জ্বলদর্চি

পৌরাণিক ভ্রাতা- ভগিনীর উপখ্যানে রাখীবন্ধন উৎস সন্ধান /প্রসূন কাঞ্জিলাল

পৌরাণিক ভ্রাতা- ভগিনীর উপখ্যানে রাখীবন্ধন উৎস সন্ধান

প্রসূন কাঞ্জিলাল 


প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় রাখীবন্ধন উৎসব। এই দিনে বোনেরা তাদের ভাইয়ের ডান হাতের কব্জিতে রাখী বাঁধেন। তাদের মিষ্টি খাওয়ান। অন্যদিকে, ভাইরা তাদের বোনদের রক্ষা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। সম্ভবত এই উপাচার থেকেই নাম হয়েছে রক্ষাবন্ধন, যা পরবর্তী সময়ে রাখীবন্ধন হিসেবে উৎযাপিত হয়ে চলেছে।এই উৎসবকে ভাই-বোনের অটুট ভালোবাসা ও উৎসর্গের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শাস্ত্রমতে, ভাইয়ের হাতে রাখি পরানোর সময় ‘ওঁ ত্রায়ুষম জমদগ্রে: কশ্যপস্য ত্রায়ুষম ৷ য়হেবেষু ত্রায়ুষম তন্ত্রো অস্তু ত্রায়ুষম -’এই মন্ত্রের জপ করা উচিত ৷

 এই উৎসবের পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক উৎস সন্ধান করা যাক। রাখীবন্ধন উপলক্ষে দেবতাদের বোনেদের নিয়ে অজানা উপাখ্যান ও কাহিনী প্রচলিত আছে ,যেমন অনেকে বলে থাকেন যমুনা তাঁর ভাই যমের হাতেও রাখী বেঁধেছিলেন এই দিন। আবার অনেকে বলেন দ্রৌপদীও শ্রীকৃষ্ণের হাতে রাখী বেঁধেছিলেন। মহাভারতে আছে একবার কৃষ্ণের আঙুল কেটে যায়, দ্রৌপদী তাঁর গায়ের কাপড় ছিঁড়ে তা বেঁধে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের আঙুলে। এর বদলে কৃষ্ণ কথা দেন, যে কোনও বিপদেই তিনি দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন।
   আবার অনেকে বলে থাকেন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে হতদরিদ্র নারীর বেশে  বলি রাজার কাছে আশ্রয় চান লক্ষ্মী। বলি নিজের প্রাসাদের দরজা খুলে দেন তাঁর জন্য। খুশি হয়ে লক্ষ্মী, কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন বলির হাতে।
    কথিত আছে গণেশের দুই পুত্র, শুভ ও লাভ বায়না ধরেছিল নিজেদের বোনের হাতে তারা রাখী পরতে চায়। কিন্তু কোনও উপায় নেই। শেষে গণেশের দুই স্ত্রী, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির অন্তর থেকে নির্গত অগ্নি থেকে সৃষ্টি করা হয় সন্তোষীকে। তার হাত থেকে রাখী বাঁধে গণেশ পুত্ররা।
   রামায়ণ অনুযায়ী, ভগবান রাম সমস্ত বানর সেনাদের ফুল দিয়ে রাখী বেঁধে ছিলেন। এও এক ভ্রাতৃ বন্ধনের উত্তম উদাহরণ।
   আবার শাস্ত্রীয় তথ্যনুযায়ী শুক্লযজুর্বেদ মন্ত্র অনুসারে ‘রাখীবন্ধন’ উৎসবের আগে শ্রাবণ পূর্ণিমায় ব্রহ্মঋষিদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার পরম্পরা চলে আসছে ৷ আর গুরু পরম্পরার প্রথা অনুযায়ী ওই দিন সনাতন ধর্মী মানুষজন এবং বৈদিক গুরুরা নিজের শিষ্যদের সঙ্গে সমুদ্র, নদী কিংবা সরোবরের পাশে বসে তাঁর আত্মশুদ্ধি করেন ৷ আর সেই হেতু তাঁদের হাতে পরিয়ে দেন একটি পবিত্র সুতো ৷ সে নিয়ম তো বহু যুগ ধরে চলে আসছে ৷
   
    এবার বলি আরো কতকগুলি উপখ্যান। শিব-পরিবার সম্পর্কে সকলেই জানেন, কিন্তু খুব কম লোকই জানেন যে শিবের একটি বোনও ছিলেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কৈলাস পর্বতে পার্বতী একাকীত্ব অনুভব করায় তাঁর মনে হয়, ননদ থাকলে খুব ভালো হত। পার্বতীর মনের কথা বুঝে মহাদেব আপন মায়ায় সৃষ্টি করলেন তাঁর বোন আশাবরীকে।পার্বতীর মনের কথা বুঝে মহাদেব নিজের মায়াবী ক্ষমতার সাহায্যে এই বোন সৃষ্টি করেন। 
 মহাভারতে কৌরবদের এক বোন ছিলেন,তাঁর নাম ছিল দুঃশলা।

   রাজা বলির এক ধর্ম বোন ছিলেন। একদা রাজা বলির যজ্ঞে বিষ্ণু বামন অবতার ধারণ করে উপস্থিত হন। সেখানে নিজের পায়ের তিন ধাপের সমান মাপের জমি রাজার কাছ থেকে চান। বামনের পায়ের ধাপে কতটুকুই জমি ধরবে, এই ভেবে বিষ্ণুকে জমি দিতে রাজি হন রাজা। নিমেষের মধ্যে বিষ্ণু সমস্ত ভূমি নিয়ে নেন ও রাজা বলিকে পাতাল লোকে পাঠিয়ে দেন। তখন বলি বিষ্ণুর কাছে বর চান। বিষ্ণুকে সব সময় নিজের সামনে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাজা বলি। এই বরের কারণে বিষ্ণু পাতাললোকে রাজা বলির দ্বাররক্ষী হন। সে সময় স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য লক্ষ্মী এক সাধারণ মহিলার রূপ ধারণ করে কাঁদতে কাঁদতে পাতালে পৌঁছন। সেখানে রাজা বলি লক্ষ্মীকে তাঁর দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করায়, তিনি বলেন, তাঁর কোনও ভাই নেই। এর পর রাজা বলি লক্ষ্মীকে নিজের বোন পাতান। মনে করা হয়, তখন থেকেই রাখীবন্ধন উৎসব পালিত হয়।
    যমরাজের বোন যমুনার কথা অনেকেই জানেন। একবার যমুনা নিজের ভাই যমকে আমন্ত্রণ জানান। যম নিজের বোনের বাড়ি গেলে, যমুনা সেখানে তাঁকে ভোজন করান। প্রসন্ন হয়ে যম বর দিতে চান। যারা তাঁর জলে স্নান করবে, তারা কখনও যমলোকে যাবে না, এমন বর চান যমুনা। বর শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন যম। ভাবেন, এভাবে যমলোকের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। ভাইকে চিন্তিত দেখে যমুনা ফের বর চান যে, এদিন যে ভাই নিজের বোনের বাড়িতে আহার করবে ও যমুনার জলে স্নান করবে, তাঁকে যমলোকে প্রস্থান করতে হবে না। তখন থেকে যমদ্বিতীয়া পালিত হচ্ছে।
  রোহিণী-কন্যা সুভদ্রা কৃষ্ণের বোন ছিলেন। আবার যশোদার গর্ভ থেকে যোগমায়া হিসেবে জন্ম নেন দেবী সতী। কৃষ্ণের সঙ্গে পাল্টে বাসুদেব যোগমায়াকেই মথুরা নিয়ে যান। এ ভাবে যোগমায়াও কৃষ্ণের বোন। পাশাপাশি দ্রৌপদীকে কৃষ্ণ নিজের বোনের সম্মান দিতেন।
🍂

   সুভদ্রা কৃষ্ণের ছোট বোন, কৃষ্ণ সুভদ্রাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তবে আপন বোন না হয়েও দ্রৌপদী ছিলেন কৃষ্ণের অতীব স্নেহভাজন। একদিন সুভদ্রা কিছুটা অভিমান ভরে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, এর কারণ কী? উত্তরে কৃষ্ণ জানান, ‘যথা সময়ে এর কারন তুমি বুঝতে পারবে'।এর কিছুদিন পর শিশুপাল বধের সময় সুদর্শন চক্রের চালনার কালে হঠাৎ ই শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত ঝরছিল, তা দেখে সুভদ্রা রক্ত বন্ধ করার জন্য কাপড় খুঁজছিলেন, কিন্তু কোথাও কোনও পাতলা সাধারণ কাপড় পাচ্ছিলেন না, এর মাঝে দ্রৌপদী সেখানে এসে দেখেন কৃষ্ণের হাত থেকে গলগল করে রক্ত পরছে। সেই ঘটনা দেখামাত্রই বিন্দুমাত্র দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুল্যবান রেশম শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেধে দেন, কিছুক্ষণ পর রক্তপাত বন্ধ হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রাকে ডেকে বলেন-‘এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি?’ সুভদ্রা তখন বুঝত পারলেন, ভক্তি ও পবিত্র ভালবাসা, শ্রদ্ধা কী জিনিস! দাদা কৃষ্ণের চেয়ে মুল্যবান বস্ত্র নিজের কাছে বেশি প্রিয়, এটা ভেবে সুভদ্রা দারুণ লজ্জিত হয়ে পড়েন। কোন বোন তার ভাইয়ের কোনও রকম কষ্ট, অমঙ্গল সহ্য করতে পারে না। ভাইয়ের কষ্ট দূর করার জন্য সে সর্বোত্তম চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভাই ও তার বোনকে পৃথিবীতে সর্বাধিক স্নেহ করে, সারাজীবন তাঁকে রক্ষা করে থাকে, যে রকম শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রাজসভায় চরম কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই, এই পবিত্র বন্ধনের দিনে, সকল ভাই-বোনের উচিত এরকম ভক্তিভাব ও ভালবাসা বজায় রাখা। কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতার এই বর্তমান যুগে ভাই-বোনের মাঝে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বড় অভাব। সনাতন ধর্মে বড় বোন বা দিদিকে মাতৃস্থানীয় এবং বড় ভাইকে পিতৃস্থানীয় সম্মান ও ভালবাসা দেওয়ার কথা বলা আছে।
   রামের ভাই সম্পর্কে সকলেই জানেন। কিন্তু রামের এক বোনও ছিলেন। তাঁর নাম ছিল শান্তা। রাজা দশরথ ও কৌশল্যার বড় মেয়ে ছিলেন শান্তা। জন্মের কয়েক বছর পর রাজা দশরথ কিছু কারণবশত অঙ্গদেশের রাজা রোমপদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের কন্যাকে। এর পর রাজা রোমপদ ও তাঁর স্ত্রী শান্তার লালন-পালন করেন।
   রাবণের বোন শুর্পনখার নাম সকলেরই জানা। তবে জানেন কী, রাবণের আর এক বোনও ছিলেন। তাঁর নাম ছিল কুম্ভিনী। মধু নামক এক রাক্ষস কুম্ভিনীর অপহরণ করে। ক্রোধবশত মধুকে বধ করতে পৌঁছলে বোনের কাছ থেকে রাবণ জানতে পারেন যে, মধু রাক্ষস কুম্ভিনীর সঙ্গে বিবাহ করেছেন, তাই সে মধু রাক্ষসকে নিস্কৃতি দেন ।
     সেই পৌরাণিক যুগ থেকে আজ অব্দি ভাই- বোনের সম্পর্ক যেন স্নেহাশীষের সফলতম রূপ হয়ে আছে। ভাই বোনের অবস্থানের দূরত্ব থাকলেও, পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে অদৃশ্য এক রাখীবন্ধন চিরকাল রয়েই যায় তাদের অন্তরে।

Post a Comment

0 Comments