জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৬
ছেঁদাপাথর: ক্ষুদিরামের গুপ্ত বন্দুক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সূর্যকান্ত মাহাতো
ছেঁদাপাথর। ক্ষুদিরাম বসুর বৈপ্লবিক চারণভূমি। আবার বিপ্লবীদের গুপ্ত বন্দুক প্রশিক্ষণ ঘাঁটিও। এখানেই নির্জন এক স্থানে বিপ্লবীদের বন্দুক প্রশিক্ষন দিতেন ক্ষুদিরাম। বাঁকুড়া জেলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই জায়গা। বারিকুল থানার অন্তর্গত। ফুলকুশমা থেকে বারিকুল যাওয়ার পথেই পড়ে জায়গাটি।
প্রশ্ন হল, ছেঁদাপাথরকেই কেন বন্দুক প্রশিক্ষণের এমন একটি গোপন ঘাঁটি রূপে নির্বাচন করা হয়েছিল? কারণ, এই উত্তরের পিছনে আছে একজন বিখ্যাত জমিদারের ভূমিকা। নাম 'দিগম্বর নন্দ'। তিনি মুগবেড়িয়ার কেবল সুবিখ্যাত জমিদারই ছিলেন না। একজন আদর্শ দেশভক্ত মানুষ ছিলেন। গুপ্ত সমিতিগুলোকে তিনি বেশ কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। কতবড় দেশভক্ত মানুষ ছিলেন সেকথা লেখক ও একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত উকিল হিসাবে পরিচিত 'ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র' সেটা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, "দিগম্বর বাবু ঐ অঞ্চলের স্বদেশী প্রচার ও বিলাতি বর্জনের প্রধান পান্ডা ছিলেন।"(শহীদ ক্ষুদিরাম/ শ্রী ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৮৮) তো এই দিগম্বরবাবু ছেঁদাপাথরের ভৌগোলিক অবস্থান, নির্জনতা ও বৈপ্লবিক কাজকর্মের উপযুক্ত ছিল বলেই এই স্থানটিকে নির্বাচন করেছিলেন। সুদূর মুগবেড়িয়ার এক জমিদারের সঙ্গে বারিকুলের এই ছেঁদাপাথরের যোগসূত্র তৈরি হওয়ার মূল কারণ হল, এই ছেঁদাপাথর তখন তাদেরই সম্পত্তি ছিল। তাই বহুবার কাজের সূত্রে তিনি এখানে আসায় জায়গাটির গুরুত্ব বুঝেছিলেন। তাছাড়া লেখক 'ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র' তো আরো পরিষ্কার ভাবে বলেই দিয়েছেন, "সেখানে(ছেঁদাপাথর) পুলিশ বা সব-সাধারণের গতিবিধির সুবিধা ছিল না; সুতরাং তথায় গুপ্ত সমিতির অস্ত্র-শস্ত্র ও অন্যান্য বহু জিনিস লুকাইয়া রাখা সহজ হইত।(শহীদ ক্ষুদিরাম/ শ্রী ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৯০)
এবার সবথেকে বড় করে যে প্রশ্নটা উঠে আসে তা হল, ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গে ছেঁদাপাথরের যোগসূত্র কীভাবে রচিত হয়েছিল? সেই উত্তরের পিছনেও আসল কারিগর কিন্তু ঐ দিগম্বরবাবুই। তার মধ্য দিয়েই ক্ষুদিরামের ছেঁদাপাথরে আসা। সেটাই বা কীভাবে হয়েছিল, তার উত্তর পেতে হলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। তার বিপ্লবী গুরু সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে সংগঠনকে আরো প্রসারিত করতে ও প্রচার করতে কাঁথি, তমলুক ও উড়িষ্যার সংগঠকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। (শহীদ ক্ষুদিরাম/ ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৮৫) তাই ভগবানপুর থানার ইক্ষুপত্রিকা গ্রামের ক্ষীরোদ নারায়ন ভুঁঞা এবং কিশোরপুর গ্রামের আশুতোষ দে-কে সঙ্গে নিয়ে সেই মহান দায়িত্ব পালনে বেরিয়ে পড়েছিলেন।(ক্ষুদিরাম/ শৈলেশ দে, মানিক মুখোপাধ্যায়, সৌমেন বসু, পৃষ্ঠা- ৪৪) এই কাজের মধ্যে যেগুলো ছিল প্রধান সেগুলো হল, ব্যায়ামের আখড়া তৈরি করা, উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য চর্চার পাশাপাশি চরিত্র গঠন। 'বঙ্গ-ভঙ্গ' ও বিলাতি দ্রব্য বর্জন নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং মেদিনীপুরের দিকে দিকে যে সব গুপ্ত সমিতিগুলো গড়ে উঠে ছিল তাদের জন্য অর্থ সংগ্ৰহ করা। কেমন ছিল সেই প্রচার তা 'সবং' থানার 'বেলচি' গ্রামের 'সর্বেশ্বর মাসান্ত' মহাশয় ১৯৪৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, "মাননীয় ক্ষীরোদবাবু, আশুতোষ দে ও ৺ক্ষুদিরাম বসু তৎসময় আমার বাড়িতে ঐ সব আন্দোলন যাহাতে ভালোভাবে চলে সেই উদ্দেশ্যে নিজেরা হাট বাজারে গিয়া সর্ব সাধারণকে বুঝাইয়া ছিলেন এবং উহাদের নিকট যে সঙ্গীত পুস্তক ছিল তাহার একখানি আমাদিগকে দিয়া যান। উহা ইংরেজ বিদ্বেষ ও উত্তেজনায় পূর্ণ।...তাঁহার প্রভাবে আমরা এই অঞ্চলের বহু স্থানে সহজে কর্ম কেন্দ্র ও ব্যায়াম চর্চার আখড়া স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম।"(শহীদ ক্ষুদিরাম/ শ্রী ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৮৮)
সেই উদ্দেশ্যেই তারা মুগবেড়িয়াও এসেছিলেন। তারা দিগম্বরবাবুর বাড়িতেই উঠেছিলেন। কলকাতা, মেদিনীপুরের একাধিক বিপ্লবী অবাধে তার বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন। দিগম্বরবাবু যদিও মেদিনীপুরে ক্ষুদিরামের সঙ্গে এর আগেই পরিচিত হয়েছিলেন। ক্ষুদিরামের সাহস, কর্মশক্তি ও দেশভক্তিকে উনি শ্রদ্ধা করতেন। মুগবেড়িয়াকে কেন্দ্র করে এরকম একাধিক কর্মশালা চলতে লাগল। দিনের বেলা প্রচার কাজ, আর সন্ধ্যা নামলেই ব্যায়াম চর্চা, লাঠি, ছোৱা ও তরবারির খেলা।(শহীদ ক্ষুদিরাম/ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৮৯) কিন্তু কেবল লাঠিখেলা, ছোরা আর তরোয়াল দিয়ে যে ইংরেজদের বন্দুকের মোকাবিলা সম্ভব নয় সেটা দিগম্বরবাবুও জানতেন। তাই তার মনে হয়েছিল ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে হলে বন্দুকের মতো অস্ত্র শিক্ষাও বিপ্লবীদের দরকার। "সেই উদ্দেশ্যেই দিগম্বরবাবু বিপ্লবীদের বন্দুক চালানো শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাঁকুড়ার ফুলকুশমা নিকটবর্তী ছেঁদাপাথার গ্রামে তাদের কাছারি বাড়িটি ক্ষুদিরামের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিলেন। কাছারি বাড়ির সামনে একটি পরিত্যক্ত কুয়োর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র গুলো লুকিয়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো। ক্ষুদিরাম তার অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিপ্লবী কর্মীদের বন্দুক রিভলবার চালানোর শিক্ষা দিতেন।"(ক্ষুদিরাম- সম্পাদনা শৈলেশ দে, মানিক মুখোপাধ্যায়, সৌমেন বসু, পৃষ্ঠা- ৪৪)
🍂
'ছেঁদাপাথর' বন্দুক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল সেরা সেরা তালিম পাওয়া বিপ্লবীদের জন্য। সেকথা দিগম্বর বাবুর ছেলে দেবেন্দ্রনাথ নন্দ মহাশয়ের ১৯৪৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখও রয়েছে। তিনি লিখেছেন "...খেলোয়াড়দের মধ্যে যাহাকে যাহাকে ক্ষুদিরাম পছন্দ করিতেন, তাঁহাদের লইয়া গিয়া বাঁকুড়া জেলার ছেঁদাপাথার মৌজার জঙ্গলে বন্দুক শিক্ষা দিতেন।(শহীদ ক্ষুদিরাম/ ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৯০) এর থেকেই বোঝা যায় বন্দুক শিক্ষা সকলে পেত না।
আরো একজন, কাঁথি আদালতের স্বনামধন্য উকিল শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পট্টনায়ক যিনি আবার ক্ষুদিরামের বিপ্লবী সহকর্মী ছিলেন, উনি এই 'ছেঁদাপাথর' সম্পর্কে ১৯৪৭ সালের ১লা আগস্টে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছেন,
"ছেঁদাপাথর নামক স্থানে নন্দবাবুদের কাছারির কূপের মধ্যে রিভলবার, তলোয়ারাদি লুকাইয়া মাটি চাপা দেওয়া হইয়াছিল। ক্ষুদিরাম তথায় গিয়া বন্দুকাদি পরিচালনার নেতৃত্ব করিতেন। বিদ্রোহ আন্দোলনের সময় আমি ঐ কূপের মাটি তুলিবার মনস্থ করিয়াছিলাম, কিন্তু সুযোগ ঘটিয়া উঠে নাই।"(শহীদ ক্ষুদিরাম/ ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র, পৃষ্ঠা- ৯০-৯১)
'ছেঁদাপাথর' অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় আবার একটু ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, "রাজা রাইচরণ(অম্বিকার রাজা) এবং বাঁকুড়ার হিড়বাঁধে সদ্য কেনা জমিদারির মালিক নরেন গোঁসাই বিপ্লবীদের জায়গাটির সন্ধান দিয়েছিলেন।"(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই আগস্ট, ২০২১) যেখানে সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ বা তৈরি করা সম্ভব ছিল না বলেই তারা এ জায়গা নির্বাচন করেছিলেন। পত্রিকায় আরো এক স্থানে বলা হয়েছে, ১৯০৮ সালে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে নরেন গোঁসাই এই ছেঁদাপাথরের গোপন ঘাঁটির কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই আগস্ট ২০২১) তবে আনন্দবাজার পত্রিকাই ভিন্ন মত প্রকাশিত হলেও ছেঁদাপাথরে এই 'ঘাঁটি' গড়ে ওঠার পিছনে মুগবেড়িয়ার জমিদার 'নন্দ' পরিবারের অবদান বেশি সত্য ও প্রমাণিত।
তথ্যসূত্র: ১) ক্ষুদিরাম/ সম্পাদনা শৈলেশ দে, মানিক মুখোপাধ্যায়, সৌমেন বসু
২) শহীদ ক্ষুদিরাম/ শ্রী ঈশান চন্দ্র মহাপাত্র
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪/৮/২০২১
৪)পশ্চিমবঙ্গ- শহীদ ক্ষুদিরাম বসু জন্মশতবার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা
0 Comments