লোকমাতা রানি রাসমণি —১০
সুমিত্রা ঘোষ
রানির স্বাভাবিক স্বভাবগুণে শ্বশুরবাড়ির সকলে তাকে খুব ভালোবাসত। তাছাড়া তার আগমনের পর প্রীতরাম দাসের ফ্যামিলি ক্রমশ আর্থিক দিক থেকে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। প্রকৃত উন্নতি হতে থাকে। সে কারণে জমিদার বাড়ির প্রতিটি সদস্য রানিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। সকলে মনে করতেন রানি রাসমণির জন্য মাড়ু বাড়ির এত বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে। কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে প্রীতরাম দাস বৌমার পরামর্শ নিতেন। রানি রাসমণিও প্রীতরাম দাসকে পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও যথেষ্ট আদর-যত্ন সহকারে পরিচর্যা করত। প্রীতরাম দাস যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তার পরিবারের কারুর সাহস হয়নি রানিরকে কোনো দোষত্রুটি ধরে কটু কথা বলার।
রানি রাসমণির স্বামীভাগ্য যথেষ্ট ভাল ছিল। রানি নিজেই বলেছেন তিনি দেবতার মত স্বামী পেয়েছেন রাজচন্দ্র প্রীতরামের স্বভাব ও গুণ দুটিই পেয়েছিলেন। রাজচন্দ্র অত্যন্ত কর্মকুশল, সৎ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি আধুনিক মনস্ক ছিলেন। পরিবর্তিত যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে জানতেন, যেমনটা সে যুগে দরকার ছিল।
সমস্ত সদগুণের অধিকারী রাজচন্দ্র দাসকে ঈশ্বর আর একটা দিকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন যা সকলে পায় না। যেমন তাঁর স্ত্রী রানি রাসমণি স্বামীর পরিপূরক হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নয়তো অতি অল্প বয়সে জমিদার বাড়ির বধূ হয়ে এসে জমিদারির ব্যাপারে স্বামীকে পরামর্শ দেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। বুদ্ধিমতী ভার্যা রানিকে পেয়ে রাজচন্দ্র উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগোতে লাগলেন। এ ব্যাপারে রাজচন্দ্রের জীবনে প্রতিভামুখী স্ত্রীর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। সেসব ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে।
১৮০৩ সালে ৮ বৈশাখ রানি রাসমণি জানবাজারে জমিদারবাড়ির বধূ হয়ে এসে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি সাধনের চেষ্টা করেন। তাঁর স্পর্শে সবই শুভ হতে থাকে।এমনই এক ভরভরন্ত সংসার থেকে বিদায় নিলেন প্রীতরাম দাম (ইং ১৮১৭ সালে) । তখন রাজচন্দ্র পরিণত বয়সের যুবক।
🍂
প্রীতরাম দাস যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তখন জানবাজারে শুরু হল নতুন যুগ। সময়টা ১৮১৭ সাল। পিতার মৃত্যুর পর রাজচন্দ্র দাস পরিবার ও ব্যবসার কথা ভেবে ভেঙে পড়েননি। রাজচন্দ্র অমায়িক, অত্যন্ত- বুদ্ধিমান, বদান্য ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে সকলের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। গৃহে স্ত্রীর সাহচর্য তাঁকে সদা-সর্বদা নিশ্চিন্ত রাখতো।সে যুগে ধনী লোকেদের মধ্যে কেউ কেউ অহংকারী হলেও রাজচন্দ্র দাসকে সে দোষে দোষী করা যায় না। তিনি সকলের সঙ্গে মেলামেশা করেও নিজের আভিজাত্য ও স্বাভাবিক আচরণ কখনও ত্যাগ করেননি। এটাই রাজাদের বিশেষত্ব। সে যুগে রাজচন্দ্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর সতীদাহ প্রথার অনেককিছুর সাক্ষী হয়েছেন রাজচন্দ্র দাস। সেকালে ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের অন্যায়, ঔদ্ধত্য ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে রাজা রামমোহন রায় ও রাজচন্দ্র দাসের পরিবারকে। ইতিহাসে সব বৃত্তান্ত লেখা থাকে না।
রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, অক্রুর দত্ত প্রমুখ উচ্চপদস্থ কিন্তু বিত্তশালীরা রাজচন্দ্র দাসের বন্ধু ছিলেন। এই সমস্ত বাঙালি বন্ধু ছাড়া বিদেশী সাহেবদের মধ্যে লর্ড অকল্যান্ড এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অন্যতম অভিজাত অংশীদার জন বেব রাজচন্দ্র দাসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তৎকালীন হুক ডেভিডসন অ্যান্ড কোম্পানীর মুৎসুদ্দি রামরতনবাবু রাজচন্দ্র দাসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। রামরতনবাবুর অনুরোধে রাজচন্দ্র একরার হুক ডেভিডসন এন্ড কোম্পানীর মালিককে এক লক্ষ টাকা ঋণ দিতে রাজি হয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে রাজচন্দ্র দাস যেদিন কথা দিলেন তার পরে দিনই জানতে পারলেন সাহেব দেউলিয়া হয়ে গেছেন। রাজা কিন্তু পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে ঐ কোম্পানীকে ঋণ দিয়েছিলেন।
রাজচন্দ্রের ব্যবসায় মাথা প্রীতরামেরর চেয়ে আরও স্বচ্ছ ও উর্বর ছিল; আরও আধুনিক, পরিবর্তিত যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতেন রাজচন্দ্র দাস। সত্যবাদিতা এবং কথা দিয়ে কথা রাখা রাজচন্দ্র দাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন হুক ডেভিডসন অ্যান্ড কোম্পানীকে যেহেতু কথা দিয়েছিলেন তাই কোম্পানীর দেউলিয়া হওয়া সত্ত্বেও ঠিক সময়ে এক লক্ষ টাকা পৌঁছে দেন।
ক্রমশ
0 Comments