লিখিয়ে সই করিয়ে নিল। আমাদের বাড়ি চলে যেতে বললে। আমি রাজি হলাম না। মা-মেয়ে সারারাত ওয়েটিংরুমে বসে থাকলাম। কাউকে কিছু জানালাম না। সাহবাজ ওর এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল। ওরা অনেক হেল্প করেছে।
জানলাম এখন ভাল আছেন। ভোর পাঁচটায় বাড়ি ফিরে বাবলি ঘুমাতে গেল। আমি স্নান করে চা খেয়ে আবার নার্সিংহোমে গেলাম। ডাক্তার রাউন্ডে এসে, দেখে বললেন, আপাতত ঠিক আছেন। তবে ক্রিয়েটিনিন অনেকটা বেড়ে গেছে, আজ আর কাল দুদিন পরপর ডায়ালিসিস করাতে হবে। আমি কাউকে খবর দিইনি। দীপকেও না, রাতেরবেলা বিব্রত করতে চাইনি। সকালেই ওর ফেরার কথাছিল। ও ফিরতেই বাবলি ও দুজনে নার্সিংহোমে আসে। চন্দ্রিমাও আসে। বেলার দিকে সৌনক খবর পেয়ে আসে। সুদীপ, মণিকাঞ্চন, আজরা আরও অনেকে দেখা করতে আসে।
ওনার সঙ্গে দেখা করলাম। একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। আমি আর দীপ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিনও ওনাকে নার্সিংহোমে থাকতে হল। রিলিজ করার সময় আমি আর দীপ গেলাম, ওরা হিসেবে ১০০০ টাকা বেশি ধরে ছিল। দীপ কিছু বলতে না করলেও আমি গিয়ে বললাম্, কারণ ভুলটা ভুলই। সবাই এই ভুলটা ধরতেও পারবেন না। পেসেন্টকে দুপুরের আগে রিলিজ করে দিচ্ছে, অথচ ডাক্তারের সন্ধ্যার রাউন্ডের টাকা ধরে নিয়েছিল। ওদের ভুল দেখিয়ে দেওয়ার পর ১০০০ টাকা মাইনাস করল। বাবলি জারা কাঁথি গিয়েছিল, আজ রাজু গিয়ে নিয়ে এসেছে। দীপ আরও কয়েকদিন পরে ফিরবে। বাবলি বলল কলকাতার ফ্ল্যাটটা ওর ননদকে ১৫ লাখ টাকায় দিয়ে দিচ্ছে। জানতাম ফ্ল্যাটটা ওরা বিক্রি করে দেবে, তবুও কেন জানিনা মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতগুলো বছর ধরে সব আগলে রাখলাম, সাজিয়ে তুললাম। ওরা অসভ্যের মত তালা বদলে দিয়ে চলে গেল, একবার বলল না, কাকিমা আপনাদের কিছু থাকলে সরিয়ে নেবেন। অথচ ওর বাপি এসব জিনিস কিনে ছিল আমাদের আসা যাওয়া ও থাকার জন্য। দীপ বলছিল আমাদের কাছেও চাবি থাকবে। যাতে আমারাও প্রয়োজনে ব্যাবহার করতে পারি। তবে আমার এসব ভাবা উচিত নয়।। ওরা আমাদের ব্যবহার করার জন্য চাবি দেবে? আমি আশাও করি না। আমি কারো ওপর নির্ভরশীল নই। প্রয়োজনে কলকাতায় আশ্রয়টুকু রইল না, একা এই বয়সে হোটেলে ওঠা তো সম্ভব নয়, এটাই। অন্য কেউ কিনলেও তো একই অবস্থা হত। সেটাই ভেবে নেব।
বিকেলে স্নেহাশিস ফোন করে বলল আজ ওর বাড়িতে মিটিং আছে। ওখানেই রাতের খাওয়া। স্বপ্না কেও বলেছিল, ও বলেছে, ‘আমার হবে না, রোশেনারাদির বাড়ি যাব’। আমার তো মেয়ে-জামাইকে বাড়িতে রেখে যাওয়া সম্ভবই নয়।
ক্রমশ
0 Comments