কলকাতার প্রাচীনত্বের উৎস সন্ধানে
প্রসূন কাঞ্জিলাল
বাঙালির প্রাণের শহর আর ভারতের সিটি অফ জয় হচ্ছে এই আমাদের তিলোত্তমা কলকাতা শহর। কিন্তু এই শহরের রানী কলকাতার বয়স কত তা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব, সন্দেহ এবং কিছু তত্ত্ব ও তথ্যের প্রতি সমর্থন ও বিরোধিতাও রয়েছে। কলকাতার প্রাচীনত্ব নিয়ে ব্রিটিশ তথ্যসূত্র ও প্রাচীন কাব্য সাহিত্যে কলকাতার উপস্থিতি বেশ পরস্পর বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। একটু খতিয়ে দেখা যাক।
আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯০ সালে কলকাতার ৩০০ বছরের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করেছে মহা ধুমধাম করে। মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ ইতিহাসজ্ঞানে আমরা ইংরেজি শিক্ষিতরা প্রায় সকলেই জানি, ১৬৮৬-তে হুগলিতে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ব্রিটিশরা, মুঘল সরকারকে বকলমা দিয়ে ৩০০০ টাকার বিনিময়ে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে, এবং ১৬৯০-এ সুতানুটিতে বাণিজ্য কুঠি শুরু করেন জোব চার্নক। ১৬৯৮-এ সুবাদার আজিমুশ্বানের থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতার জমিদারি লাভ করে কিছুদিনের মধ্যেই বাকি দুই গ্রামের নাম কলকাতা নামক জনপদ গিলে ফেলে ঔপনিবেশিক কলকাতা শহর হিসেবে পরিচিত হয়।
ব্রিটিশ আর ব্রিটিশ-অনুমোদিত
নবজাগরণীদের প্রচারে কলকাতার বয়স যে মাত্র ৩২২, এটা জনগণ বিশ্বাস করে নিল। এই তথ্যই হয়ে উঠল পাঠ্যপুস্তকীয় সাধারণ জ্ঞান । উন্নয়ন বিকাশের স্তর নির্ধারিত হল ব্রিটিশ উদ্যোগে কলকাত৷ স্থাপনে। ২০০২-এর ক্লাইভ হাউসে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাটি খুঁজে পাওয়া জ্ঞানকে সরিয়ে রাখলে কি আমরা ধরেই নিতে পারি, ‘কলকাতা প্রতিষ্ঠাপক' ব্রিটিশ বাহাদুর এই ভূখণ্ডে আসার আগে কলকাতা নগণ্য গ্রাম ছিল? কলকাতার প্রাচীনত্বের আর কি কিছুই সহজ প্রমাণ নেই? তাহলে কেন আমরা হকারকারিগর-চাষিদের সংগঠন কলকাতাকে কয়েক হাজার বছরের পুরনো এশিয়াজোড়া সমৃদ্ধ রেশম পথের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দাবি করি? সেই প্রাচীনত্বের দাবি কি তাহলে ভুয়া?
না, ভুয়া তো নয়ই, বরং কঠোর বুনিয়াদনির্ভর ৷ অন্তত বাংলায় এবং বাংলানির্ভর সাহিত্যের উদাহরণে দেখাতে পারব যে, কলকাতার উল্লেখ আছে ব্রিটিশ পূর্ব সময়ের সাহিত্যেও।কলকাতার বয়স তিনশো নয় প্রায় পাঁচশো বছরের কাছাকাছি,তা প্রমানের তাগিদে তথ্য উন্মোচন পর্বে একে একে প্রবেশ করা যাক।
🍂
‘‘ডাইনে হুগলি রহে বামে ভাটপাড়া
পশ্চিমে বাহিল বোরো পূর্বে কাঁকীনাড়া৷
মূলাজোড় গাড়ুলিয়া বাহিল সত্বর
পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর।
চাঁপদানী ডাহিনে বামেতে ইছাপুর
বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর।’’
কে ছিলেন সেই রাজা? কোথায় চলেছিলেন তিনি? কিসের উদ্দেশ্যে? - রাজার নাম ছিল ‘চাঁদ’। তিনি রাজার মতন ধনী হলেও পেশায় ছিলেন ‘সওদাগর’। উপরের কবিতায় যাঁর কথা বলা হয়েছিল তিনি ছিলেন ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের সুবিখ্যাত নায়ক ‘চাঁদ সদাগর’। ‘চোদ্দডিঙা’ নিয়ে ‘ভাগীরথী’র ওপর দিয়ে ইনি চলেছিলেন বাণিজ্য করতে। ‘হুগলি’, ‘ভাটপাড়া’, ‘বোরো’, ‘কাঁকীনাড়া’, ‘মূলাজোড়’, ‘গাড়ুলিয়া’, ‘পাইকপাড়া’, ‘ভদ্রেশ্বর’, ‘চাঁপদানী’, ‘ইছাপুর’ পার হওয়ার পরে তিনি মাঝিদের বারবার আদেশ করেছিলেন ‘‘বাহ বাহ’’ বলে। ডিঙার বহরের গতি আরো বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই তাঁর সেই আদেশ ছিল। এরপরে -
‘‘বামে বাঁকিবাজার বাহিয়া যায় রঙ্গে
জমিন বাহিয়া রাজা প্রবেশে দিগঙ্গে।
পূজিল নিমাইতীর্থ করিয়া উত্তম
নিমগাছে দেখে জবা অতি অনুপম৷
চানক বাহিয়া যায় বুড়নিয়ার দেশ
তাহার মেলান বাহে আকনা মাহেশ।
খড়দহে শ্রীপাটে করিয়া দণ্ডবত
বাহ বাহ বলিয়া রাজা ডাকে অবিরত।
রিসিড়া ডাইনে বাহে বামে সুকচর
পশ্চিমে হরিষে রাজা বাহে কোননগর।
ডাহিনে কোতরং বাহে কামারহাটী বামে
পূর্বেতে আড়িয়াদহ ঘুসুড়ি পশ্চিমে।’’
এইভাবে বাইতে বাইতে মাঝিরা ‘চোদ্দডিঙা’ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল ‘কামারহাটী’, ‘আড়িয়াদহ’ আর ‘ঘুসুড়ি’ পার করে। এরপরে -
‘‘চিতপুরে পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা
নিশিদিসি বাহে ডিঙ্গা নাহি করে হেলা।
পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা
বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।
স্নান তর্পণ করি কৈল ইস্টিপূজা
পূজিল বেতাইচণ্ডী চাঁদো মহারাজা।’’
‘চাঁদ সদাগরের’ সঙ্গে ‘বেতোড়’ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, কলকাতায় এসে নেমে পড়লেই চলবে। কেন না, লেখার বিষয় হল কলকাতা। প্রশ্ন হল তখনকার কলকাতার মাটিতে পা রাখা যাবে কি? কারণ, ১৪৯৫ সালে ‘বাদুড়িয়া’র ‘বটগ্রাম’ নিবাসী কবি ‘বিপ্রদাস পিপলাই’ যখন ‘মনসাবিজয়’ কাব্যটি লিখেছিলেন, তখন কলকাতা নামে কোনো গ্রাম কিংবা শহরের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কি? উপরে উদ্ধৃত পদ্যের লাইনগুলি ‘বিপ্রদাস পিপলাই’য়ের লেখা 'মনসাবিজয়' কাব্যের অংশবিশেষ। কলকাতার প্রথম উল্লেখ এই গ্রন্থেই করা হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে, এতে উল্লেখ করা হয়েছিল এমন বেশ কিছু জায়গার নাম ‘প্রক্ষিপ্ত’, অর্থাৎ সেগুলো পরবর্তীকালে সংযোজন করা হয়েছিল। এমন কি ‘কলিকাতা’ নামটিও! তাঁদের কারোর কারোর যুক্তি হল, ‘বিপ্রদাসের’ ‘মনসাবিজয়ে’র যতগুলি পাণ্ডুলিপি এ-পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি পুরনো, সেটি খ্রীস্টিয় আঠারো শতকের প্রথম অর্ধের আগেকার নয়। কাজেই কলকাতাসহ বেশ কয়েকটি জায়গার নাম তাতে ‘প্রক্ষিপ্ত’ হওয়া সম্ভব। তাঁদের আরও যুক্তি হল, ১৪৯৫ সালে ‘বিপ্রদাস’ যখন কাব্যটি লিখেছিলেন, ‘নিমাই’ বা ‘চৈতন্যদেবের’ বয়স তখন ছিল মাত্র দশ বছর। কাজেই ‘বিপ্রদাসের’ কাব্যে উল্লেখিত ‘খড়দহের শ্রীপাট’ এবং ‘বৈদ্যবাটীর নিমাইতীর্থ’ সেসময়ে ‘বৈষ্ণবপীঠে’ পরিণত হয়নি। ‘শ্রীপাট’ এবং ‘নিমাইতীর্থ’ কেন প্রক্ষিপ্ত, সেটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ‘কলিকাতা’? ‘কলিকাতা’ কেন ‘প্রক্ষিপ্ত’ হবে? এবার একটু ‘কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্যের’পাতা ওলটানো যাক। তাতে লেখা আছে -
‘‘ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়
চিৎপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়৷
কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা
বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।
বেতাই চণ্ডীকা পূজা কৈল সাবধানে
ধনন্তগ্রাম থানা সাধু এড়াইল বামে৷
ডাইনে এড়াইয়া যায় হিজলির পথ
রাজহংস কিনিয়া লইল পারাবত।
বালুঘাট এড়াইল বেনিয়ার বালা
কালীঘাটে গেল ডিঙ্গা অবসান বেলা।’’
‘ধনপতি সওদাগর’ ‘ভাগীরথী’র ওপর দিয়ে বাণিজ্যতরী নিয়ে এগিয়ে চলেছিলেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর গন্তব্যস্থান ছিল ‘সিংহল’। সেসময় তিনি ‘ভাগীরথী’র তীরবর্তী যেসব জায়গা অতিক্রম করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে ‘কলিকাতা’ও ছিল। গ্রন্থের মধ্যে ‘মুকুন্দরাম’ নিজের যে ‘আত্মবিবরণী’ দিয়েছিলেন, তা থেকে জানা যায়, তিনি যখন সেটি লিখেছিলেন, তখন ‘মানসিংহ’ ছিলেন ‘গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ’। ১৫৯৪ সাল থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত ‘মানসিংহ’ ছিলেন ‘বাংলা-উড়িষ্যার সুবেদার’। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্যের’ রচনাকাল ছিল ১৫৯৪-১৬০৬ সাল। গ্রন্থটি পড়ে আরো জানা যায় যে, ‘আরড়ার রাজা’ ‘রঘুনাথ রায়ের’ পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সেটি লিখেছিলেন। ‘রঘুনাথের’ রাজত্বকাল ছিল ১৫৭৩-১৬০৬ সাল। তবে ‘মুকুন্দরামের’ দেওয়া ‘আত্মবিবরণী’টি কারোর কারোর মতে বিতর্কিত। কেউ বলছেন সেটি গোড়া থেকেই ছিল, আবার কেউ বলছেন সেটি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল। ‘মুকুন্দরামের’ জন্মস্থান ‘দামুন্যা’ গ্রামের নিকটবর্তী কোনো একটি গ্রামের জনৈক পণ্ডিত যেহেতু বলেছিলেন যে, ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্যের’ বেশ কিছু পুঁথি ঘেঁটেও গ্রন্থটির রচনার কাল-নির্দেশক শ্লোকটি তিনি দেখেননি, সেহেতু একজন নামকরা কলকাতা-গবেষক ‘কলকাতা বিচিত্রা’ গ্রন্থের লেখক ‘রাধারমণ রায়’কে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ‘‘চণ্ডীকাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে মৌন অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ।’’ বিষয়টি গোলমেলে। কারণ, ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্যের’ বহুসংখ্যক পুঁথির মধ্যে কিছু পুঁথি ‘দামুন্যা’ অঞ্চলের সেই পণ্ডিত মহাশয়ের হাতে এসেছিল এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ সেগুলিতে ‘রচনার কাল-নির্দেশক শ্লোক’টি তিনি দেখতে পাননি। অথচ সবাই জানেন যে, ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে হাতে লেখা পুঁথিই চালু ছিল। তখন একটি পুঁথি থেকে বহু পুঁথি নকল করা হতো। গ্রন্থকার পরে রচনার কোনো অংশের পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা পরিবর্জনের প্রয়োজন বোধ করলে সেটিও করতেন। তখন সেই পরেরটিই চালু হতো। অর্থাৎ সেটিকেই মূল পুঁথি হিসেবে গণ্য করা হতো। আবার অনেক সময় ‘নকলনবিসের’ ভুলের জন্যও রচনার কোনো অংশ বাদ পড়তো। কাজেই ‘দামুন্যা’ অঞ্চলের সেই পণ্ডিত মহাশয়ের হাতে যেসব পুঁথি এসেছিল, সেগুলিতে রচনার কাল-নির্দেশক ছড়াটি ছিল না বলে মূল পুঁথিতেও সেটি ছিল না, একথা বলা ঠিক নয়। কেন না, ‘কবিকঙ্কণের’ স্বহস্ত লিখিত পাণ্ডুলিপিটি আজ পর্যন্ত কেউ পাননি। কাজেই মূলের সঙ্গে মিলিয়ে অন্য পুঁথিগুলির শুদ্ধি-অশুদ্ধি নির্ণয় করা আজ সম্ভব নয়। যদি ধরেও নেওয়া যায়, ‘মুকুন্দরামের’ মূল পুঁথিতে রচনার কাল-নির্দেশক ছড়াটি ছিল না, সেটি পরে সংযোজিত হয়েছিল, তাতেই বা ক্ষতি কী? পৃথিবীর বহু প্রাচীন গ্রন্থেই তো সেগুলির রচনাকাল সম্পর্কে কিছু লেখা থাকে না। তাই বলে সেগুলির রচনাকাল নির্ধারিত হয়নি? তাহলে ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্যের’ রচনাকালের ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করা হবে কেন? আমাদের পূর্বপুরুষেরা ‘ইতিহাসবিমুখ’ ছিলেন বলে? ‘রচনার কাল-নির্দেশক শ্লোক’টি ‘মুকুন্দরামের’ মূল পুঁথিতে থাকুক বা নাই থাকুক, ‘মানসিংহ’ যখন ‘বাংলার সুবেদার’ ছিলেন, ‘মুকুন্দরাম’ তখন বর্তমান ছিলেন এবং তাঁর নামে প্রচলিত শ্লোকটি মূল পুঁথিতে ছিল না বলে ‘মুকুন্দরামের’ জীবনকাল এবং তাঁর ‘চণ্ডীকাব্যের’ রচনাকাল সম্পর্কে কাউকে মৌন থাকার পরামর্শ দান করা অবশ্যই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলতে হয়। ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এই কারণে যে, তাতেও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং সেই উল্লেখ সেই গবেষক-মহাশয়ের তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে সরাসরি ‘কলকাতা বিচিত্রা’ গ্রন্থের লেখক ‘রাধারমণ রায়ের’ বক্তব্যকে তুলে ধরাই সঠিক হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এজন্যেই তথ্যকে নস্যাৎ করার চেষ্টা! তিনি মন্তব্য করেছেন: ‘মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ সুনিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো না।’ এর মানে একটাই, ‘চণ্ডীকাব্যে’ উল্লিখিত ‘কলিকাতা’ নামটিও প্রক্ষিপ্ত হতে পারে। প্রক্ষিপ্ত তো অনেক কিছুই হতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক কথাই তো প্রক্ষিপ্ত! মানুষের জাতিত্ব পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত হয়! পিতৃত্ব তো প্রক্ষিপ্ত হয়েই থাকে! তাহলে নিছক সন্দেহের বশে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলের এবং মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের ‘কলিকাতা’-কে প্রক্ষিপ্ত বলে এত চিৎকার কেন? স্রেফ কলকাতার প্রাচীনত্বকে অস্বীকার করার জন্যেই নয় কি?’’
তবে ‘বিপ্রদাসের’ ‘মনসাবিজয়’ এবং ‘মুকুন্দরামের’ ‘চণ্ডীকাব্য’ ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থে কলকাতার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘আরাকানের’ ‘রোসাঙ্গ রাজসভা’র সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী কবি ‘আলাওলের’ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে কলকাতার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ‘আলাওলের’ জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার ‘ফরিদপুর’ জেলার অন্তর্গত ‘জালালপুরে’। ‘আরাকানরাজের অমাত্য’ ‘মাগনের’ আশ্রয়লাভ করার পরে তিনি ‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি লিখেছিলেন। সেটি আসলে ‘মালিক মহম্মদের’ লেখা হিন্দী কাব্য ‘পদুমাবৎ’-এর ভাবানুবাদ। তা সত্ত্বেও ‘পদ্মাবতী’-তে ‘আলাওল’ স্বপ্রতিভায় ভাস্বর। ‘পদ্মাবতী’-র রচনাকাল ১৬৪৫-৫২ সালের মধ্যে। ‘আরাকানে’ তখন রাজা ‘থদোমিন্তারের’ রাজত্বকালে। গ্রন্থটিতে কলকাতার উল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া কবি ‘কৃষ্ণদাসের’ ‘নারদপুরাণে’ও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন -
‘‘আপনি কনিষ্ঠ (ভ্রাতা) মোর রামকৃষ্ণ নাম।
সাকিম কলিকাতা বহুবাজারেতে গ্রাম।
দশ-দশ শত নিরানব্বই সালে।
মাহ জ্যৈষ্ঠ মাসে এই পুস্তক রচিলে।’’
১০৯৯ বঙ্গাব্দে (অর্থাৎ ১৬৯২ খ্রীষ্টাব্দে) যখন ‘নারদপুরাণ’ রচিত হয়েছিল, তখন কলকাতা ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে ‘বহুবাজার’ গ্রামের উল্লেখ বিভ্রান্তিকর। ১৬৭৯-৮০ সালে রচিত ‘সনাতন ঘোষালের’ ‘ভাষা-ভাগবতে’ লেখা হয়েছিল -
‘‘কলিকাতা ঘোষালবংশে কৃষ্ণানন্দ।
তাঁর পুত্র ভুবন বিদিত রামচন্দ্র৷
তাঁহার মধ্যমপুত্র করি শিশুলীলা।
ভাষা-ভাগবত বিদ্যাবাগীশ রচিলা।’’
এই গ্রন্থেও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কৃষ্ণরামদাস’ রচিত ‘কালিকামঙ্গল’ (১৬৭৬-৭৭ খ্রীঃ) পুঁথিতেও কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। তাতে আছে -
‘‘অতি পুণ্যময়ধাম সরকার সপ্তগ্রাম
কলিকাতা পরগণা তায়। ...’’
এবার দেখা যাক ইংরেজি নথিপত্রে কবে থেকে কলকাতা বা ‘ক্যালকাটা’ নামটা লেখা হয়েছিল। কয়েকজন নামকরা কলকাতা-গবেষক মনে করেন, কোম্পানির চিঠিপত্রের মাথায় ‘ক্যালকাটা’ নামটা প্রথম জায়গা পেয়েছিল ১৭০০ সালের ৮ই জুন তারিখে। কিন্তু চিঠিপত্রে ‘ক্যালকাটা’ নামটার প্রথম উল্লেখ কবে হয়েছিল? এ-পর্যন্ত আবিষ্কৃত তথ্যাদি থেকে জানা যায়, ১৬৮৮ সালের ২২শে জুন তারিখে ‘চার্লস আয়ার’ এবং ‘রজার ব্র্যাডিল’ ‘ঢাকা’ থেকে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তাতেই ‘ক্যালকাটা’র প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া ১৬৮৯ সালের ৯ই জুলাই তারিখে তাঁরা ‘মাদ্রাজে’ বসবাসকারী কোম্পানির তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তাতেও ‘ক্যালকাটা’র উল্লেখ ছিল। ১৬৯০ সালে কলকাতায় আসার আগেই ‘জোব চার্নক’ কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কেন না, ‘ক্যাপ্টেন হিথের’ ১৬৮৯ সালের ৩রা মার্চ তারিখের ‘চট্টগ্রাম অভিযান’ ব্যর্থ হওয়ার পরে ১৬৮৯ সালের ২২শে মার্চ তারিখে সেই বিষয়ে লিখতে গিয়ে ‘চার্নক’ ‘ক্যালকাটা’র উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া দেখা যায়, ‘ক্যাপ্টেন হিথ’ও তাঁর ১৬৮৮ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখের একটি রিপোর্টে ‘ক্যালকাটা’র উল্লেখ করেছিলেন। দু’জনেই তাঁদের রিপোর্টে ‘ক্যালকাটা’ নামটি তিনবার করে লিখেছিলেন। ‘ক্যালকাটা’ নামটি প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখা হয়েছিল ১৭২৬-২৭ সালে প্রকাশিত ‘আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের’ ‘এ নিউ অ্যাকাউন্ট অব দি ইস্ট ইন্ডিজ’ গ্রন্থে। এরও আগে ১৬৬০ সালে তৈরি ‘ভ্যান ডেন ব্রুকের’ মানচিত্রে কলকাতার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ১৬৬২ সাল থেকে ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত ‘ভ্যান ডেন’ ছিলেন ভারতে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র কর্ণধার। তবে ‘ভ্যান ডেনের’ মানচিত্রে কলকাতা এবং সুতানুটি সম্বন্ধে অনেক ভুল তথ্য আছে। সেটি ছাপা হয়েছিল তৈরি হওয়ার অনেক পরে। সম্ভবতঃ তখনই ভুলভ্রান্তিগুলো হয়েছিল। কিন্তু এজন্য ‘ভ্যান ডেনের’ মানচিত্র এবং কলকাতার উল্লেখকে বাতিল করা ঠিক নয়। একটি ছেলে জন্মালো, কিন্তু তাঁর জন্মের অনেক পরে সে যখন বড়ো হলো, তাঁর চরিত্রে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢুকলো, এই অজুহাতে তাঁর জন্মকে কি কেউ বাতিল করতে পারেন? ‘ফারসী’তে কলকাতার প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ‘আবুল ফজলের’ লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে। সেটি হচ্ছে ‘আকবরনামা’ নামক ‘মোঘল ইতিহাস’ গ্রন্থের তৃতীয় এবং শেষ খণ্ড। ‘আকবরের’ রাজত্বকালের মোঘল সাম্রাজ্যের অনেক কথা তাতে লেখা আছে। সেটি লেখা হয়েছিল ১৫৮৫-১৫৯৬ সালে। ১৫৮২ সালে ‘রাজা টোডরমলের’ আদেশে সমগ্র বাংলাকে জরিপ করে ‘ওয়াশিল-ই-জমা তুমার’ নামে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সেই তালিকাটি ‘আবুল ফজল’ তাঁর গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তাতেই কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘জোব চার্নক’ কলকাতায় আসার অনেক পরে ১৭৮৬ এবং ১৮০৮ সালে ‘ফারসী’ ভাষায় লেখা আরো দুটি গ্রন্থে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তাতে কলকাতা নামের জায়গাটির নামকরণের ব্যাখ্যাও আছে। গ্রন্থ দুটির নাম ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ এবং ‘আকবর-ই-মুহব্বৎ’। গ্রন্থ দুটির লেখকরা হলেন যথাক্রমে ‘গোলাম হোসেন সেলিম’ এবং ‘মুহব্বৎ খাঁ’। তবে ‘ফারসী’ ভাষায় ‘কলকাতা’ নামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উল্লেখ পাওয়া যায় ‘কলকাতা বিক্রির দলিলে’। আশ্চর্যের বিষয়, সেটিও কারোর কারোর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল! ১৬৯৮ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখে ‘সাবর্ণ চৌধুরী’রা ‘কলকাতা’, ‘সুতানুটি’ আর ‘গোবিন্দপুর’ এই তিনখানা গ্রামের ‘প্রজাস্বত্ব’ বিক্রি করে দিয়েছিলেন ইংরেজদের কাছে। সেসময় তাঁরা যে ‘বিক্রি-কবলা’ বা ‘বায়না-নামা’ লিখে দিয়েছিলেন, তাতে কলকাতার স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। বর্তমানে সেই দলিলটি রাখা আছে ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে’। তাতে সই আছে ‘কাজী’ এবং বিক্রেতাদের। দলিলটির নথিনম্বর হচ্ছে ৩৯। সেটি যে অতিরিক্ত পাণ্ডুলিপিতে রাখা আছে, তার নম্বর হচ্ছে ২৪০৩৯।
এসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়, ইংরেজরা কলকাতায় আসার অনেক আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। তবে তার রূপ ছিল এখনকার কলকাতা থেকে ভিন্ন। তার চরিত্রও ছিল আলাদা।
তথ্যসূত্র:
১- Calcutta In The Nineteenth Century: An Archival Exploration, Bidisha Chakraborty.
২- Interesting History of Kolkata aka Calcutta, Emily Stehr.
৩- কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়।
৪- A New Account of the East Indies: Being the Observations and Remarks of Capt. Alexander Hamilton, Cambridge Library Collection, Perspectives from the Royal Asiatic Society.
৫- কলকাতার সৃষ্টি ও জব চার্নক, শ্রী পি টি নায়র।
৬- কলকাতা: এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, ডঃ অতুল সুর।
0 Comments