জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব - ৮/গৌতম বাড়ই

চিত্র-চন্দিমা ঘোষ

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব - ৮
গৌতম বাড়ই 

এ নদীর শরীরে তিরতিরে সরু জলের ধারা। পাড়ে শাল, শিমূল, বাবলা, অর্জুন, কাঁটাঝোপের জঙ্গল। চাঁদের ঐ পোড়া আলোয় চিকচিক করছে নদীচরের বিছানা। অশ্বারোহী আগন্তুক চেয়ে আছে বসন্তসেনার দিকে। ঘোড়ার মুখ মাটির দিকে। কুহক ডেকে উঠলো অন্ধকার বনাঞ্চলে। কুহকের ডাক যেমন ভারী মিষ্টি, আবার মনেও ভয় ধরায়। অন্ধকার হলেও, আকাশের নীলবর্ণ স্পষ্ট। ওটা কী মনের গভীরে আঁকা থাকে বলে আমরা দেখি? সাদা মেঘেরা এখন ডানা মেলে উড়ছে। আড়াআড়ি পুবকোণ থেকে পশ্চিমে। কি আশ্চর্য! অশ্বারোহী হাত তুলে ডাকছে বসন্তসেনাকে। বসন্তসেনা ক্রমশ ঘুমিয়ে পড়ছে সুসীমার ভেতর। আগন্তুক বলছে- " তোমার জন্য আমি অনন্ত পথ চেয়ে বসে রয়েছি প্রিয়তমা। এই জঙ্গলাকীর্ণ প্রান্তর আমাদের মধুমিলনের স্থান। এসো--এসো- তবে। " - এই বলে সেই অশ্বারোহী পুরুষ, তার লোমশ প্রশস্ত বুক খুলে ঘোড়া থেকে ঝপ করে নেমে এই প্রকৃতিতে মেলে ধরে। বসন্তসেনা সেই নাম না জানা রাঢ়ের নদীর ধারে। তিরতির বইছে জলধারা, আর সর্বাঙ্গ কাঁপছে বসন্তসেনার অবয়বে এখন সুসীমার। তিরতিরে নদীর জলে দূর্বার স্রোত এলো,সহসা সেই স্রোতের লয় ধীর হয়ে আসে। বসন্তসেনা জেগে ওঠে যেন আবার। নিঝুম রাতে একা-একটি গাড়ি ছুটে গেল পথের ওপর। তারপর সেই শব্দ শূন্যতায় মিলিয়ে যায়। অঙ্কুশ- কে মনে পড়ে গেল তার। 

অঙ্কুশ তার সহকর্মী। প্রথমদিন অফিসে এসেই, বসন্তসেনাকে তার ডিপার্টমেন্টের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ডিপার্টমেন্টাল চিফ ম্যানেজার সজ্জন ভার্গব। তাদের মধ্যে ঋষিতা আর অঙ্কুশের সাথে এই অল্প কদিনে বসন্তসেনার অন্তরঙ্গতা বেশ জমেছে, এখন যাকে ঐ জমে ক্ষীর হওয়া বলে। বাদবাকি বেশিরভাগকে ওভার স্মার্ট বা একটু আজকালের নয়া ফ্যাশনে শো-অফ করা বলে, তাই। মুখে কিছু আটকায় না, আর এত যে বেশি-বেশি কথা বলে তারা, তার মধ্যে একদম সারবত্তা নেই, গভীরতা নেই। বরং অঙ্কুশ-কে ওদের সামনে আপাতভাবে দেখলে ক্যাবলা মনে হয়। ঋষিতা আগরওয়াল মেয়েটিও অল্পদিনেই বসন্তসেনার ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে।
আজ তবে অঙ্কুশ- কে কেন মনে পড়ল তার? 

প্রথমে পরিচয় করিয়ে দেই আরও একটু ছেলেটির। অঙ্কুশ সরকার। একদম সাদামাটা ছেলে, এখনও মফস্বলী ছোঁয়া আছে চোখে- মুখে তার। অনেকের মাঝে নিষ্প্রভ, আবার মনের গুটিকতক পছন্দের মানুষের কাছে সে উজ্জ্বল। তার বলা কথা, হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া ক্ষণিকের আনন্দ দান করে না, রেশ থেকে যায় মনে। বসন্তসেনার কাছে অচিরে সে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠল এই অল্প কয়েক মাসের মধ্যে। বাদবাকিরা যেমন হয়, হতে পারে, তেমনি। কলিগ, শুধু এই একমাত্র পরিচয়ে বেঁচে আছে তারা বসন্তসেনার কাছে। এই কর্পোরেট সংস্থা ছেড়ে অন্যত্র নতুন কোন কাজে যোগদান করলে এদের সাথে পাকাপাকিভাবে সম্পর্কে ছেদ ঘটবে তার, এ ভালোমতন জানে, কিন্তু ঋষিতা আর অঙ্কুশের সাথে হয়ত সম্পর্ক থেকে যাবে অনেককাল। যেমনটি স্কুল-কলেজে দু-চারজনের সাথে এখনও আছে। অঙ্কুশের কথা মনে পড়ছে তার এই গভীর কালো রাতে।
🍂

অঙ্কুশ বলেছিল- "ঋগ্বেদকে আমাদের সাহিত্যের আদি রচনা বলবার পিছনে কারণ কী জানিস? মানুষ, প্রকৃতি ও ঈশ্বরকে নিয়ে কবিরা চিরকাল আবেগ, অনুভূতি, বিস্ময় দিয়ে গড়ে তুলেছেন ভাব ও রূপের জগৎ। ঋগ্বেদে রাত্রির উদ্দেশ্যে রচিত এ সূক্ত, কবির অনুবাদে, বাংলা ভাবান্তরে বলছি, শোন----

রাত্রি এসেছেন, চারিদিকে ঘিরেছে অন্ধকার
আকাশ উজ্জ্বল তারায় তারায়
চারিদিক দেবরূপী রাত্রির বিস্তার 
যারা নীচে, যারা ঊর্ধ্বে
সবই ঢাকা পড়েছে রাত্রিতে 
দূরীভূত হয়ে গেছে সব অন্ধকার ---
আমরা নিরাপদে নিজেদের বিছানায়
শুভ হোক এই রাত্রি, শুভ হোক তার আগমন"
 
আহা! কী সুন্দর সেই রাত্রির বর্ণনা। মনে- মনে আবৃত্তি করে ওঠে বসন্তসেনা। জানে না, কোথা থেকে এ সংগ্রহ করে শুনিয়েছিল অঙ্কুশ। রাতের এই গভীরতায় সে এক- একদিন এমনিভাবে সুসীমা হয়ে ওঠে। সেই অশ্বারোহী সামনে এসে দাঁড়ায়। আরও কেউ এসে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। বসন্তসেনা আবেগে- আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। এই ঘন কালো তমসা থেকে জায়মান হয় এক নতুন  ঊষার। 

প্রথম মাসের স্যালারী পেয়ে ঋষিতা আর অঙ্কুশের সাথে আরও দুজন ঘনিষ্ঠ কলিগকে বসন্তসেনা মধ্য কলকাতার এক নামীদামি হোটেলের রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিয়েছিল। স্কচ হুইস্কির সাথে ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই , চিকেন পাকোড়া, চিজবল দিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের সেই রাতের পার্টি। সুশোভনবাবু চিরকাল উদারমনস্ক আর ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যে  বিশ্বাসী। বাবাকে আগাম বলে রেখেছিল আজকের রাতের পার্টির কথা। সুশোভন শুধু বলেছিল - " সাবধানে থাকিস আর বেশি রাত করিস না মা। কোনও জরুরী প্রয়োজন পড়লে তুই ফোন করিস আমাকে, আমি কিন্তু ফোন করে তোর আনন্দ মজায় ব্যাঘাত ঘটাবো না।"

একটু রাত করেই ফিরে ছিল সে। বসন্তসেনার বাবা, না খেয়ে- দেয়ে তখনও বই পড়ে চলেছিল । আসলে তার বাবার এ এক স্নেহের আবরণে নিজেকে ঢেকে রাখা। বিশেষত, তার মা মারা যাবার পর , সুশোভনবাবু মেয়ের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী। বসন্তসেনাকে আঁকড়ে ধরে সে বাঁচতে চায় বাদবাকি জীবন। তিনি যে খাননি, তা দুশ্চিন্তা থেকে। বইপড়া কে নিছক ঢাল করে দুশ্চিন্তা নিয়ে মেয়ের অপেক্ষায় ছিল। মেয়ে ঘরে ফিরতেই খেতে বসবার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। 

বসন্তসেনা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে এসে বাবার সাথে ডিনার টেবিলে বসলেন, বাবাকে সঙ্গ দিলেন খাওয়ার সময়, নিজে তো খেয়ে এসেছে আজ। রাতের শিফটে জরুরী প্রয়োজনে ডিউটি না থাকলে বাবাকে খেতে দেওয়ার তদারকি সে নিজেই করে, মা দীপশিখা চলে যাওয়ার পর থেকে। সুশোভনবাবু বললেন- " হাসনু- মা, এই মদ্যপান করে উৎসব আনন্দ, বিশেষ কোনদিন উদযাপন করা অপরাধ কিছু নয়, আমাদের বৈদিক যুগে এর ভুরি- ভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়। সোমরস পান করবার কথা আমরা প্রত্যেকেই প্রায় জানি। আমাদের আদিবাসী সমাজে, যারা এখনও কিছু টোটেম আর ট্যাবু ধরে রেখেছেন, আমাদের হাজার - হাজার বছরের আদি ভারতের চিরন্তন ধারা যাদের মধ্যে এখনও প্রবাহিত, তাদের জীবন ধারায় আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার এক প্রধান উপকরণ এই মদ্যপান, প্রকৃতির থেকেই আরোহন করা। মহুয়া তাদের জীবনরসে আনন্দ উপকরণ।দেখিস না, মহুয়ার নেশায় মাতাল হয় কেমন তারা। একবার পুরুলিয়ার আনাড়ার ঐ দিকে অমন এক গ্রামে আমি ছিলাম, যেখানে প্রতি রাতে মাদলের সাথে বাতাসে ভেসে আসতো মহুয়া ফুলের গন্ধ। আমিও খেয়েছি। ঢুলুঢুলু চোখ তুলে রাতের আলো- অন্ধকারে অপূর্ব এক পৃথিবীর রূপ দেখেছিলাম। সেদিন রাতের আকাশে ছিল শুক্লপক্ষের এক সরু টুকরো ফালি চতুর্থীর চাঁদ।
দ্রিম- দ্রিম- দ্রিম, এখনও বুকে কাঁপন তুলে যায়। তুমি মা, আজকের আনন্দময় রাতে মদ্যপান করে উদযাপন করেছ তোমার প্রথম চাকুরী জীবনের রোজগার করা টাকা দিয়ে সহকর্মীদের সাথে, এর জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবো না। এতে দোষের কিছু নেই। "

বাবার বলা শেষের কথাগুলি , তাকে অনেক উজ্জ্বল করে দিল। বসন্তসেনা ভাবে, জীবনে সে সত্যি ভাগ্য করে এমন বাবা পেয়েছিলো, আর মা'ও পেয়েছিলো। আবার সেই ভাগ্যের থেকে অদৃষ্ট তার মাকে কেড়ে কিছুটা ভাগ্যহত করেছে। 

বাবা জিগ্গেস করলেন - " হ্যাঁরে, অঙ্কুশ ছেলেটিকে তোর কেমন লাগে? কেমন লাগে বলতে, একজন মেয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ছেলেকে দেখা? 

- " একটু ক্যাবলা ধরনের, তবে বেশ সাউন্ড ছেলে।নিজের পাঠ্য- বইয়ের বাইরে পড়ার পরিধিটি বিরাট। থট বা ভাবনা বেশ পরিষ্কার। বন্ধু হিসেবে সে ভীষণ ভালো, সিমপ্যাথেটিক। নিজস্ব মতামত আছে। স্বার্থহীন একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সে মেশে সবার সাথে। আফটার অল বেশ ভালো। প্রকৃত বন্ধু যাকে বলে। " 

সুশোভন বললেন- " তোর খুঁটিয়ে দেখাটা, এই মানুষকে, খুব ভালো লাগলো। আর ঋষিতা বলে মেয়েটি? তোর আর একজন সহকর্মী বা প্রিয় বন্ধু, তাকে তুই কতটা চিনিস বা কেমন লাগে? " 

বসন্তসেনা বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন- " সে'ও ভালো বন্ধু, তবে কনজারভেটিভ ফ্যামিলিতে বর্ন এন্ড ব্রটআপ বলে , সবকিছু এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি মন থেকে, ঐটুকু ঝেড়ে ফেলতে পারলে আরও নিখুঁত বন্ধু সে। তবে অঙ্কুশ, দি বেস্ট ফ্রেন্ড অফ মাইন।"

- "আমি দু-জনাকেই দেখেছি, কথা বলেছি। তোর পর্যবেক্ষণ বেশ  ভালো। আর তুই তো আর আমার মতন কিছুক্ষণের জন্য দেখিসনি, সারাদিনের ব্যাস্ত সময় ওদের নিয়েই কাটাস, আড্ডাও নিশ্চয় হয়।" -- এই বলে আজকের রাতের কথায় ইতি টানলেন সুশোভন। 

বাবার ঘরে আলো নিভিয়ে দিয়ে, বাবাকে গুডনাইট করে বসন্তসেনা আজ আর  ব্যালকনিতে দরজা খুলে গেলেন না, অন্ধকারে তার প্রিয় চেয়ারে বসে রাত্তিরটাকে উপভোগ করতে। এত জোরে- জোরে হাই উঠছে, বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন। প্রবল  ঘুম পেয়েছে তার। 

এইভাবেই এক- একটা দিন ইতিহাস হয়ে যায়। বসন্তসেনা ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল আরো গভীরে। প্রতিটি দিন যেমন একটি করে রাতের জন্ম দিয়ে যায়, আবার প্রতিটি রাতের শেষে নতুন একটি ঊষার জন্ম। এইভাবেই বহে চলে সময়চক্র। সেই আড়াই হাজার বছর আগের সুসীমা থেকে এখনের বসন্তসেনা, সময়ের নিমিত্তে তা এক পল মাত্র। 
ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments